দুইটি নির্বাচন: আ’লীগের বেহালদশা: বিএনপির খাই খাই: উজ্জীবিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো: পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ

cht Map
আলমগীর মানিক,রাঙামাটি:

একদিকে ক্ষমতাসীন দলের টানা পরাজয়, অন্যদিকে ক্ষমতার মসনদে পার্বত্যাঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলেোর প্রভাব বিস্তারে নতুনভাবে যোগ হওয়া আসন। ক্রমশ: পরিবর্তন হতে চলেছে পাহাড়ের রাজনীতির হালচাল। যদি এরকমই চলতে থাকে তাহলে অচিরেই আমুল পরিবর্তন আসবে পাহাড়ের রাজনীতিতে- যা সামান্য কয়েকমাস আগেও এখানকার রাজনীতিবিদ থেকে পর্যবেক্ষক মহলও ধারনা করতে পারেননি। বিগত সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের হারিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ট্রেনে উঠে নিজেদেরকে সাধারনের কাতারে নিয়ে আসার মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস, আর অন্যদিকে কিছুটা ছাড় দিয়ে অস্তিত্ব হারানোর ভয়ে সমমনা সংস্কারপন্থীদেরকে ক্ষমতার সাথী করে টিকে থাকতে মরিয়া হয়ে উঠছে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ। এ ক্ষমতার নতুন হিসাব নিকাশের মাঝে পড়ে দলিত-প্রেষিত হয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর এই ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকা সত্বেও সরকারের মামলা-হামলার নোনা জল খেয়ে কিছুটা অন্তরালের সমঝোতার মাধ্যমে নতুন করে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল বিএনপি। বলতে গেলে তারা পায়ের নিচের মাটি একটু পাকাপোক্ত করেই হাঁটছে যাতে করে পিছলে না পড়তে হয়। তবে দলীয় কোন্দল আর নেতাদের গা-ছাড়া ভাব এর কারণে পাহাড়ের ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তারা কতটুকু এগিয়ে যাবে সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ দলীয় নেতাদের।

এদিকে বিগত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ততকালীন প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সত্বেও পার্বত্যাঞ্চলের রাজনীতির পাকা খেলোয়ার হিসেবে পরিচিত রাঙামাটির জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের হেরে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না পাহাড়ের আওয়ামী ঘরানার লোকজন। এ নিয়ে অনেকের মাথায় ঘুরছে জেএসএস- আ.লীগের নানা হিসাব, নানা কথা।  এছাড়া নির্বাচনে হেরে গিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মনোবলেও অনেকটা ভাটা পড়েছে- এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কিছু কর্মকান্ডে। আর এই সুযোগের সুফল ঘরে তুলতে চলেছে এখানে বিজয়ী হওয়া আঞ্চলিক দলের নেতাকর্মীরা। আর তাদের এই সুযোগের মাঝখানে ঢুকে ফল খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে স্থানীয় বিএনপি।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সম্প্রতি রাঙামাটিতে ঘটে যাওয়া দুই বড় ধরনের টেন্ডারের কথা। বিদ্যুৎ বিভাগ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রায় দশ কোটি টাকার টেন্ডারে ক্ষমতাসীনদের সাথে প্রায় সমভাগ বন্টন করে ভাটোয়ারা করে নিয়েছে জেএসএস-বিএনপি। যা বিগত ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে তেমন একটা লক্ষ্য করা যায়নি। এছাড়াও নির্বাচনের পরে হেরে গিয়ে প্রথমবার ধাক্কা খায় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ রাঙামাটি কলেজে প্রভাব বিস্তার নিয়ে। এরপর থেকেই দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে শুরু করছে। এরই ধারাবাহিকতায় অতি সম্প্রতি ২য় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া উপজেলা নির্বাচনে রাঙামাটির কাপ্তাই-নানিয়ারচরসহ তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি সংঘটিত হলো। আর অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে টানা তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের হেরে যাওয়ার পর থেকে পাহাড়ের রাজনীতিতে আস্তে আস্তে নিভতে চলেছে বর্তমান সরকার পরিচালনাকারি দল আওয়ামীলীগ এর রাজনীতির প্রদীপ।

এদিকে সরকারের কাছ থেকে টানা মামলা-হামলা-নির্যাতন আর নিজেদের অর্ন্তদলীয় কোন্দলের কারণে রাজপথ দখলে রাখতে না পারলেও তেলহীন বিএনপির প্রদীপ আবারো জ্বলতে শুরু করেছে পাহাড়ে সরকারের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে। এরই ধারাবাহিকতায় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়া দল বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে সারাদেশের ন্যায় পাহাড়ের রাজনীতিতে নিজেদের আসন আস্তে আস্তে পাকাপোক্ত করে চলেছে। এক্ষেত্রে তারা নানা ধরনের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে এগুচ্ছে। এমনটাই জানা গেছে দলটির নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে। দলটির নেতাকর্মীরা এই মুহুর্তে এতোটাই প্রাণচাঞ্চল যে, হারানো রাজপথ তারা ফিরে পেতেও বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে তারা।

এক্ষেত্রে শুধুমাত্র শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হওযার অপেক্ষায় রয়েছে তৃণমুল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। আর ইতিমধ্যে এর প্রমাণও তৃণমুল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দিতে শুরু করেছে। রাঙামাটির কাপ্তাই, নানিয়ারচর, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ও রামগড় ও বান্দরবানের লামা উপজেলায় চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদে ক্ষমতাসীনদের হারিয়ে জয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে দলটি। আগামী তফসিল অনুযায়ি রাঙামাটি সদর উপজেলাসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় বিএনপির একক প্রার্থী দেওয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যে দৌঁড়ঝাঁপ শুরু করেছে দলটির সভাপতি-সম্পাদকসহ প্রথম সারির নেতারা। তাই তৃণমুল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের একটাই চাওয়া যাতে করে জেলায় আর কোনো কোন্দলের ঘটনা না ঘটে। অন্তত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।

এদিকে পাহাড়ের রাজনীতিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ট্রেনে উঠে সম্প্রতি নিজেদের প্রাপ্ত আসনটিকে ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ’৯৭ সালে চুক্তির মাধ্যমে স্বশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসা পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সন্তু লারমা’র নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি জেএসএস। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে জিতে সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার সাথে সাথে পার্বত্য অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব আরো বৃদ্ধি করতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের জাল বিস্তার করে এগুচ্ছে দলটি। এরই ধারাবাহিকতায় দলটির নেতারা তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয় অবস্থানে এসে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালী সমাজের সাথে আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে তাদের সাথে যাদের সাপে-নেউলে সম্পর্ক অর্থাৎ ইউপিডিএফের সাথেও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে কিছুটা ছাড় দেওয়ারও ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।

এছাড়াও জেএসএস এর নিয়ন্ত্রাধীন বিভিন্ন জায়গার স্থানীয় ও ফরিয়া ব্যবসায়িদের কাছ থেকে যে হারে চাঁদা আদা করা হতো (যদিওবা দলটির পক্ষ থেকে বরাবরই অস্বীকার হয় এক্ষেত্রে), নির্বাচনে জয়লাভ করার পর বাঙ্গালীদের সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের কৌশল হিসেবে সেসব জায়গায় এখন চাদাঁর হার অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে দলটি। যাতে করে এসব ক্ষেত্রে একটি সহানুভূতি তৈরি হয় এই দলটির প্রতি। বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও বর্তমানে জেএসএস চেষ্টা করছে তাদের সহাবস্থানের বিষয়টি জনসাধারনের সামনে তুলে ধরতে। বর্তমান সময়ে এক্ষেত্রে তারা একটু এগিয়েও গেছে, কারণ পাহাড়ে অর্ন্তকোন্দলসহ বিভিন্ন কারনে বাঙ্গালী সংগঠনগুলো নিস্ক্রিয়তা আর ভূঁইফোড় সংগঠনের প্রভাব। আর তাই পাহাড়ে বর্তমান সময়ের অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একবার যখন জিতেছে তাই নির্বাচনের এই জয়কে স্থায়ীরূপ দিতে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তারা এখন মোটামুটি সিদ্ধান্তে পৌছেছে যে, পাহাড়ে অব্যাহত ভাতৃঘাতি সংঘাত, অপহরণ, চাদাঁবাজি’র মতো ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে রাখলে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভাটা পড়বে। এর থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় যদি প্রভার বিস্তার করা যায়, তাহলে শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে তা যেমন সহায়ক হবে, তেমনি এখানে তাদের নিজস্ব চিন্তা দর্শন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

