লিবিয়ায় জিম্মি ছেলের আকুতি

‘টাকা পাঠিয়ে তুমি আমার জান ভিক্ষা দাও মা, আর সহ্য করতে পারছি না’

fec-image

‘মা তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি বের কর। না হলে এরা (মাফিয়া) আমাকে মেরে ফেলবে। ১৪ লাখ টাকায় ভিটেমাটি বিক্রি করে হলেও টাকা দাও। টাকা পাঠিয়ে তুমি আমার জান ভিক্ষা দাও মা। আমি এদের মারধর আর সহ্য করতে পারছি না। গোটা শরীরে ঘা হয়ে গেছে।’

লিবিয়ায় মাফিয়াদের কাছে জিম্মি ওয়াসিম আলীর মা পেমেলা বিবি বুধবার রাজশাহী কোর্টে কান্না জড়িত কণ্ঠে ছেলের এই কথাগুলো বলছিলেন। ওয়াসিম রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ৫ নম্বর ঝালুকা ইউনিয়নের সায়বাড় গ্রামের আব্দুর সাত্তারের ছেলে।

ওয়াসিম দেড় বছর আগে লিবিয়া যান। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বুধবার ওয়াসিমের মামা আব্দুল জলিল ওয়াসিমের চাচাতো ভাই ইসমাইল ও তার পরিবারের নামে রাজশাহী কোর্টে অভিযোগ দেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ওয়াসিম আলী দেড় বছর আগে লিবিয়ায় যান। এরপর তাকে ইতালিতে পাঠানোর কথা বলেন তার চাচাতো ভাই ইসমাইল। এরপর স্থানীয় হাসপাতালে কাজ বাদ দিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য ইসমাইলের পাঠানো গাড়িতে উঠেন ওয়াসিম। এর ১৫ দিন পর ওয়াসিমের বাড়িতে খবর আসে ওয়াসিম মাফিয়াদের হাতে জিম্মি হয়েছেন। তাকে ছাড়াতে ১৪ লাখ টাকা দাবি করেন তারা। এরপর মাফিয়াদের ৮ লাখ টাকা দিলেও তারা তাকে মুক্তি দেয়নি। ইসমাইল আগে থেকেই লিবিয়াতে থাকতেন।

ওয়াসিম আলীর মা পেমেলা বিবি বলেন, এ ঘটনার আগে ইসমাইল একদিন ফোন করে আমাকে বলেন, সে ওয়াসিমকে ইতালি পাঠাতে পারবেন। সেখানে অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। ইনকামও অনেক বেশি। এরপর আমার কাছে কিছু টাকা চান। এর কিছুদিন পর জানতে পারি আমার ছেলেকে মাফিয়ারা লিবিয়ায় জিম্মি করেছে।

তিনি আরও বলেন, এরপর ছেলের মুক্তির জন্য তারা ফোনে আমার কাছে ১৪ লাখ টাকা দাবি করে। আমরা গরিব মানুষ টাকা এতো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। টাকা দিতে না পারায় ছেলের উপর তারা নির্মম নির্যাতন চালায়। ছেলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমি ঢাকায় হোটেলের কাজ ছেড়ে রাজশাহীর বাড়িতে চলে আসি। তারা বলেছে, টাকা না পাঠালে আমার ছেলেকে মেরে ফেলবে।

কান্না জড়িত কণ্ঠে পেমেলা বিবি আরও বলেন, পাঁচ মাসের বেশি হয়ে গেল। আজও ছেলেকে মুক্ত করতে পারিনি। ইসমাইলের বাবা-মায়ের হাত পা ধরেছি। কোনো কাজ হয়নি। আমি সরকারের কাছে দাবি জানায়, ছেলেকে সুস্থভাবে আমার বুকে ফিরিয়ে দিক।

ওয়াসিমের মামা আব্দুল জলিল বলেন, ওয়াসিম আর ইসমাইল সম্পর্কে চাচাতো ভাই। ওয়াসিমকে লিবিয়ার নিয়ে যাওয়ার শুরু থেকে ইসমাইল আছে। তার ভরসায় ওয়াসিম লিবিয়ায় যায়। লিবিয়ায় ওয়াসিম একটা হাসপাতালে কাজ করত। এমন অবস্থায় ইসমাইল বার বার ওয়াসিমকে ফোন করে বলে তোমাকে লিবিয়ায় থাকতে হবে না। তোমাকে ইতালিতে পাঠাবো। সেখানে ভালো টাকা উপার্জন করতে পারবা। দীর্ঘদিন ফোন দিয়ে রাজি করে ওয়াসিমকে।

তিনি আরও বলেন, একদিন ওয়াসিমকে নিতে ইসমাইল গাড়ি পাঠায়। সেই গাড়িতে যাওয়ার পর ওয়াসিম নিখোঁজ হয়। এ ঘটনার ১৫ দিন পরে জানতে পারি মাফিয়ারা তাকে আটক করেছে। তাদের হাত থেকে ওয়াসিমকে ছাড়াতে জায়গা জমি বিক্রি করে সবমিলে ৮ লাখ টাকা দেই। কিছু টাকা ইসমাইলের মা ও ভাই নিয়ে গেছে। গত কয়েকদিন আগে ভিডিও কলে ওয়াসিমকে মারধরের ভিডিও দেখানো হয়। আমরা কোর্টে ইসমাইলের মা-বাবা ও তার নামে অভিযোগ দিয়েছি। তাদের আদালতে হাজির হওয়ার তারিখ ছিল গত মঙ্গলবার। কিন্তু তারা হাজির হননি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে সায়বাড় গ্রামের মোস্তফার ছেলে ইসমাইলের বিরুদ্ধে। তার মাধ্যমে এলাকার ও আশেপাশের যারা লিবিয়ায় গেছে তারাও সেখানে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়।

দুর্গাপুর উপজেলার ঝালুকা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুল আওয়াল মোল্লা বলেন, মাফিয়ারা তাদের ওয়াসিমের পরিবারের কাছে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ চান। এরপর ৩ লাখ টাকা পাঠানোর সময় আমি সঙ্গে ছিলাম। পরবর্তীতে আর কোনো টাকা দেওয়া হয়েছে কিনা তা আমি জানি না।

এ বিষয়ে জানতে দুর্গাপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলামকে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপরাধ, অপহরণ, আমি প্রবাসী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন