parbattanews

জুড়াছড়ির রণিকা চাকমার মৃত্যুর কারণ পারিবারিক অবহেলা

রাঙামাটির জুড়াছড়ি উপজেলার অজ্ঞানছড়া গ্রামের প্রসুতি নারী রণিকা চাকমার মৃত্যুর কারণ পারিবারিক অবহেলা। পার্বত্যনিউজের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত এ মৃত্যু নিয়ে পার্বত্যনিউজ নিহতের সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলে তথ্য নিশ্চিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ২৪ এপ্রিল সকালে রাঙামাটি জেলা সদরের এলায়েন্স হেলথ কেয়ার সেন্টারে মারা যায় রণিকা চাকমা। তার মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে অভিযোগ তোলা হয়, রণিকার মৃত্যুর কারণ রাঙামাটির বরকল উপজেলার সুভলং সেনা নিরাপত্তা ক্যাম্পে চেকিংয়ের কারণে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ। একটি বিশেষ শ্রেণীর আইডি থেকে এই বিষয়টি নিয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার চালানো হয়।

বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনা করে পার্বত্যনিউজ অনুসন্ধান চালায়।

রাঙামাটি জেলার জুড়াছড়ি উপজেলার ২ নং বনযোগী ছড়া ইউনিয়নের বহেরাছড়ি গ্রামের দরিদ্র কৃষক প্রেমরঞ্জন চাকমা(৪৬)। তার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে রণিকা চাকমার(২২) বিয়ে হয়েছে একই জেলার বরকল উপজেলার অজ্ঞানছড়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক সবিরণ চামকার(২৫) সাথে। রণিকা চাকমা সন্তান সম্ভবা হলে পিতার বাড়ি জুড়াছড়িতে চলে আসে।

প্রেমরঞ্জন চাকমা মেয়ের শারিরীক কিছু সমস্যা দেখা দিলে  গত ৪ এপ্রিল জুড়াছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।

জুড়াছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার কামরুজ্জামান জুয়েল পার্বত্যনিউজকে বলেন, রণিকা চাকমা হাসপাতালে আসার পর তার বিবরণ শুনে দেখা যায়, দুই সপ্তাহ আগেই তার ডেলিভারির ডেট পার হয়ে গেছে। তাই তাকে দ্রুত রাঙামাটি জেলা সদর হাসপাতালে গিয়ে ভর্তির পরামর্শ দেন অত্র হাসপাতালের  ডা. সাইদ আবেদিন।

জুড়াছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. সাইদ আবেদিন পার্বত্যনিউজকে বলেন, রণিকা চাকমা ভর্তি হওয়ার পর তার বিবরণ শুনে আমরা দেখতে পাই তার ডেলিভারী ডেট ছিলো ২৩ মার্চ। তিনি আরো বলেন, পরীক্ষা করে রোগীর ব্লাড প্রেসারের সমস্যা ধরা পড়ে এবং এবং বাচ্চার হার্টবিটও কম পাওয়া যাচ্ছিল।

এ অবস্থায় রোগীর সিজার করা প্রয়োজন হলেও এ ধরণের জটিল রোগীর সিজার করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এ হাসপাতালে না থাকায় আমরা দ্রুত রোগীকে রাঙামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিই। এরপর তারা চলে যান এবং আমাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি।

রণিকা চাকমার পিতা প্রেম রঞ্জন চাকমা পার্বত্যনিউজকে বলেন, জুড়াছড়ির ডাক্তার আলট্রা সনোগ্রাম করার জন্য বলেছিল রাঙামাটি থেকে। আমি গরীব মানুষ তাই যাইনি।

তিনি বলেন, ২৩ এপ্রিল বিকাল ৩ টায় মেয়েটির প্রসবজনিত ব্যথা ওঠে। এরপর তিনি সামাজিক ধাত্রী এনে ডেলিভারি করার চেষ্টা করেন। ধাত্রী রাত দেড়টার দিকে ধাত্রী বলেন, তিনি আর পারছেন না। রোগীকে দ্রুত রাঙামাটি নিতে বলেন। এরপর আমরা রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে মেয়েকে আমরা হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করি।