অপরদিকে প্রতিনিয়ত সশস্ত্র সংঘাত এর পাশাপাশি মিডিয়ার বদান্যতায় পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান এতদিন ধরে রাখলেও বিগত ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের পর তাদের আধিপত্যে কিছুটা চির ধরেছে। এর প্রমান মিলছে দলটির সমসাময়িক কিছু কর্মকান্ডে। তাই দলটি কিছুটা ছাড় দিয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এবং জাত শত্রু জেএসএসের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার রোধ করতে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত এমএন লারমা সমর্থিত জেএসএসকে সঙ্গী করে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে ইউপিডিএফ। তাই এই দলটির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে রাঙামাটির নানিয়ারচর, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ কয়েকটি ভাইসচেয়ারম্যান পদে সংস্কারপন্থীদের প্রার্থীকে অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে বিজয়ী করা হয়েছে। আগামীতে যুগোপত আন্দোলনে সংস্কারপন্থীদের সাথে ইউপিডিএফের অলিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার খবরও রয়েছে এই দুইটি দলের মধ্যে।

কিন্তু রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচন নিয়ে একটু চিন্তায় পড়েছে ইউপিডিএফ। কারণ দীর্ঘীদন ধরে এই উপজেলাটির অধিকাংশ এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার ফলে এই উপজেলাটি নিজেদের পরিপূর্ণ দখলে নিতে মাঠে নেমেছে নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা উষাতনের জেএসএস। অন্যদিকে কোমর বেধে বিজয়ের মালা পড়তে উপজেলার সর্বত্র জন সাধারণের সাথে দেখা সাক্ষাত করে ভোট ভিক্ষা করছে সংস্কারপন্থী জেএসএস। আর তাই একটু বেশিই চিন্তায় পড়েছে ইউপিডিএফ। কারণ এই উপজেলা থেকে এই সংগঠনটির যে আয় আর এখানে যে প্রভাব বর্তমানে রয়েছে, নিজেরা ছাড়া জেএসএসের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলে চিরতরে হারাতে হবে এই উপজেলার নিয়ন্ত্রণ। আর তাই কিছুটা ছাড় আর শর্তের মাধ্যমে টিকে থাকার সঙ্গী সংস্কারপন্থীদের সমর্থন দেওয়ার চিন্তা করছে ইউপিডিএফ এমনটিই জানাগেছে দলটির পক্ষ থেকে। অন্যথায় ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি পর স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে জনসংহতি সমিতি হতে বেরিয়ে এসে প্রসিত খীসার নেতৃতে ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর থেকে দীর্ঘ ১৬ বছরের ঐতিহ্য হারাতে বসবে কি দলটি- এমনটিই প্রশ্ন এখন সবার সামনে।

সর্বোপরি বর্তমান সময়ে পার্বত্যাঞ্চলের রাজনীতির সার্বিক দিক বিবেচনায় এখানকার পর্যবেক্ষক মহল এমনটিও ধারনা করছেন যে, যেভাবে এগুচ্ছে পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর রাজনীতির গাড়ি, এরকম চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতি পাহাড়ে তেমন একটা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।  যদি তাই হয় তাহলে পাহাড়ের রাজনীতিতে এক্কেবারে নতুন মেরুকরণ হবে বলে মনে করছেন এখানকার বোদ্ধামহল- যা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবে, আঘাত হানবে ইউনিপোলার রাষ্ট্রের কাঠামোতে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন