চকরিয়ায় ভয়াবহ বন্যা, দুই লক্ষ মানুষ পানিবন্দী

fec-image

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম সেই মুহুর্তে কক্সবাজারের চকরিয়ায় টানা ভারীবর্ষণে ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পেয়ে চকরিয়ায় তিনটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক অধিক মানুষ পানি ও ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে।

ভারি বর্ষণে ও ঢলের পানিতে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। গলকাল (বুধবার) দিনভর বৃষ্টি হওয়ায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে হাজার একর চিংড়িঘেরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এতে কয়েক কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ ভেসে যাওয়ায় চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। এছাড়াও পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির রোপিত ফসল ও বীজতলা। আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীনের মুখে পড়েছে প্রান্তিক চাষিরা। গ্রামীণসড়ক পানিতে ডুবে থাকায় উপজেলার সাথে বিভিন্ন ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। টানা ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় আরো বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমা উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী শাখা কর্মকর্তা (এসও) জামাল মোর্শেদ।

পাউবোর কর্মকর্তা জামাল মোর্শেদ বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে চকরিয়া উপজেলার বিশেষ করে উপকুলীয় অঞ্চলের অবস্থা নাজুক হতে পারে। মাতামুহুরী নদীতে পানি প্রবাহের কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্থ উপজেলার বিএমচরের কন্যারকুম সকালে ও কোনাখালী ইউনিয়নের মরংঘোনা পয়েন্টে বিকেলে এবং বৃহস্পতিবার ভোররাতে কুরিল্যারকুম বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যায়। তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পানি আরও বাড়বে, তাতে বেড়িবাঁধের চরম ক্ষতিসাধন হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভারি বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা এলাকায় ঢুকে প্লাবিত হওয়ায় চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্ধি চকরিয়া পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড়সহ উপজেলার কাকারা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, কোনাখালী, বিএমচর, ফাঁশিয়াখালী, পূর্ব বড়ভেওলা, পশ্চিম বড়ভেওলা, ডেমুশিয়া, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, সুরাজপুর-মানিকপুর, খুটাখালী, ডুলাহাজারা, বদরখালী ও বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে চরম ভাবে খাদ্য ও বিশুদ্ব পানির অভাব দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নতুন নতুন এলাকায় ঘর-বাড়ি, সরকারী প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে বন্যার পানি প্রবেশ করে তলিয়ে যায়। বাড়ি-ঘর ডুবে থাকায় শতশত মানুষ আশ্রয়ন কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় বর্তমানে আশ্রয় নিয়ে তারা দিনাতিপাত করছেন।

এদিকে পুরো উপজেলায় ভয়াবহ বন্যায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ঘর-বাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করায় রান্নার কাজ করতে পারছে না বানভাসি মানুষ। অনেকে শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করছেন। আবার অনেকেই খাদ্য সংকটের কারণে অভাবে অভুক্ত থেকেছেন। বিভিন্ন গ্রামীণসড়ক গুলো পানিতে ডুবে থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে উপজেলা শহরের সাথে। এ ছাড়া অন্তত দশটি ইউনিয়নে গত তিনদিন ধরে বন্ধ রয়েছে পল্লীবিদ্যুৎ সরবরাহ। বেশকিছু ইউনিয়নে বানভাসি মানুষেরা নৌকা ও কলাগাছের ভেলা বানিয়ে চলাচল করছে।

স্থানীয়রা জানান, পুরো উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিলেও এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে কোন পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী দূর্গত এলাকায় পৌঁছায়নি বলে বানভাসি বন্যকবলিত মানুষেরা দাবি করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে বানভাসি মানুষের জন্য কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সাংসদ আলহাজ্ব জাফর আলম ব্যক্তিগত উদ্যোগে পৌরসভায় ৫ হাজার মানুষের মাঝে রান্নাকরা খাবার বিতরণ করেন। একই ভাবে চকরিয়া পৌরসভার নাগরিক কমিটির ব্যানারে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও পৌর কাউন্সিলর জিয়াবুল হক চার হাজার পানিবন্ধি মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কিছু এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করলেও এসব পর্যাপ্ত নয় বলে জানান বানভাসিরা। বর্তমানে চরম দূর্ভোগে পড়েছে ওই সব ইউনিয়নের পানিবন্দী মানুষ। গত তিনদিন ধরে এসব এলাকার শ্রমজীবী মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক বলেন, তার ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে রয়েছে। কৃষকের বীজতলা ও বিভিন্ন ধরণের ফসল ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, তার ইউনিয়নে উপজেলা পরিষদ ও ব্যক্তিগতভাবে ৫০হাজার টাকার শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। মানিকপুর এলাকার সবচেয়ে দুই শত বছরের পুরনো কিউকের মসজিদ যে কোন মুহুর্তে নদী গর্ভে বিলিন হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ জানান, ভারিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে পুরো উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে মানুষ সরানো হচ্ছে। তাদেরকে আশ্রয়ন কেন্দ্র গুলোতে উঠানো হচ্ছে। বুধবার থেকে পানিবন্দি পরিবারের মাঝে সহায়তা হিসেবে বিতরণের জন্য উপজেলা প্রশাসনে থেকে ১৮টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে প্রতি ইউনিয়নে ৪ টন করে ৭২ টন চাউল, ১শত বস্তা চিড়া ও গুড় বরাদ্দ দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা প্রশাসন থেকে নতুন করে দূর্গত মানুষের লাগবে পৌরসভার জন্য ১০টন এবং ১৮ইউনিয়নের জন্য ২৮ টন চাউল, ২০ বস্তা চিড়া, ১হাজার কেজি গুড় ও পাঁচশত কেজি শুকনা খেজুর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন