parbattanews

তুমব্রু সীমান্তে আগুন, রোহিঙ্গাদের নতুন আশ্রয় শিবির!

তুমব্রুতে শূন্যরেখায় স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০১৭ সালের পর থেকে চার হাজার ২৮০ রোহিঙ্গা বসবাস করছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) গোলাগুলি ও আগুনের ঘটনায় শেষ আশ্রয় হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা। সবকিছু হারিয়ে শূন্যরেখার কাছাকাছি তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ এর আশপাশে ঠাঁই নিয়েছে কয়েক’শ রোহিঙ্গা পরিবার। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্ত এলাকার মিয়ানমার অংশে গোলাগুলির ঘটনায় একজন নিহত ও আরো দু‘জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া শূন্যরেখা শিবিরে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দিকে ছুটছে।

শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) বিকালে নতুন এই ‘আশ্রয় শিবিরেই’ কথা হয় রোহিঙ্গা বৃদ্ধ আবদুল মালেকের (৬০) সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘আবার ঘরবাড়ি হারিয়ে পাঁচ বছর আগের সেই জায়গাতেই এসে পৌঁছেছি।’

অনেকে আবার আশ্রয়ের একটু জায়গার জন্য বোচকা-পোটলা নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটছে। এছাড়াও স্থানীয় বাজারেও অন্যদিনের তুলনায় রোহিঙ্গাদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো।

আব্দুল মালেক বলেন, ‘প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমরা শূন্যরেখায় (জিরো পয়েন্টে) ছিলাম। আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে আইসিআরসি আমাদের সুযোগ-সুবিধা দিতো। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার আমাদের ঘরগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন আমরা মিয়ানমারে ঢুকে যাই। এক রাত থাকার পর আবার বার্মা (মিয়ানমার) থেকে এপারে পার করে দিয়েছে সেই দেশের সরকার। এখন আমরা কোথায় যাবো? এখানে থাকার ব্যবস্থা নেই, নেই খাবার ও টয়লেটও। এতে নারী-শিশুদের নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছে।’

ঘরে দেওয়া আগুনে শীতের কাপড়সহ সব পুড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনও খাবারও জোগাড় করতে পারিনি। ঠান্ডায় শিশুরা কাবু হয়ে যাচ্ছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ছোট্ট একটি ভাঙা ত্রিপলের ছাউনিতে বাচ্চাদের নিয়ে তিন পরিবারের ১৯ জন মানুষ গাদাগাদি করে এক জায়গায় থাকছি।’

শুক্রবারও সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ পাওয়ায় গেছে বলেও জানান তিনি।

শূন্যরেখা শিবিরে আগুনে ঘর হারিয়ে পরিবার নিয়ে তুমব্রু বাজারে আশ্রয় খুঁজতে আসা আবু নাসের নামে এক রোহিঙ্গা বলেন ‘শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারীদের মধ্য আমিও ছিলাম। কিন্তু আগুন দিয়ে আমাদের ঘরবাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা নিরীহ মানুষ, কোনও পক্ষের না। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, গায়ের পরনের জামা ছাড়া কিছু বের করতে পারেনি। আমার স্ত্রীও অসুস্থ, পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিতে একটি জায়গা খুঁজছি। এর আগের দিন স্থানীয় এক হিন্দু পরিবারের কাছে একদিন আশ্রয় নিয়েছিলাম।’

তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আব্দুল করিম (৯০) ও আমেনা খাতুন (৭০) দম্পতি। ‘কেমন আছেন’ জানতে চাইলে বৃদ্ধ করিম বলেন, ‘মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে এসে পৌঁছেছি, এখনও কোথাও স্থায়ী ঠাঁই হলো না। ২০১৭ সালে আগস্টে ঘরবাড়ি হারিয়ে শূন্যরেখায় ঠাঁই হয়েছিল। সেখানে পাঁচ বছর ধরে কোনোভাবে বেঁচে থাকার যুদ্ধটা চলছিল। এখন সেটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। এখানে স্কুলের বারান্দার কোণায় এক জায়গায় দুজন একসঙ্গে পড়ে আছি, বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছি। শীতের মধ্য খুব কষ্ট হয়। ঠান্ডায় ঘুমাতে না পেরে রাতে বসে থাকতে হয়। তার উপরে নেই খাবারের ব্যবস্থা। এবার বোঝেন, কী অবস্থায় আছি?’

সীমান্তের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তুমব্রু সীমান্তে কোনারপাড়া শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় মিয়ানমারের দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে শুক্রবার সকালেও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সীমান্তের আগুনের ধোঁয়া দেখা গেছে। এর আগে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শূন্যরেখার প্রায় ৫’শ রোহিঙ্গাদের বসতঘর পুড়ে যায়। ফলে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশপাশে বেশকিছু রোহিঙ্গা আশ্রয় নিতে শুরু করে।

তুমব্রুর বাজারের দোকানদার নির্মল ধর জানান, ‘গত বুধবার থেকে সীমান্তে থেমে গোলগুলি-আগুন খেলা চলছে। আজকে ভোরেও গোলাগুলি-আগুনের ধোঁয়া দেখা গেছে। শূন্যরেখার অনেক রোহিঙ্গা তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ তার আশপাশে এখন নতুন করে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে ঘরবাড়ি বানাচ্ছে রোহিঙ্গারা। যার কারণে স্কুলের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। গোলাগুলি-আগুনের ঘটনায় যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ঢুকেছিল, তারাও এপারে আশ্রয় খোঁজছে।’

জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, ‘তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ তার আশপাশে কিছু রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে শুনেছি। রোহিঙ্গারা যাতে করে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য একাধিক আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। তবে কতজন রোহিঙ্গা এখানে আশ্রয় নিয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। সীমান্তের সবাই সর্তক অবস্থানে রয়েছে, পরিস্থিতি শান্ত আছে।’

Exit mobile version