এরপর ট্রলারে করে আমরা ভোর আনুমানিক চারটার দিকে সুভলং ক্যাম্পে পৌঁছাই। ক্যাম্পে যোগাযোগ করলে তারা আমাদের কাছে জানতে চায়, আমাদের উপরে নিয়ে যায় এবং বলে এতো লোক যাওয়ার দরকার কি? আমাদের বোটে ৮জন লোক ছিলো। আমরা ৩জনকে ওখানে নামিয়ে রেখে আনুমোদন নিয়ে রওনা দেই। এরপর ভোরে আমরা রাঙামাটি সদর হাসপাতালে পৌঁছায়। তখনও মেয়েটা মারা যায় নাই। এরপর হাসপাতালের ডাক্তার এসে মেয়েকে দেখে। তারপর তারা বলে মেয়েটি মারা গেছে।

সুভলং ক্যাম্পে কতক্ষণ দেরি হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে প্রেম রঞ্জন চাকমা বলেন, আমার কাছে ঘড়ি ছিলো না। তাছাড়া মেয়ের ওমন অবস্থায় আমি তখন শুধু কানতেছিলাম। তাই সঠিক সময় আমি বলতে পারবো না। তবে আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ মিনিট হতে পারে।

এদিকে স্থানীয় বনযোগী ছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তোষ বিকাশ চাকমা পার্বত্যনিউজকে বলেন, আমি শুনেছি, মেয়েটার তিনটার দিকে পেইন ওঠে। এরপর তারা স্থানীয় ওঝার মাধ্যমে ডেলিভারির চেষ্টা করে। কিন্তু বিকাল ৫টার দিকে অবস্থা আরো খারাপ হলে তারা স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসককে ডেকে নিয়ে আসে। তিনি এসে একটি স্যালাইন দিয়ে যায়। এরপর রাত ৯ টার দিকে আরো পরিস্থিতি খারাপ হলে আরেকজন পল্লী চিকিৎসকে ডেকে আনে।

সেও আরেকটি স্যালাইন দিয়ে চলে যায়। কিন্তু রাত তিনটার দিকে ওঝা তাদেরকে হাসপাতালে নিতে বলে। তারা রাত ৪টার দিকে আমাকে ফোন দিলে আমি দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেই। মেয়েটির বাবা আমাকে ক্যাম্পে বলে দিতে বললে আমি বলে দেবো বলে জানাই।

এখন কাপ্তাই লেক শুকিয়ে যাওয়ায় অন্তত ৫ কি.মি. দুরে গিয়ে বোটের কাছে যায় এবং বোট মালিককে ডেকে এনে রওনা দেয়। লেক শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে যাতায়াতে অনেক সময় লাগে। বিভিন্নস্থানে নেমে বোট ঠেলে দিতে হয়। এতে সময় বেশী লেগে যায়।

এরপর মেয়েটি বাবা ক্যাম্পে গিয়ে আমাকে ফোন করে। আমি ক্যাম্পে বলে দিই। ১৫-২০ মিনিট পর আমি আবার মেয়েটির বাবাকে ফোন দিলে তারা বলে, তারা ক্যাম্প থেকে রওনা দিয়েছে। পরে তাদের বোট আবার খারাপ হয়ে যায়। তখন আরেকটি বোট এনে সেটাকে টেনে নিয়ে যায়। সকালে তারা হাসপাতালে পৌছাঁয়। মূলত পরিবারের অসচেতনতা ও অবহেলার কারণেই এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক ও জুড়াছড়ি বাজার কমিটির সভাপতি ডা. তপন কান্তি দে পার্বত্যনিউজকে বলেন, ২৪ তারিখ রাত দুইটার দিকে মেয়েটির বাবা আমাকে ফোন দিয়েছিল, ক্যাম্পে বলে দেয়ার জন্য। তারা আরো পরে রওনা দেয়। পানি শুকিয়ে যাওয়ার কাছে বেশ কিছুদুর সড়কপথে গিয়ে বোটে উঠতে হয়েছে। ওই রাতে বোট চালকও থাকে না। তাকেও ডেকে আনতে হয়েছে। একটি বার্মিজ বোটে ৮জন গিয়েছিল। এমনিতেই নিরাপত্তার কারণে শুভলং চেকিং হয়।

তারপর এই করোনা মহামারীর সময়ে চলাচলে আরো বিধি নিষেধাজ্ঞা কড়াকড়ি করা হয়েছে। তারা ওখানে চেকিংয়ে সম্ভবত ১০-১৫ মিনিট সময় নেয়। এতোগুলো লোক অসুস্থ রোগী নিয়ে যাবে কেন? করোনা রোগী কিনা নিশ্চিত না হয়ে ছাড়লে তাদের তো দায় নিতে হতো। এরপর রাঙামাটির কাছাকাছি গিয়ে তাদের বোটের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। আরেকটি বোট চালককে বাড়ি থেকে ডেকে এনে তারপর সেটাতে করে তারা সদরে পৌঁছায় এবং সদর হাসপাতালে ভর্তি না করে এলায়েন্স ক্লিনিকে ভর্তি করে।

