চাই শ্রমিকের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন

১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেট প্রাঙ্গনের ম্যাসাকারে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে রেমন্ড লাভিনের প্রস্তাবে পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয় বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে। হে মার্কেট প্রাঙ্গনের রক্তাক্ত বাতাস আন্দোলন, প্রতিবাদের বারুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। এ প্রতিবাদ শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের শরীর থেকে ঝরে পড়া মূল্যহীন ঘামের।
সেই ঘনটনার ১৩৮ বছর পরেও, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে শ্রম বিষয়ক আইন-কানুন থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিনই শ্রমিকদের অমানবিক মৃত্যু, লাঞ্ছনা, বঞ্চনার খবর পাওয়া যায় বিশ্বব্যাপী। এক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এগিয়ে থাকলেও বিপর্যস্ত অবস্থা উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩৮ সালে ফেডারেল আইনের মাধ্যমে ন্যায্য শ্রম মান আইন (এফএলএসএ) প্রণয়ন করে। এফএলএসএ’র অধীনে শিশুশ্রমের বিধানগুলি ও তরুণদের শিক্ষাগত সুযোগগুলি সুরক্ষিত করার জন্য এবং তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর চাকরিতে তাদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এতে যে শতভাগ সফলতা এসেছে, বিষয়টি আসলে তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১৮ সালের পর দেশটিতে শিশুশ্রম আইন লঙ্ঘন ৭০ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরে ৮৩৫টি কোম্পানি এই আইন লঙ্ঘন করে (সূত্র: বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং ডয়েচে ভেলে)। অন্যদিকে, আরেক উন্নত রাষ্ট্র চীন ১৯৯৫ সালে শ্রম আইন, ২০০৮ সালে শ্রম চুক্তি আইন প্রণয়ন করে শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন করেছে। তবে সেদেশের কোথাও কোথাও বাস্তবায়নে ব্যত্যয় ঘটেছে।
প্রত্যেক কর্মজীবীই একেকজন শ্রমিক। শ্রমের ধরন হতে পারে ভিন্ন। শ্রমিক দিয়ে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ না করানো এবং সঠিক পারিশ্রমিক যেমন শ্রমিকের অধিকার, ঠিক তেমনি এটা মালিকপক্ষের দায়িত্ব। শিশু শ্রমিকের প্রতি রূঢ় আচরণের চিত্র খুবই ভয়াবহ। অথচ, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ ৩৪নং ধারায় শিশু-কিশোর নিয়োগের বিধিনিষেধ থাকলেও প্রায় মিডিয়ার কল্যাণে শিশু শ্রমিককে পায়ুপথে বায়ু প্রবেশ করিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার সংবাদও চোখে পড়ে। ষষ্ঠ অধ্যায়ের ধারা ৬১-৭৮ এ শিল্প-কারখানা বা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। অথচ, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রতিবছরই কারখানা-মার্কেটে আগুনে, রানা প্লাজার মতো ভবন ধসের ঘটনা কিংবা অন্যান্য কারণে মারা যায় অসংখ্য শ্রমিক, অভিশপ্ত জীবন নিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের, যারা আইন অনুসারে ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। প্রবাসী শ্রমিকের নির্যাতনের চিত্র আরও ভয়াবহ। বিশেষ করে প্রবাসে নারী শ্রমিকদের উপর অমানবিক নির্যাতন করুণ চিত্র নতুন নয়।
এসব ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ শ্রমিকের অধিকার বা শিল্প-কারখানা পরিচালনা আইন জানেন না, বিষয়টি তা নয়। অনেকটা জেগে থেকে ঘুমানোর মতো। সে কারণেই প্রশ্ন ওঠে, মননে যদি নাই-বা আসবে, আইন শুধু বই পুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকার জন্যই প্রণয়ন? আবার অনেকের মাঝে এখনো সচেতনতার অভাবও রয়েছে। আইনে ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠনের কথা বলা হয়েছে, সেটাও অনেকটা দানব শ্রেণির ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সভা-সেমিনার, প্রতিবাদ, দিবস উদযাপন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে করলেও নির্যাতিত শ্রমিকের বেদানা ভরা নিঃশ্বাসে দুনিয়ার বাতাস এখনো ভারী হয়ে আছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সেটা করতে হলে আমাদের শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়নে সকল ব্যবসায়ীর আন্তরিক হওয়ার বিকল্প নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব তথা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অপরিহার্য। আমাদের প্রত্যাশা, শ্রমিকের শ্রম ঘণ্টা, শ্রমের সঠিক মূল্য দেওয়ার রেওয়াজ ও মানসিকতা হোক শতভাগ। এভাবেই মহান মে দিবসের অঙ্গীকারের বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের প্রতিটি শ্রমিকের জীবনে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস স্বার্থক হোক সচেতনতায়, সফল হোক আন্তরিকতায়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, রামগড়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।