চেয়ারম্যানের ছবিযুক্ত ক্যালেন্ডার ছাপাতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, পরিষদ সদস্যদের ক্ষোভ

fec-image

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার ছবি না থাকায় ছাপানো ক্যালেন্ডার বিতরণ বন্ধ রেখে নতুন করে তার ছবিসহ ক্যালেন্ডার ছাপানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এতে অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরিষদের সদস্যরা এই অপচয়ের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার ব্যয়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ডেস্ক ও ওয়াল ক্যালেন্ডার ছাপলেও চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার ছবি না থাকায় ক্যালেন্ডারটি প্রচার ও বিতরণে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আটকে আছে। চেয়ারম্যানের ছবিসহ আরো একটি বাড়তি পাতা ছাপানোর কারণে ক্যালেন্ডারটি ছাপা খানায় রয়েছে। এতে করে রাষ্ট্রীয় তহবিলের বাড়তি টাকা টাকা খরচ হলেও কবে নাগাদ ক্যালেন্ডারটি বিতরণ তা অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের এবারের ইংরেজি নববর্ষের ক্যালেন্ডারে স্থান পেয়েছিল জুলাই-আগষ্টে শহিদ আবু সাঈদ’র দুলর্ভ ছবিসহ ছয় ঋতু আর পাহাড়ের জীবন-চিত্র নিয়ে সৃজনশীল চিন্তা চেতনা। তবে পাহাড় হোক বৈষম্যহীন সম্প্রীতিময় এমন প্রতিপাদ্যে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

ক্যালেন্ডারটি প্রচার ও বিতরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিষদের খোদ চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা। প্রায় ৮ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকাশিত ছয় পাতার এই ক্যালেন্ডারে তার কোন ছবি কেন স্থান পেলো না সেটাই ছিল বাধার মূল কারণ। এ যেন আরেক ফ্যাসিস্ট।

একটি সূত্র জানায়, প্রতি বছরের মতো এবারও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তবে এবার ছয় ঋতু আর পাহাড়ের জীবন-চিত্র নিয়ে সৃজনশীল চিন্তা চেতনার পাশাপাশি জুলাই-আগষ্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

পাহাড় হোক বৈষম্যহীন সম্প্রীতিময় এমন প্রতিপাদ্যে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারে পুলিশের গুলির সামনে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের সে বুক পেতে দেওয়া দুলর্ভ ছবি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ছাত্র-জনতার উল্লাসের ছবিসহ ছয় ঋতু আর পাহাড়ের আকর্ষণীয় জীবন-চিত্র স্থান পায়।

১৬ জানুয়ারি ছাপাখানা থেকে ক্যালেন্ডারটি পরিষদের কাছে হস্তান্তর করেন। তবে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারে নিজের ছবি না থাকায় পরিষদ চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা ক্ষুব্ধ হন। জানতে চান কেন কালেন্ডারের পাতায় তার ছবি নেই। তিনি ক্যালেন্ডার বিতরণ বন্ধ করে দেন। আবার নতুন করে ক্যালেন্ডার ছাপতে বলেন।

চেয়ারম্যানের নির্দেশে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারে চেয়ারম্যানের ছবি দিয়ে আরো একটি পাতা চেয়ারম্যানের ছবি দিয়ে প্রেসে পাঠান। চেয়ারম্যানের নির্দেশে ৬ পাতার ক্যালেন্ডার ৭ পাতা হয়।

খাগড়াছড়ি ইসলামী প্রেসের মালিক মো. শামসুল আমীন খাঁন ছেলে আব্দুর রহমাস সাদ জানানা, প্রথম দফায় দেড় হাজার পিচ ডেস্ক ও দুই হাজার পিচ ওয়াল ক্যালেন্ডারের ছাপতে খরচ হয়েছে ৮ লাখ ৩০ হাজার ৫শত টাকা।

নতুন করে আরো এক পাতার খরচ হিসেব করে বলতে হবে।

এদিকে চেয়ারম্যানের মনোবাসনা পূর্ণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় তহবিলের অর্থ অপচয়ের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্যরা।

 

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সাথোয়াইপ্রু মারমা চেয়ারম্যানের মনোবাসনা পুরুণে এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছু না। ক্যালেন্ডার ছাপানোর পর তা বিতরণ না করে আবার নিজের ছবিযুক্ত ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার ছাপানো স্বেচ্ছাচারিতা ও মনগড়া। এর নিন্দা জানানোর ভাষা জানা নেই।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের অপর সদস্য নিটোল মনি চাকমা বলেন, ১৪ জানুয়ারি প্রেস কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করেছে। ক্যালেন্ডারে জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবের বেশ কিছু দুলর্ভ ছবিসহ ছয় ঋতু আর পাহাড়ের জীবন-চিত্র নিয়ে সৃজনশীল ছবি স্থান পেয়েছে। কিন্তু সে ক্যালেন্ডার বিতরণ করা হয়নি। এটা দুঃখজনক।

নিটোল মনি চাকমা বলেন, শুরু থেকে চেয়ারম্যানের সাথে সদস্যদের টানাপড়া চলছে। প্রায় ঝগড়া চলে চেয়ারম্যানের সাথে সদস্যদের। চেয়ারম্যানের কারণে জেলা পরিষদের ইমেজ সংকটে পড়ছে।

পরিষদের অপর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা আগামী সংসদ সদস্য নির্বাচনে এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। রাষ্ট্রীয় অর্থে ক্যালেন্ডারে তার ছবিযুক্ত করা সেই নির্বাচনে প্রচারণার অংশ।

এ বিষয়ে চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব তাসলীমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর বলে পরিচিত জিরুনা ত্রিপুরাকে চেয়ারম্যান এবং আরও ১৪ জন সদস্য নিয়ে পুনর্গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন খাগড়াছড়ি পার্বত্য পার্বত্য জেলা পরিষদ। এর তিনদিন পর ১০ নভেম্বর নবনিযুক্ত সদস্যদের নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা। জিরুনা ত্রিপুরা চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হওয়া এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তার নানা দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে জেলা জুড়ে বিস্তর সমালোচনা চলছে। এ নিয়ে শুরু থেকে অস্বস্তিতে ছিল পরিষদের নব নিযুক্ত সদস্যসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ও পরিষদে হস্তান্তরিত ২৪টি বিভাগের কর্মকর্তাসহ জেলার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এ নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।

 

মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে জিরুনা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার পাহাড় জমেছে। বড়দিনের খাদ্যশস্য বিতরণে অনিয়ম, বরাদ্দ পাওয়া এক হাজার মে:টন চাউল ও গম বিতরণ না করে আত্মাতের চেষ্টা, শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণের নামে পরিষদ তহবিল থেকে ৩৫ লাখ উত্তোলন করে বিতরণ না করা, উন্নয়ন প্রকল্পের জানানত থেকে উৎকোচের জন্য ফাইল আটকিয়ে রাখা, পরিষদ সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে খেয়াল-খুশিমতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিজ দপ্তর ও হস্তান্তর ২৪ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুই-তোকারি ব্যবহার, যখন-তখন অফিস আদেশ জারি করে খোদ পরিষদ সদস্যদের হেনস্তা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে যত্রতত্র গাড়ি ব্যবহার করে সরকারি অর্থ অপচয়, বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচিতে অসংলগ্ন আচরণ, স্বজাতপ্রীতি ও নিকটাত্মীয়দের পুনর্বাসনসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।

চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার দুর্নীতি-অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন