parbattanews

টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে স্বজন হারা রোহিঙ্গাদের আহাজারি

টেকনাফ প্রতিনিধি:

মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে প্রাণে বাঁচতে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে কক্সবাজারের উখিয়া-ঘুমধুম ও টেকনাফে সীমান্তে। নৌকায় করে পালাতে গিয়ে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী তোলাই এ দূঘর্টনা ঘটছে। নিখোঁজ হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষ। ভেসে আসছে নিখোঁজদের মৃতদেহ। স্বজন হারা রোহিঙ্গাদের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সমুদ্রসৈকতে আহাজারি ও কান্নাররোল পড়েছে।

বৃহস্পতিবার ভোররাতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের তুলাতুলী ঘাটের সমুদ্র সৈকত এলাকায় রোহিঙ্গাদের বহন করা ১টি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ১১জনের লাশ উদ্ধার করার খবর পাওয়া গেছে। প্রাণ বাঁচাতে অতি ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকায় করে পরিবারের সাত সদস্যের সঙ্গে প্রায় ৪০জনের মতো রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশ পালিয়ে আসছিলেন রোহিঙ্গা নারী মদিনা খাতুন। তার সকলের বাড়ি মিয়ানমারে আকিয়াব জেলার রাশিডং থানার সেরেপ্রাং এলাকায়।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পুরো পরিবারকে নিয়ে আর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। নৌকা ডুবিতে তার সঙ্গে সাঁতরিয়ে কূলে উঠতে পেরেছেন মেঝ ছেলে কামাল হোসেন। অন্য সদস্যরা নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন। এমন কি তাদের আর কোন লাশ পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে ছিলেন-স্বামী ইয়াছিন, মেয়ে নুরজাহার, মেঝ মেয়ে ছমুদা, ছোট ছেলে লায়লা ও তার মা আয়েশা এবং মেঝ ছেলে কামাল হোসেন।

তিনি ও মেঝ ছেলে ছাড়া তার পরিবারের পাঁচজনের এখন পর্যন্ত কারো মৃত দেহ পাওয়া যায়নি। পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে হারিয়ে মদিনা খাতুনের আহাজারিতে শুধু স্বামী, ছেলে-মেয়ে ও মা হারানোর কথা বার বার বলছেন। এখন কার আশায় বাংলাদেশে থাকবেন বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন।

সরেজমিনে তুলাতুলী চরে গিয়ে দেখা যায়, সমুদ্র সৈকতের মেরিন ড্রাইভ সড়কে একনারীর বিলাপের ধ্বনি ভেসে আসছে। একটু সামনে যেতেই দেখা গেল পানিতে ভিজা পরনের কাপড়ে ও কয়েকটি শিশুসহ বসে বসে বিলাপ করছেন মদিনা খাতুন। আর বলছেন, এ রকম হবে আগে জানলে মর্গের হাতে সবাইকে নিয়ে গ্রামে থেকে যেতাম। এ কষ্ট আমি এখন রাখব কোথায় ? নৌকা ডুবির ঘটনায় স্বজন হারানোর বেদনায় মিয়ানমারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা জীবিত উদ্ধার লোকজনের আহাজারি থামছে না কিছুতেই।

সৈকতের পাড়ে আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে দুর্ঘটনা কবলিত এলাকা। চোখের কান্নায় অশ্রু যেন থামছে না। শুধু সৈকতে ছুটাছুটি করছে নিখোঁজদের পাওয়ার আশায়। একই এলাকা থেকে পালিয়ে আসা নারী সখিনা খাতুন কোলে ছয় বছরের শিশু ইসমাইল। নৌকা ডুবিতে তার তিন বছরের মেয়ে ইয়াছমিন নিখোঁজ রয়েছে। মেয়ের খোঁজে সমুদ্র সৈকতে ছেলেকে কোলে নিয়ে আহাজারিতে পাগলের মতো কান্নাররোল পড়েছে। কিছুতেই থামছে না তার কান্না।

এই নারী বিলাপ করে বলছেন, এখন কোথায় যাবো, মা বলে ডাকবে কে। গত বছরের অক্টোবর মাসে রাশিডং এলাকায় কাপড়ের ব্যবসা করতে গিয়ে সে দেশের সেনা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর থেকে অদ্যবধি স্বামী ছৈয়দুল্লাহ নিখোঁজ রয়েছে। এরপর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কোন ভাবে সংসার চালিয়ে আসলেও গত আগস্ট মাসে ১১ তারিখের পর থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়াই গত বুধবার রাতে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে পালিয়ে আসার সময় নৌকায় উঠি। কিন্তু সেই নৌকাটি ডুবে গেলে মেয়ে সাহারা খাতুন নিখোঁজ হয়ে পড়েন।

মিয়ানমারের মংনিপাড়া থেকে আসা আরেকটি পরিবারের তিন বোন ও এক ভাই। বোন মনোয়ারা , জমিলা বেগম, আয়েশা বেগম ও মফিজ উল্লাহকে দেখা গেল আহাজারি করতে। তাদের মা সেতারা নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন। তারা তিনবোন ও এক ভাইয়ের আহাজারিতে সৈকত এলাকার আকাশ-বাতাসও কান্নাকাটি করছে। তাদের বাবা শফিক আহমদ দুই বছর আগে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তারা বলেন, যুবতী দুই বোন থাকায় ওই পাড়ে সবসময় সেনা ও নাডালা বাহিনীর ধর্ষণ ও নিয়ার্তন আতঙ্কে ছিলাম কিন্তু এ পাড়ে এসে আহাজারি ও কান্নার রোলে পড়ে গেলাম।

Exit mobile version