টুর্নামেন্ট-সেরা হবেন, ভাবেননি রাঙামাটির মেয়ে ঋতুপর্ণা চাকমা
প্রথম দুটি পুরস্কার ঘোষণা শেষে তৃতীয়টির আগে একটু থামলেন নেপালের উপস্থাপক। মাঠে উপস্থিত দর্শকদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘বলুন তো, এবারের সাফের সেরা খেলোয়াড় কে?’
দর্শকদের মধ্য থেকে দু-তিনটি নাম এল। বাংলাদেশ শিবির থেকেও আসে দু-একজনের কথা, যাঁদের মধ্যে আছেন ঋতুপর্ণা চাকমাও। শেষ পর্যন্ত ঋতুর নামই ঘোষণা করা হলো। নিজের নাম শুনে রাঙামাটির মেয়ের যেন বিশ্বাসই হতে চাইছিল না। মুখ ঢেকে আনন্দ প্রকাশ করে যেতে হলো মঞ্চে সপ্তম নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিতে।
গত সাফের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন সাবিনা খাতুন। ৮ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন বাংলাদেশ অধিনায়ক। এবার সাবিনার গোল ২টি। ভুটানের বিপক্ষে ৭-১ গোলের জয়ে ওই ২টি গোল করেন সাবিনা। নিজে এবার সেভাবে গোল করতে না পারলেও সাবিনার মনে আর কোনো দুঃখ নেই।
ফাইনালের আগে সাবিনা খাতুন বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স এখানে বড় নয়। আমি মাত্র দুটি গোল করেছি, তাতেও আক্ষেপ করার কিছু দেখছি না। মেয়েরা ভালো খেলছে, এটাই তো আনন্দের।’
সাবিনার সেই আনন্দ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন ঋতুপর্ণা, ফাইনালে যাঁর জয়সূচক গোলে সাফ শিরোপা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার হাতে নিয়ে ঋতুপর্ণা নিজেই অবাক।
ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের পর ঋতুপর্ণা বলেছিলেন, ‘আমার কপালে গোল জোটে না।’ সেই তিনি ফাইনালের অনেকটা আলো কেড়ে হেসে বললেন, ‘আমি ভাবতেই পারিনি, টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কার পেয়ে যাব। দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তাতে আমি অবদান রাখতে পেরে এমনিতেই ভালো লাগছে। সেই ভালো লাগা বলতে পারেন অনেকটা বেড়ে গেছে টুর্নামেন্ট–সেরা হয়ে।’
পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ৫০ হাজার রুপির চেক। কী করবেন এই টাকা? ঋতুপর্ণার মুখে আবারও লাজুক হাসি, ‘এই টাকা দিয়ে টিমমেটদের খাওয়াব আর মায়ের জন্য কিছু নেব।’
বাংলাদেশের আতক্রমণভাগে বাঁ প্রান্তে খেলেন ঋতুপর্ণা। তাঁর বাঁ পায়ের কাজও দারুণ। দুর্দান্ত সব ক্রস করেন। মূলত আক্রমণে বড় ভূমিকা রেখেই তিনি চোখ কেড়েছেন বিচারকদের।
চোখ কেড়েছেন রুপনা চাকমাও। গতবারের মতো এবারও তিনি সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা গোলকিপার। পোস্টের নিচে ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। রুপনার বিপক্ষে গোল হয়েছে ৪ ম্যাচে ৪টি। প্রতি ম্যাচেই একটি করে গোল। তারপরও দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে তাঁর কিছু সেভ বড় ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে পুরস্কারটা পেয়েছেন রুপনা।
সেই পুরস্কার হাতে নিয়ে রুপনা বলেন, ‘আমরা ঢাকা থেকে এসেছিলাম শিরোপা ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়ে। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছি। এটাই আসলে বড় প্রাপ্তির।’
ঋতুপর্ণার মতো সেরার ট্রফি নিয়ে একের পর এক সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে রুপনাকেও। অন্যরাও ছিলেন ব্যস্ত। এই রাত যে শুধু নিজেদের ভালো লাগা প্রকাশ করারই। তবে দিনটাতে যে খানিক স্নায়ুচাপে ভুগতে হয়েছে, সেটি বলতে ভোলেননি শিউলি আজিম, ‘ম্যাচ হয়েছে সন্ধ্যায়। দুপুরে আসলে ভালোভাবে খেতেও পারিনি। ম্যাচে কী হয়, সেটা নিয়ে ভাবছিলাম আমরা সবাই।’
টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৫ গোল করেন স্ট্রাইকার তহুরা খাতুন। ভুটানের বিপক্ষে সেমিতে হ্যাটট্রিকের আগে ভারতের সঙ্গে গ্রুপ ম্যাচে তাঁর ২ গোল। ফাইনালেও চেষ্টা করেছেন, কিন্তু গোল পাননি। তাতে তাঁর কোনো হতাশা নেই। বরং মুখে উজ্জ্বল হাসি, ‘ফাইনাল জিততে হলে জানবাজি লড়াই করতে হবে, এটা আমরা জানতাম। সেভাবেই খেলেছি। এই আনন্দ আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’
ভাষাহীন হয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের সবাই। কীভাবে গুছিয়ে প্রতিক্রিয়া দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না অনেকে। মিডফিল্ডার মারিয়া যেমন বললেন, ‘কী বলব…নেপালকে তাদেরই মাঠে হারানো কঠিন। গতবারও আমরা জিতেছি, এবারও একই ফল। আমরা যে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে একটা শক্তি হয়ে উঠেছি, তা আবারও প্রমাণিত হলো।’
গত কিছুদিনে দলের মধ্যে নানা ঘটনা ঘটেছে। কোট পিটার বাটলারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সিনিয়রদের। কাঠমান্ডুতে এসে পাকিস্তান ম্যাচের পর মিডফিল্ডার মনিকা চাকমা বলেছিলেন, কোচ সিনিয়রদের পছন্দ করেন না। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের তত্ত্ব ছড়ায়। সবকিছু একপাশে রেখে চ্যাম্পিয়ন হয়ে অধিনায়ক সাবিনা খাতুন নিজের কাজটা করেছেন দারুণভাবে।
এক ফাঁকে বললেন, ‘মেয়েদের মধ্যে জয়ের যে অদম্য ক্ষুধা, সেটাই আসলে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে সাহায্য করেছে।’
সূত্র: প্রথমআলো