parbattanews

জনগণকে জানাতে চাই : প্রসঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম-১

জেনারেল-ইব্রাহীম

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক 

পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনবান্ধব

২০১৬ সালটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত ‘পর্যটন বছর’। বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট এবং দেশী পর্যটকদের উৎসাহিত করতে সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। পর্যটকদের কাছে যেসব আকর্ষণীয় স্থান আছে, তার মধ্যে অন্যতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। তার পরই উল্লেখ করার মতো স্থান হচ্ছে পার্বত্য তিন জেলায় রাঙ্গামাটি শহর ও রাঙ্গামাটি লেক (হ্রদ), খাগড়াছড়ি শহর ও আলুটিলা পাহাড়, বান্দরবান শহর ও মেঘলা, চিম্বুক, নীলগিরি ইত্যাদি। বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনমূল্য বা ট্যুরিজম ভ্যালু বাড়ানোর জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও নেবে। পর্যটন বাড়লে, পার্বত্য চট্টগ্রাম যেমন আরো বিকশিত হবে তেমনি দেশেরও লাভ হবে; কিন্তু সরকারের উদ্যোগের সাথে সরেজমিন পরিস্থিতি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে (যেটা বর্তমানে আংশিকভাবে নেই বলে মনে করি)।

ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

সম্মানিত পাঠক, যদি কষ্ট করে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখেন তাহলে বুঝবেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূপ্রকৃতি সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান হচ্ছে ভূরাজনৈতিক এবং সামরিক আঙ্গিকে (ইংরেজি পরিভাষায় : জিও-স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড মিলিটারি কনসিডারেশন) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার দূরবর্তী ফুট হিলস বা পাদটিলা। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে যারা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অংশ, তাদেরই মতো নৃতাত্ত্বিক মানুষের (ইংরেজি পরিভাষায় : অফ সেইম এথনিক অরিজিন) বিস্তৃত বসতি, পূর্ব দিকে, উত্তর-পূর্ব দিকে এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, সমুদ্র বা মহাসমুদ্র পানির তীর পর্যন্ত। অর্থাৎ চায়না, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি প্রদেশ ইত্যাদি অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী, নৃতাত্ত্বিকভাবে মঙ্গোলয়েড। এই বিশাল নৃগোষ্ঠীর সমপারিবারিক বা সমগোত্রীয় (ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র) অংশ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি উপজাতি যথা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচঙ্গা, বোম, পাংখু, ম্রো, চাক, গুর্খা ইত্যাদি। তাহলে এটা হালকা মেজাজের ভাষায় বলাই যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে দু’টি বিশাল জনগোষ্ঠীর মিলনস্থান এবং দু’টি বিশাল ভূপ্রকৃতিরও মিলনস্থান।

আড়াই শ’ বছরের ইতিহাস

মোগল সাম্রাজ্যে, দক্ষিণ-পূর্বে সবচেয়ে দূরবর্তী জেলা ছিল চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম মানে আজ ২০১৬ সালের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। ১৭৬০ সালে দুর্বল মোগল সম্রাট চট্টগ্রাম জেলাকে, উদীয়মান শক্তি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হস্তান্তর করেছিল। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রাম জেলার পূর্ব অংশে অবস্থিত (ভূপ্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি বা পার্বত্য) অংশকে আলাদা জেলা করে দেয়। সেটার নাম হয়েছিল হিল ট্রাক্টস অব চিটাগং অর্থাৎ চট্টগ্রামের পার্বত্য অংশ। ব্রিটিশ ভারতে এটা একটি প্রান্তিক অঞ্চল এবং এখানকার মানুষ যেমন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ছিল, অনুরূপ ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিমে, পশ্চিমে, উত্তর-পূর্বে এবং পূর্ব দিকে এমনই আরো অনেক প্রান্তিক এলাকা ও জনগোষ্ঠী ছিল। এইরূপ প্রান্তিক এলাকা ও জনগোষ্ঠীগুলোর শাসনতান্ত্রিক বা প্রশাসনিক মর্যাদা বৃহত্তর ব্রিটিশ ভারত থেকে একটু ভিন্ন ছিল। ব্রিটিশদের আকাক্সক্ষা ছিল, ওই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রান্তিকই থাকুক; ওদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার কোনো প্রয়োজন নেই; ওই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ব্রিটিশদের আনুগত্য মেনে নিয়ে খাজনা দিলেই যথেষ্ট। সময়ের সাথে সাথে ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে যায়। পৃথিবী ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে; যোগাযোগব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে এবং লেখাপড়ার বিস্তৃতি ঘটছে; ক্রমান্বয়ে মানুষে মানুষে মেলামেশা বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু এরূপ সব ইতিবাচক অগ্রগতির অবশ্যম্ভাবী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অত্যাচারী লোভী দুর্বৃত্তদের কর্মকাণ্ডও বেড়ে যায়; কিন্তু ওদের আগ্রাসী ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপযুক্ত ও যথেষ্ট ব্যবস্থা সমানুপাতে শক্তিশালী হতে পারেনি। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এ রকমই একটি ভৌগোলিক অঞ্চল এবং সেখানকার নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এরূপ একটি আলোচিত বিষয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম : পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে

ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য বিভাজিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল এবং স্বাধীনতার পর থেকে এটি বাংলাদেশের অংশ। পাকিস্তানের ২৩ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়েছে কাপ্তাইতে স্থাপিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য। এই প্রকল্পের মারাত্মক নেতিবাচক ফলাফল ও প্রতিক্রিয়াও ছিল। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সন্ধিলগ্ন হলো ১৯৭১ সাল। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের ভূমিকা হালকাভাবে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং জোরালোভাবে ও বিশদভাবে ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশের সরকারগুলো অনেক ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য; কোনো কোনো পদক্ষেপ জনগণ সাদরে গ্রহণ করেছে; কোনো কোনো পদক্ষেপ জনগণের পক্ষ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে; কোনো কোনো পদক্ষেপ জন্ম দিয়েছে বিশৃঙ্খলার। প্রান্তিক এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সেখানকার প্রান্তিক উপজাতীয় জনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে বাংলাদেশের যে অভিজ্ঞতা, এরূপ অভিজ্ঞতা বা একই ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতিতে কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা আমাদের আশপাশেই এবং কিছু দূরে আরো অনেক দেশে আছে। সব দেশই ভালো কাজ যেমন করেছে, বিতর্কিত কাজও করেছে। প্রতিটি দেশ বা দেশের সরকার নিজ নিজ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়েই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের দেশের জন্যও এটা সত্য। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৫ বছর মেয়াদের মধ্যে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৭ (২২ বছর) পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণ থেকে সৃষ্ট একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। পর্যায়ক্রমে বা ধাপে ধাপে সেই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি ও পরিবেশকেও নিরুত্তপ্ত (ইংরেজি পরিভাষায় : মিটিগেট) করা হয়েছে। তারপরও আজ ৪৫ বছরের শেষ মাথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কট উত্তরণের নিমিত্তে গৃহীত কিছু পদক্ষেপ সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করি; অথবা সঙ্কটকে বাড়িয়ে তোলার আশঙ্কা আছে (ইংরেজি পরিভাষায় : হ্যাজ দি পোটেনশিয়ালিটি টু ইনক্রিজ অর ইনসাইট) বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের সংহতির নিমিত্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের বিভিন্ন অংশের বা বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ ও সমন্বিত সহ-অবস্থান ও উন্নতির স্বার্থে এ বিষয়গুলোর প্রতি বাংলাদেশের জ্ঞানীগুণী সচেতন নাগরিকদের মনোযোগ দেয়া আবশ্যক বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশ সরকারের মনোযোগ এসব বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ করা অতি জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা প্রসঙ্গ

পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি রাজনৈতিক সমস্যা বা আংশিকভাবে জাতিগত সমস্যা বিদ্যমান ছিল, ওই সমস্যা এখনো বিদ্যমান আছে এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করলেও সমস্যাটি এক দিনে দূরীভূত হবে না; কিন্তু এ জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। অতীতেও চেষ্টা হয়েছে, বর্তমানেও চেষ্টা চলছে, ভবিষ্যতেও যেন হয় সেটাই দেশবাসীর কামনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর (অফিসারসহ) শত শত সদস্য এবং বাংলাদেশের বিডিআর-পুলিশ-আনসার ভিডিপি সদস্য প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে, সরকারের হুকুমে দায়িত্ব পালনকালে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার নিরীহ পাহাড়ি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছে দুই পক্ষের যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত পাহাড়ি তরুণ প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তথা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনের জন্য অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন আঙ্গিকে চেষ্টা করা হয়েছে; কোনো উদ্যোগ আংশিকভাবে সফল হয়েছে; কোনো উদ্যোগ সাফল্যের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছে। উদ্যোগগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এই কলামে স্থানাভাবে দিতে পারছি না, পাঠক কষ্ট করে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বই পড়লে বিস্তারিত জানতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে একটি বইয়ের নাম উল্লেখ করছি। মাওলা ব্রাদার্স কর্তৃক প্রকাশিত বইটির নাম : ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন’। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরেজমিন অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘ দিন সম্পৃক্ততার সুবাদে পুস্তকটি আমার নিজেরই লেখা। মাওলা ব্রাদার্সের ঠিকানা : ৩৯, বাংলাবাজার ঢাকা, ফোন নম্বর : ৭১৭৫২২৭ অথবা ৭১১৯৪৬৩; ই-মেইল mowlabrothers@gmail.com; চার শ’ পৃষ্ঠার পুস্তকটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার উৎপত্তি, সমস্যা সমাধান তথা শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ, এই উদ্যোগগুলোর সীমাবদ্ধতা, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ভুলত্রুটি, হালনাগাদ অবস্থা ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। পুস্তকটি অনেক দোকানে পাওয়া যায়, আবার অনেক দোকানে পাওয়া যাবেও না। কারণ, এর বিষয়বস্তু রসকষবিহীন এবং আনকমন। তবে ঢাকা মহানগরের বেইলি রোডে এবং চট্টগ্রাম মহানগরের প্রেস ক্লাবের বিল্ডিংয়ে সব সময়ই বইটি পাওয়া যায়।

শান্তির উদ্যোগ ১৯৮৭-৮৯; ১৯৯৬-৯৭

পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা বিদ্রোহ করেছিলেন তাদের একটি রাজনৈতিক নাম ছিল। তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা ইংরেজিতে PCJSS. এ সংগঠনের সশস্ত্র শাখা ছিল ‘শান্তিবাহিনী’। বাংলাদেশ সরকার এবং পিসিজেএসএসের মধ্যে অনেকবারই শান্তির লক্ষ্যে আলোচনা হয়েছিল। ১৯৮৮-৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে, একটি নিবিড় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল শান্তি স্থাপনের জন্য। বিদ্রোহী শান্তিবাহিনী, বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনাটি মাঝপথে ভেঙে দিয়েছিল; অতএব সরকার সাধারণ জনগণের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেই সমঝোতায় উপনীত হয়েছিলেন। ওই সমঝোতার ফলে তিনটি পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার জেলা পরিষদ স্থাপন করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ একটির নাম ছিল রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে উদ্যোগটি ছিল অনবদ্য ও অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ও ২৯ ধারার একাধিক উপধারার বক্তব্যে শক্তিমান হয়ে সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছিল। এই জেলা পরিষদগুলো নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পরিষদ গঠিত হয়েছিল; কিন্তু পরে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আর নির্বাচন হয়নি; আজ অবধি হয়নি। ১৯৮৭-৮৯ সালের শান্তি উদ্যোগের ফলে গঠিত পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদগুলো পার্বত্যবাসীকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজেদের ওপর শাসন নিজেরাই যেন করতে পারেন, সেই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল, আংশিকভাবে হলেও। শান্তিবাহিনী এ বন্দোবস্তটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি। তারা ঘোষণা দিয়েছিল, তারা জেলা পরিষদ ব্যবস্থা মানে না। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় বিএনপি সরকারের আমলে শান্তিপ্রক্রিয়া অধিকতর বিস্তারিত ও অধিকতর অংশীদারিমূলক করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল; কিন্তু উদ্যোগগুলো সফল হয়নি। পেছনের দিকে তাকিয়ে যে মূল্যায়ন করছি, সেই মূল্যায়ন মোতাবেক, শান্তিবাহিনী কৌশলে বিএনপি সরকারকে প্রভাবিত করেছিল যেন স্থানীয় সরকার পরিষদের সময়মতো নির্বাচন না হয়। শান্তিবাহিনী কৌশলে এবং দেশের ভেতরে বা বাইরের কৌশলগত সমর্থনে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যেন বিএনপি তাদের শান্তি উদ্যোগগুলোতে সফল না হয়। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ সরকার আগে থেকেই বা ইতোমধ্যে চলমান উদ্যোগগুলোতে নতুন জীবন দান করেছিল। ফলে দেড় বছরের মাথাতেই আওয়ামী লীগ সরকার একটি উপসংহারে আসে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে একজন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রকোপ কমে আসে; যদিও সব অবৈধ অস্ত্র কোনো দিনই সরকারের কাছে জমা হয়নি বলে অনুভব করি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য হলো, ১৯৯৬-৯৭ সালের শান্তি আলোচনা, ওইরূপ আলোচনার ফলাফল; এর ফলে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি ইত্যাদি সব কিছুর ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন হলো অতীতের শান্তি আলোচনা ও অতীতের সমঝোতা এবং অতীতের আইনগুলো; বিশেষ কর ১৯৮৭-৮৯ এর শান্তি আলোচনার ফলে স্থাপিত পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনগুলো ও জেলা পরিষদ ব্যবস্থা। পিসিজেএসএস তথা শান্তিবাহিনী জেলা পরিষদ ব্যবস্থাকে যদিও ১৯৮৮-৮৯ সালে সশস্ত্রভাবে বিরোধিতা করেছিল, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে তারা এই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েই বাকি উপসংহারে উপনীত হন। ডিসেম্বর ১৯৯৭-এর শান্তিচুক্তির অনেক ভালো দিক আছে, অনেক মন্দ দিকও আছে। মন্দ দিকগুলোর মধ্যে দু’টি উল্লেখ করছি। প্রথমটি হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার।

