শান্তিচুক্তিতে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা

জাতিগত বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে পার্বত্য উপদেষ্টাকে হুঁশিয়ারি

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমাকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, জাতিগত বৈষম্যকে উস্কে দেয়া এবং পার্বত্য অঞ্চলকে গড়ার নামে স্বজনপ্রীতি, ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের নীল নকশাকে রুখে দেবে ছাত্র-জনতা।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা জানান, সুপ্রদীপ চাকমার বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক কুটচাল চলমান থাকলে খুব শিগগির পার্বত্য অঞ্চল অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে পার্বত্য ইস্যুতে গত ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো স্বৈরচারী মনোভাব পরিহার করে বাঙালিসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যহীন প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতিতে মানববন্ধনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা এসব কথা জানান।

মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা জানান, পাবর্ত্য চট্টগ্রামের সকল বৈষম্য দূরীকরণে জন্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সাথে বাংলাদেশ সরকারের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, সেখানে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠিকে প্রায় ১০০ ভাগ উপেক্ষা করা হয়।

জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রায় সকল পদগুলো ১৩টি ক্ষুদু নৃ-গোষ্ঠী/উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। পদগুলো হলে:-

১৩টি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত হলেও সকল প্রকার সুযোগ সুবিধার ৮০ ভাগের বেশি চাকমা সম্প্রদায় জোর জবরদস্তিভাবে ভোগ করে বাকি ১২টি সম্প্রদায় এবং বাঙালিদের প্রায় শতভাগ উপেক্ষা করে যাচ্ছে।

সম্প্রতি তিন জেলা পরিষদ (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান) পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। এদিকে সমতলের ৬১ জেলা পরিষদের কার্যক্রমের মতো পার্বত্য তিন জেলার কার্যক্রম এক নয়। পার্বত্য জেলা পরিষদই জনগণের সাথে ২৪টি প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ নিয়োগ এবং কাজ/সেবায় তদারকি জেলাপরিষদে ন্যাস্ত থাকে।

জেলা পরিষদের অধীনস্থ বিভাগগুলোর তালিকা:-

১. স্বাস্থ্য বিভাগ, ২. যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, ৩. প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ, ৪. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ৫. পর্যটন কর্পোরেশন, ৬. মৎস্য অধিদপ্তর, ৭. পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ৮. সমাজ সেবা অধিদপ্তর, ৯. প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর, ১০. তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ১১. সমবায় অধিদপ্তর, ১২. বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন, ১৩. জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ১৪. বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, ১৫. হর্টিকালচার বিভাগ, ১৬. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, খাগড়াছড়ি, ১৭. বাজারফান্ড প্রশাসন, ১৮. শিল্পকলা একাডেমি, ১৯. স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ২০. সরকারি শিশু সদন, ২১. জেলা ক্রীড়া অফিস, ২২. মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ২৩. রামগড় মৎস্য হ্যাচারি ও ২৪. জেলা গণগ্রন্থাগার।

এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে সম্পৃক্ত জেলা পরিষদে গত প্রায় ৩৫ বছর নির্বাচন হচ্ছে না। জেলা পরিষদ আইনে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী আলাদা ভোটার তালিকায় নির্বাচন করার বিধান থাকায় জেলা পরিষদে নির্বাচন করা যাচ্ছে না। এ অজুহাতে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদটি উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং সদস্যদের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার অনুপাতে বাঙ্গালীদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি। তাই, পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ সকল সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে জেলার জনসংখ্যা অনুপাতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণের লক্ষ্যে আইন সংশোধন দরকার। অথবা প্রচলিত ভোটার তালিকায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার। এতে করে কেউ আর কথা বলার সুযোগ পাবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যে-কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে, জনগণের ভোটে যিনি বিজয়ী হবেন তিনিই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। অন্যথা যে সরকার দেশ পরিচালনায় আসবে, তিনি তাঁর অনুসারিদের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পুরো জেলা নিয়ন্ত্রণ করবে।

ভূমি নিয়ে বৈষম্য

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে উপজাতীয় প্রতিনিধিদের (১। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা তাহাঁর প্রতিনিধি ২। সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ৩। সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ) ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার বা তাঁর মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নিয়ে গঠিত।

এখানে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙ্গালীদের কোন প্রতিনিধি নেই। তাই, এ কমিশনে বাঙ্গালীদের ভূমির ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য তিন পার্বত্য জেলা হতে অন্তত তিনজন বাঙ্গালী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার বিধান প্রণয়ন প্রয়োজন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী ও উপজাতী জনসংখ্যার অনুপাত