তপন কান্তি পার্বত্যনিউজকে আরো বলেন, এটি মূলত পরিবারের অবহেলার কারণেই ঘটেছে। যদিও একটি মহল এ ঘটনাকে সেনাবাহিনীর উপর দায় চাপিয়ে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু আমি এখানে সেনাবাহিনীর কোনো দোষ দেখি না।

কারা দায় চাপাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তপন কান্তি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি তো আপনারা জানেন। এখানে রাজনৈতিক কারণে একটি মহল সবসময় সেনাবাহিনীকে দোষারোপ ও বিতর্কিত করার চেষ্টা করে।

এলায়েন্স হেলথ ক্লিনিকে রণিকা চাকমাকে রিসিভ করেন ডা. অনির্বান চাকমা। তিনি পার্বত্যনিউজকে বলেন, ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে প্রসবজনিত সমস্যা নিয়ে রণিকা চাকমা নামে একটি রোগী আমি রিসিভ করি। তার ডেলিভারি ডেট একমাস আগেই পার হয়ে গিয়েছিল।

এখানে আসার আগে স্থানীয় বৈদ্য দিয়ে তারা ডেলিভারী করার চেষ্টা করে। বাচ্চাটা সম্ভবত সেখানেই মারা গিয়েছিল। মেয়েটার বাচ্চার থলিতে সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। আমরা রোগীটি রিসিভ করার পর পরীক্ষা করে বাচ্চা ও মাকে মৃত পাই।

শুভলং  আর্মি চেকপোস্ট রাঙামাটি সদর জোনের আওতাধীন। জোন কমাণ্ডার লে. কর্নেল মো. রফিকুল ইসলাম পার্বত্যনিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করেছি। ক্যাম্পে যা ঘটেছে তার সকল প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করেছি। নিরাপত্তার কারণে এমনিতেই ওই এলাকা নিয়ে ভোর ৬টার আগে সকল প্রকার যাতায়াত নিষিদ্ধ। তবুও আমরা রোগী বা কোনো ইমার্জেন্সী কেস থাকলে আমরা বিশেষ বিবেচনায় অনুমতি দেই।

রাতে নিরাপত্তার কারণে আমাদের চেক পয়েন্ট ঘাট থেকে একটু উপরে থাকে। মেয়েটির পরিবার ঘাটে পৌঁছে উপরে উঠে টহল সৈনিককে জানালে তিনি তার উর্দ্ধতন কমান্ডারকে অবহিত করেন। আমরা মোবাইল ও ওয়াকিটকির সকল কল পর্যালোচনা করে দেখেছি, ক্যাম্পে তাদের সর্বোচ্চ ১৭ মিনিট দেরি হয়েছিল। ক্যাম্প থেকে বের হয়ে রাঙামাটির কাছে এলে বোটের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। ফলে তারা আরেকটি বোট চালককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তার সহায়তায় রাঙামাটি পৌঁছায়।

জোন কমান্ডার আরো বলেন, তাদের কেউ যদি আমাদের আগে থেকে অবগত করতো প্রয়োজনে আমরা আমাদের স্পিড বোট দিয়ে নিয়ে আসতাম। ডাক্তার, হাসপাতাল রেডি রাখতাম। আমরা তো অনেক উপজাতীয় প্রসুতি নারীকে হেলিকপ্টার সাপোর্ট দিয়েও নিয়ে এসেছি। তাদের জন্য আমরা তৃণমূল পর্যায়ে মেডিকেল ক্যাম্প করি। কাজেই আমরা পূর্ব থেকে অবগত থাকলে হয়তো এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেতো।

ক্যাম্পে দেরির জন্য আপনার মেয়ে মারা গিয়েছে এমন মনে করেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রণিকা চাকমার বাবা প্রেমরঞ্জন চাকমা পার্বত্যনিউজকে বলেন, এমন কথা আমি বলতে পারবো না। কিভাবে এ কথা বলি। আমি গরীব মানুষ। আমি নিজেও তো অনেক দেরি করেছি। ঠিকমতো ডাক্তার দেখাতে পারি নাই। আমি মনে করি, আমার মেয়ের ভাগ্যে এভাবেই মৃত্যু লেখা ছিলো।

Exit mobile version