বাঙালিদের ভোটাধিকার প্রসঙ্গ

৯৭ সালের চুক্তি দিয়ে এই ভোটাধিকারকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, খণ্ডিত তথা খর্ব করা হয়েছে। বুঝিয়ে বললে এরূপ দাঁড়ায়; পার্বত্য চট্টগ্রামে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ভোটার তালিকা প্রণীত হবে। একটি ভোটার তালিকায় পাহাড়ি-বাঙালি সবার নাম থাকবে নিঃশর্তভাবে, দেশের সব জায়গায় যেমন হয় তেমনভাবে; পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য। আরেকটি ভোটার তালিকাকে আমরা আঞ্চলিক তালিকা বলতে পারি। দ্বিতীয় ভোটার তালিকা তথা আঞ্চলিক তালিকায় সব পাহাড়ির নাম তো থাকবেই; কিন্তু শুধু ওইসব বাঙালির নাম থাকবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের স্থায়ী ঠিকানা আছে। ‘স্থায়ী’ ঠিকানার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চুক্তিতে এবং তৎপরবর্তী আইনে বলা হলো, যাদের নিজ নামে বৈধ জায়গা-জমি বা ভূসম্পত্তি আছে, তাদেরই স্থায়ী ঠিকানা আছে বলে মনে করা হবে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি সহজ ও সরল। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী দু’পক্ষই ধরে নিয়েছে যে, স্থায়ী ঠিকানা নেই এমন বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে অবশ্যই আছে অথবা অনেক বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে যাদের স্থায়ী ঠিকানা বিতর্কিত; অথবা প্রশ্নসাপেক্ষ। যদি আঞ্চলিক ভোটার তালিকায় বাঙালি ভোটারদের সংখ্যা কমাতে হয় তাহলে স্থায়ী ঠিকানা আছে এমন বাঙালির সংখ্যা কমাতে হবে। এরূপ সংখ্যা কমানোর জন্য ব্যবহারযোগ্য একটি পন্থা বা অস্ত্র হলো, ভূসম্পদের মালিকানা নিয়ে সন্দেহ বা বিতর্ক সৃষ্টি করা; এবং সন্দেহ বা বিতর্কের একপর্যায়ে মালিকানা বাতিল করে দেয়া হবে। মালিকানা বাতিল করলে সংশ্লিষ্ট বাঙালির স্থায়ী ঠিকানা পার্বত্য চট্টগ্রামে আর থাকবে না; যদি ঠিকানা না হয় তাহলে তিনি আঞ্চলিক নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না; আঞ্চলিক নির্বাচনে ভোট দিতে না পারলে তার মতামত বা সমর্থন প্রতিফলিত হবে না; মতামত বা সমর্থন প্রতিফলিত না হলে তাকে কোনো ভোটপ্রার্থী মূল্যায়ন করবে না ও দাম দেবে না। যদি কোনো নাগরিকের ভোটাধিকার না থাকে তাহলে তার জীবনযাত্রা মার্জিনালাইজড হয়ে যায়। অন্য কথায় বলতে গেলে, ওই নাগরিক দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়ে যেতে হবে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো নাগরিক কোনো পরিবেশে বা কোনো স্থানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকতে চান না। অতএব তখন পরিস্থিতির ওপর ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ওই নাগরিক বলতেই পারেন, এই পার্বত্য চট্টগ্রামে থেকে লাভ কী?

স্থায়ী ঠিকানা বা ভোটাধিকার না থাকলে কী হতে পারে?