২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী- বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীর অনুপাত ৫১ শতাংশ যেখানে খাগড়াছড়িতে ৫১.০৮ শতাংশ, রাঙ্গামাটিতে ৪২.৪২ শতাংশ ও বান্দরবানে ৫৮.৮৫ শতাংশ এবং অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীদের অনুপাত ৪৯ শতাংশ যেখানে খাগড়াছড়িতে ৪৮.৯২ শতাংশ, রাঙ্গামাটিতে ৫৭.৫৮ শতাংশ ও বান্দরবানে ৪১.১৫ শতাংশ বাঙ্গালী ও উপজাতির জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান হলেও জেলা পরিষদের অধীনস্থ সকল বিভাগে ও অন্যান্য প্রায় সকল নিয়োগে বাঙ্গালীদের মাত্র ৩০ শতাংশ নিয়োগ করা হচ্ছে, বিপরীতে ৭০ শতাংশ নিয়োগ করা হচ্ছে উপজাতীদের মধ্য থেকে।

এদিকে উপজাতি ৭০ শতাংশ বিভাজন হয় এভাবে চাকমা ৩০ শতাংশ, মারমা ২০ শতাংশ, ত্রিপুরা ২০ শতাংশ। এখানেও কি বৈষম্য নেই? প্রশ্ন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষাথীরা।

২০০২ থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বাঙ্গালীদের ৪৮ শতাংশ এবং উপজাতিদের ৫২ শতাংশ অনুপাতে নিয়োগ দেওয়া হতো যেটা আওয়ামী সরকার এসে বন্ধ করে দেয়। তাই, সকল প্রকার নিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় জনসংখ্যা অনুপাতে প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রয়োজন।

এদিকে আয়করেও আছে বৈষম্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী/ঠিকাদারদের মধ্যে উপজাতীয়দের কোন আয়কর দিতে হয়না। এক্ষেত্রে একটি দারুণ বৈষম্য লক্ষণীয় যেখানে সরকার বড় অংকের রাজস্ব হারিয়ে ফেলছে।

সুতরাং উপজাতীয়দের আয়করের আওতায় আনা দরকার অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের জন্য একই সুবিধা প্রদানের বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। নয়তো বাঙ্গালী জাতি বরাবরের মতই পিছিয়ে পড়ছে, পাশাপাশি একটি বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে এখানকার মানুষের মধ্যে একটি কঠিন সমস্যাকে সাদরে লালন-পালন করা হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া এখানে অর্থাৎ ৩ পার্বত্য জেলায় অন্য জেলার কোন ব্যক্তি জায়গা-জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে না। যেখানে উপজাতিরা সমগ্র বাংলাদেশে জমি ক্রয় থেকে শুরু করে চাকরি- ব্যবসা করতে পারে। স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র নিতে উপজাতীয় হেডম্যান, উপজাতীয় ইউপি/পৌর চেয়ারম্যান এবং উপজাতীয় সার্কেল চীফ বাঙ্গালীদের সনদ না দিলে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া যায়না। এ বৈষম্য ঠেকাতে পার্বত্য চট্টগ্রামেও সমতলের ন্যায় এনআইডির মাধ্যমে জায়গা ক্রয়/বিক্রয় করার ব্যবস্থার সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালী ও উপজাতি ভাইবোনদের সহাবস্থান ও ভাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখতে সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করতে সকলে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হওয়া উচিৎ। ব্রিটিশ শাসকরা “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতির মাধ্যমে এ দেশে বৈষম্য তৈরি করে যেটা সম্মিলিতভাবে পরবর্তীতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এসব বৈষম্য দূরীভূত হয়, এবং দেশে সৃষ্টি হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির।

বক্তারা আরো বলেন, এখানে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বৈষম্যের এক সিকিও উল্লেখ করি নাই। বৈষম্যবিরোধী ছাǎ আন্দোলন পরবর্তী দেশের যত বৈষম্য তা যেন আরও বহু গুণে আলোকিত হয়ে সকলের সম্মুখে ধরা দিচ্ছে। তাই সকলের সাথে আমরাও বলতে চাই, এ স্বাধীন বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই। একইসাথে আরও বলি, এক দেশে দুই নীতি থাকতে পারে না। পাহাড়বাসী সকলে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যেতে চাই। কাউকে পেছনে ফেলে রেখে কেউ এগিয়ে যাবে এ ধরণের বৈষম্য যেন পাহাড়ে না থাকে সে উদ্দেশ্যেই দেশবাসীর সাথে সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট অংশকে জানাতে চাই।

বক্তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা যদি পাহাড়ের একটা বিশাল অংশ বাঙালি এবং চাকমা ব্যতীত অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে পূর্বের মতো এখনো সর্বক্ষেত্রে পেছনে ফেলে রাখতে চান, তাহলে কারোরই পরিণতি ভালো হবে না।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য উপদেষ্টা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শান্তিচুক্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন