ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনে জেন জির মানসিক স্বাস্থ্য
জেন জি তথা জেনারেশন জুমারের নেতৃত্বে জনতার সামিলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নয়া বাংলাদেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশই হলো জেনারেশন জুমার। কিন্তু, দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো, এই প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের তৈরি হয়েছে বেহাল দশা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মতে, মানসিক স্বাস্থ্য এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তি তার ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক চাপের সাথে মোকাবিলা করতে পারে, উৎপাদনশীল এবং ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারে এবং তার নিজের সমাজে অবদান রাখতে পারে। অধিকন্তু, এর বিপরীত হলেই ধরে নিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য ভাল নেই।
জেন জির মানসিক স্বাস্থ্য ভাল না থাকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু উৎপাদক হলো, ক্রমাগত দুঃখ, পারিবারিক দৈন্যতা বা অভাব, একাকিত্বের অনুভূতি, প্রেমে ব্যর্থতা, তরুন-যুবাদের পড়ালেখা শেষে সঠিক সময়ে কাজে প্রবেশ না করা, নেশাদার দ্রব্য গ্রহণ করাসহ প্রভৃতি কারণে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
২০২১ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শহুরে ছেলেমেয়েদের ৬০ শতাংশের বেশি মাঝারি থেকে তীব্র মানসিক চাপে ভোগে। এছাড়া, বেকার যুবক-যুবতিদের ক্যারিয়ার ও চাকরি নিয়ে মানসিক তীব্র চাপ ও অস্থিরতায় ভুগে থাকেন। এর অন্যতম মৌলিক একটি কারণ হলো চাকরি পাওয়া নিয়ে তাদের অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ এর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসেবে দেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ।
এদিকে নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না। এই মানসিক চাপ নিয়েই তারা পড়ালেখা চলমান রাখে।
মানসিক অস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে, আঁচল ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৬৪০ জন পড়ুয়ার ওপর সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য, করোনা–পরবর্তী পড়াশোনার চাপ, হতাশা ও সেশনজটের কারণে মানসিক অবসাদে ভুগছেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭৬ শতাংশ পড়ুয়া। গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। মানসিক অস্বাস্থ্য উৎপাদকের ফলে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার মত মহাপাপকে বেছে নিচ্ছে। আত্ম হত্যার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় প্রায় ৯০ ভাগ মানসিক চাপ ও সমস্যার কারণে হচ্ছে।
২৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালের আঁচল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২৩ সালে ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এদের ভেতর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রয়েছে ৯৮ জন। ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণটি ছিল তা হলো অভিমান। যা সংখ্যায় ১৬৫ জন বা ৩২ দশমিক ২ শতাংশ। এর পরেই প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।
প্রথম আলোর ২ আগস্ট ২০২১ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারজানা রহমানের এক মতামত থেকে জানা যায়, ’৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মাদকাসক্তের ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, মাদকাসক্ত হলে তার মানসিক রোগ ও হতে পারে। যেমন ডিপ্রেশন ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া বা যৌন রোগ ও দেখা যায়।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংশ বিভিন্ন কারণে মাদকের সাথে জড়িয়ে পরছে। মাদকে জড়িয়ে পরার অন্যতম উৎপাদক হলো প্রেম ও হতাশা।
এ প্রসঙ্গে মানবজমিনের ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এর প্রতিবেদন অনুসারে, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, “যুবকদের সাধারণত হতাশা থেকেই মাদকে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বেশি। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনেকে মনের কষ্ট লাঘব হবে মনে করে মাদকাসক্ত হয়ে উঠে। কিন্তু একপর্যায়ে মাদকের প্রেমে পড়ে যায়”। মাদকের মত ভয়াল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের প্রিয় জিন জি প্রজন্ম।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১২ সালের ভেতর যাদের জন্ম তাদের জেনারেশন জুমার বা জেন জি বলা হয়। সাধারণত দেশের মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশই হলো জেনারেশন জেড। বাংলাদেশের সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভিষ্ট অর্জন করতে হলে এই ২৮ শতাংশ জেনজিকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে
দেশে কর্মক্ষমহীন মানুষের তুলনায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যখন বেশি হয় এবং তারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে তখন তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে। ১৫ থেকে ৬৪ বছরের জনসংখ্যা যখন কোন দেশে ৬০ শতাংশের বেশি হয় এবং ১৪ বছরের কম হয় ও ৬৫ বছরের বেশি জনসংখ্যা যখন ৪০ শতাংশের কম হয় তখন সে দেশে জনমিতির লভ্যাংশ চলমান থাকে। দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছরের ভেতর জেন জি মোট ৬২.৭২ শতাংশ। অথচ টেকসই উন্নয়ন এবং জনমিতির লভ্যাংশ অর্জনের বড় একটি সহায়ক শক্তিশালী জেনারেশন জেড মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে।
যেখানে জেনজি একটি শক্তিশালী সরকারকে পর্যন্ত উৎখাত করে ফেলেছে অথচ তাদের বড় অংশের রয়েছে মানসিক অসুস্থতা। এ অংশ ছাড়াও, সামগ্রিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ কোটিরও বেশি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ২০২২ সালের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায়, মানসিক সমস্যা বলতে বোঝানো হয়েছে মানসিক বিভিন্ন রোগ। তবে কিছু মানসিক চাপজনিত সমস্যার উদ্দেশ্যে সেখানে দেখা যায়। এছাড়া, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভ্রান্তি দূরীকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা, আত্মহত্যার ঘটনা কমানো ও ঝুঁকি হ্রাস করা, মাদকাশক্তি মোকাবেলায় জোরদান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব দেওয়াসহ প্রভৃতি উদ্দেশ্য টু দ্যা পয়েন্টে আলোচনা করা হয়েছে। কার্যক্ষেত্র আলোচনায় ই-মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও কার্যত ২ বছর হয়ে গেলেও এর কোন বাস্তবায়ন মাঠ পর্যায়ে দেখা যায়নি।
যদিও বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও বেশ কিছু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরকারিভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার কাউন্সেলিং কেন্দ্র করা হয়েছে। এছাড়া, বেশ কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক কাউন্সেলিং সেবার সুযোগ রয়েছে। তবে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হল, যে সকল রোগী মানসিক সমস্যায় ভুগছে তার সিংহভাগই এর চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন নয়। অথচ, মেডিক্যাল সায়েন্স বলছে, মানসিক চাপ শুধু মনের উপরই প্রভাব ফেলে না। বরং শরীরের বিভিন্ন অংশকেও প্রভাবিত করে।
মানসিক চাপের ফলে মানসিক অস্থিরতা, অবসাদ, মেজাজ খিটখিটের পাশাপাশি পেশির দুর্বলতা, ক্লান্তি, মাথা যন্ত্রণা কিংবা অনিদ্রার মত শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ এবং স্ট্রোক-সহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সুবাদে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিকিৎসক ও নন চিকিৎসকদের ভিডিয়ো সহজলভ্য হলেও বাস্তবিক অর্থে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই অনেক সময় মানসিক অবসাদ ও অসুস্থতার উৎপাদক হিসেবে কাজ করছে।
সরকার এবং সকল মহল একযোগে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনে জেনারেশন জুমারকে সচেতনতার নোট দিতে হবে। এজন্য সরকার মহলের বিশেষ তত্বাবধানসহ থাকতে হবে পরিকল্পনার যথার্থ মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়ন। কারণ, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ (ক) অনুসারে চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
রাষ্ট্র তার সুদূরপ্রসারী প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমত জেন জিকে টার্গেটে নিয়ে তাদের মানসিক অসুস্থতার অনুক্ত উৎপাদকগুলো একেক করে অপনোদন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের বড় অংশ খরচ করতে হবে। অন্তবর্তীকালীন সরকার যতদিন দায়িত্বে রয়েছে ততদিন গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে বিশেষ জোরারোপ প্রদান করবে বলে বিশ্বাস রাখা যায়।
লেখক: মো. তারেকুল ইসলাম -লেখক ও কলামিস্ট সহকারী শিক্ষক, ইকরা আব্দুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।