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক কার্যক্রম ইত্যাদি অনেক কিছুতেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার (ইংরেজিতে প্রেফারেন্স বা প্রায়োরিটি) দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বা পরিবেশ এমন যে, বেঁচে থাকার নিমিত্তেই বাঙালি জনগোষ্ঠীকে অনেকাংশেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দয়া বা উদারতার ওপর নির্ভর করতে হবে। দয়া ও উদারতার বিপরীত শব্দ হলো যথাক্রমে নির্দয়তা বা নির্মমতা এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। এই অনুচ্ছেদের এই অংশে আমরা কল্পনা করি যে, কয়েকটি বাঙালি পরিবার একটি গ্রামে থাকে। তাদের নিজের কোনো জায়গাজমি নেই। কারণ বিতর্কিত পন্থা ও পদ্ধতিতে তাদের মালিকানা হরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে বা তাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি খুঁজতে গিয়ে বা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করতে গিয়ে হেনস্তা হচ্ছে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছে। স্থায়ী ঠিকানাবিহীন হেনস্তার শিকার এই পরিবারগুলো কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে? যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে, তারা সিদ্ধান্ত নেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাওয়ার। কেউ তো তাদের জোর করে গলাধাক্কা দিয়ে তাদের গ্রাম থেকে তথা পার্বত্য জেলা থেকে বের করে দিচ্ছে না; তারা পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার হয়েই চলে যাচ্ছে। সম্মানিত পাঠক, আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে আজ ২০১৬ সালের এই আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এসে দাঁড়িয়েছি। এ জন্যই বিষয়টির অবতারণা করা হলো। আপনাদের মনে অতি ন্যায়সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাঙালিরা ওখানে গেলই বা কখন আর তাদের ওখানে থাকতে দিতেই বা চায় না কারা? অথবা, কেনই বা থাকতে দিতে চায় না; এতে কার কী লাভ বা ক্ষতি? আরেকটু পেছনের দিকে গেলে প্রশ্নটি দাঁড়াবে, ‘শান্তিবাহিনী’ নামের সংগঠন আসলে কেন বিদ্রোহ করেছিল; তারা কী চেয়েছিল, তারা কী চায়, তারা ইতোমধ্যে কী পেয়েছে? তাদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে বাঙালিদের ওখানে থাকা বা না থাকার কী সম্পর্ক? এসব ন্যায়সঙ্গত জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়া প্রয়োজন। যেহেতু পত্রিকার কলামের পরিসর সীমিত, সেহেতু উত্তর অতি সংক্ষেপেই দিতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সঙ্কটের কারণ

এ প্রসঙ্গে সঠিক ইতিহাস জানতে হলে একাধিক আঙ্গিক থেকে লেখা পুস্তক পড়া উচিত; কিন্তু এটা অনেকের জন্যই বাস্তবসম্মত হয়ে ওঠে না। এই কলামের ওপরের অংশে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়ন নামক যে পুস্তকটির উল্লেখ করেছি সেটিতে সততার সাথে শান্তিবাহিনী ও তাদের দাবি-দাওয়ার প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। কাপ্তাই লেক সৃষ্টি হওয়ার কারণে হাজার হাজার উপজাতীয় পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যার কারণে একটি সাধারণ বিক্ষুব্ধতা ওই অঞ্চলের মানুষের মনে ছিল। দ্বিতীয় একটি কারণ হলো, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকার ফলে কিছু নেতিবাচক সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল; এটিও তাদের মনকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। তৃতীয় একটি কারণÑ বাংলাদেশের ১৯৭২-এর সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে অস্বীকার করেছিল; ১৯৭৩ সালে সরকারপ্রধানের মৌখিক ঘোষণায় এই অস্বীকৃতি শক্তিশালী হয়েছিল; এ কারণে তারা বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। চতুর্থ আরেকটি কারণ; ১৯৬০-এর দশকে উপজাতীয় জনগণের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তৃত হয়েছিল; বামপন্থী রাজনীতি তাদের মনকে আক্রান্ত করেছিল এবং পার্বত্য বামপন্থীরা তাদের অঞ্চলের সামন্তবাদী (ইংরেজি পরিভাষায় : ফিউডাল) সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চাচ্ছিলেন। পৃথিবীব্যাপী তখন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার প্রবণতা ছিল। আশা করি, এ আলোচনাটির পরবর্তী অংশ আগামী কিস্তিতে, শনিবার ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ পাঠক পড়বেন।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

Exit mobile version