তিনদিনের পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি দল রাঙামাটিতে: সিরিজ বৈঠক

RHDC Picture-09-02-14-02
পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:
পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা উন্নয়ন, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের নির্বাচনসহ পার্বত্যাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও এ অঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পসমূহ পরিদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে দুইদিনের সফরে পার্বত্য শহর রাঙামাটি সফর করছেন পাচঁ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশে ইইউ এর রাষ্ট্রদূত ও ডেলিগেশন টিমের প্রধান মি. উইলিয়াম হান্না’র নেতৃত্বে পাচঁ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি রাঙামাটিতে এসে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমার সাথে। প্রায় আধা ঘন্টাব্যাপী চলা বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও জেলা পরিষদের নির্বাচন নিয়ে পরিষদ চেয়ারম্যানের সাথে আলাপ করেছে বলে জানা গেছে জেলা পরিষদ সুত্রে। এই সময় জেলা পরিষদের সদস্য অংশিপ্রু চৌধুরী সহ ইউএনডিপি ও সিইচডিএফ এর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে প্রতিনিধি দলটি শহরে প্রবেশ করেই রাঙামাটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আসলে জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল পুষ্পমাল্য দিয়ে প্রতিনিধি দলকে বরণ করে নেন। এসময় ইইউ রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হান্না ও তার স্ত্রী মিসেস পাওলা ফরনারী হান্না, ঢাকাস্থ ইইউ কার্যালয়ের প্রথম কনস্যুলার মি. ফিলিপ্প জ্যাকুইস, দ্বিতীয় সেক্রেটারি মিস লেনকা ভিতকোভা ও এটাচি মি. ফেব্রিজিও সেনেসি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে একান্ত বৈঠকে জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামালকে তাদের সফরসূচী সম্পর্কে সার্বিক তথ্য উপস্থাপন করেন।

রাঙমাটি জেলা পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়,  জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সাথে সাক্ষাতে রাষ্ট্রদূতরা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ’মি, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং নারীদের অংশগ্রহণ, পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নের অগ্রগতি এবং সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কে মত বিনিময় করেন। বিশেষ করে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলির নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রত্যাশা করেন।  
 
চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা রাষ্ট্রদূতদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং পরিষদগুলির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে  যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্রমান্বয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাদের সাহায্য প্রত্যাহার করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে চুক্তির একটি বৃহৎ অংশ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অন্যান্য ধারাগুলোও বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে অত্যন্ত আন্তরিক। বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশ্তেহারেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের আগেই যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাদের সাহায্য প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে এর বিরূপ প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের উপর পড়বে। এজন্যে তিনি রাষ্ট্রদূতদের কাছে যৌথ উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

এছাড়া তিনি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ’মি, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং নারীদের অংশগ্রহণ, পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নের অগ্রগতি এবং সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী ভ’মি, পুলিশ পরিষদে হস্তান্তর এবং পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ জেলার প্রকৃত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।

এসময় চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরিষদের সদস্য অংসুই প্রু চৌধুরী, শামীম রশিদ, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইরফান শরীফ এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা অরুনেন্দু ত্রিপুরা, ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ এর পক্ষ থেকে ডেপুটি ডিরেক্টর প্রসেনজিৎ চাকমা, চীফ ইমপ্লিমেন্টাশন রব স্টোলম্যান এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার ঔশ্বর্য চাকমা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে রোববার বিকেলে ইইউ প্রতিনিধি দলটি রাঙামাটিস্থ ইউএনডিপি কার্যালয়ে  আজ বিকাল ৪ টায় জেলার পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ ও বিকাল ৪.৪৫ মিনিটে বাঙ্গালী নেতৃবৃন্দের সাথে এখানকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। বৈঠকের বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করে রাঙামাটি জেলা বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো: আলমগীর জানিয়েছেন, আমরা একটি দাওয়াতপত্র পেয়েছি এবং তারপরে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমাদের একটি প্রতিনিধি দল ইইউ প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাতের জন্য পাঠাবো। এছাড়া পার্বত্য নাগরিক পরিষদের একটি প্রতিনিধি দলেরও এই বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা সমঅধিকার নেতৃবৃন্দ বলেন, তারা এ ধরণের কোনো মিটিং-এর কথা জানেন না।

এছাড়াও এই প্রতিনিধি দলটির সাথে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার সাথে বৈঠকে মিলিত হওয়ার এবং রাতে তাদের রাঙামাটিতে রত্রিযাপনের কথা রয়েছে। তবে এসব অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার না থাকায় বৈঠকে কি ধরনের আলোচনা হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।

আগামীকাল প্রতিনিধি দলটি চাকমা সার্কেল চীফ দেবাশীষ রায়ের সাথে সাক্ষাত শেষে রাজস্থলী রওনা হবেন। সেখানে তারা ইইউ’র অর্থায়নে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করার পর বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। ১০ ফেব্রুয়ারী তারা বান্দরবানের রাজবিলা সফর করবেন এবং বান্দরবান পর্যটনে রাত্রিযাপন করবেন। ১১ ফ্রেব্রুয়ারী বান্দরবানের রোয়াংছড়ি সফর শেষে সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে বান্দরবান ছাড়বেন।

এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে  ২ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটির জেলা প্রশাসকের কাছে ফ্যাক্সে পাঠানো ইইউ ডেলিগেশনের সফরসূচীতে [স্মারক নং- প্রো/ ডিসিপি(এমএস)৮/৫১/১৪] স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকের ক্ষেত্রে পাহাড়ী নেতৃবৃন্দের বেলায় ` Meeting with Indigenous civil society members’ লেখা হয়েছে। 

৬

এবিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রোগ্রাম শিটে স্বাক্ষর থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রাচার উপপ্রধান (মিশন সার্ভিস) এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ আসিফ রহমান এর কাছে মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজে জাতিসংঘে চিঠি দিয়ে, বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে বলেছে বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। মন্ত্রণালয় দেশের জনগণ ও গণমাধ্যমকেউ আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করার অনুরোধ জানিয়েছে, তাহলে মন্ত্রণালয় নিজেই কেন Indigenous শব্দ ব্যবহার করছে তাদের অফিসিয়াল চিঠিতে।  জবাবে তিনি পার্বত্যনিউজকে বলেন, প্রোগ্রাম শিডিউলটি আমরা করিনি। ইইউ তাদের চিঠিতে ইনডিজিনাস শব্দটি ব্যবহার করেছে। আমরা শুধু সেই সফরসূচী স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছি।

কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের কাছে যে চিঠি গিয়েছে সেটি তো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কাজেই এটি রেফারেন্স হিসাবে ভবিষ্যতে ব্যবহৃত হতে পারে- প্রশ্ন করলে আসিফ রহমান জানান, চিঠিটি আপনাদের কাছে তো যাওয়ার কথা নয়। তবে ভুলটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর আমরা আরেকটি কারেক্ট শিডিউল পাঠিয়েছি। কিন্তু আপনারা কারেকশন কপিটি পাননি। আপনারা আগের কপি পেয়েছেন।

সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি পার্বত্যাঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে যেসব প্রকল্প পরিচালিত হয়ে আসছে মূলত সেগুলোর বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জানতে পার্বত্য চট্টগ্রামে গেছে ইইউ প্রতিনিধি দল। এছাড়া এই সফরটি তাদের অফিসিয়াল রুটিন ওয়ার্ক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন