parbattanews

দুই লাখ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে উধাও

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এই ছবিটি তুলেছেন নিউইয়র্ক টাইমসের এডাম ডিন

রোহিঙ্গা সংকটের চতুর্থ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাবাসন না ঘটলেও ক্যাম্প থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে তারা। গত তিন বছরে এরকম হাওয়া হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। প্রতিদিনই বাড়ছে এ সংখ্যা।

মিয়ানমারের রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সহিংস ঘটনার পর ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয় এই রোহিঙ্গাদের।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। এদের সর্বশেষ হিসাবমতে, ৩৪টি ক্যাম্পে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা নয় লাখ পাঁচ হাজার ৮২২ জন।

এই হিসাবের মধ্যে রয়েছে ১৯৯১ সালে আসা ৩৪ হাজার রোহিঙ্গাও। বাকি দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা কোথায় গেছে, তা কারও জানা নেই। তবে সরকারি-বেসরকারি সব মহলই মনে করছে, এসব রোহিঙ্গা লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছে তারা।

আইএসসিজির সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আট লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার জন্য এ বছর এক হাজার ৫৮ মিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়া হয়েছে।

বছরের আট মাস পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত মিলেছে ৪০৯ মিলিয়ন ডলার, যা চাহিদার মাত্র ৩৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৯ সালে প্রত্যাশিত ৯২১ মিলিয়ন ডলারের ক্ষেত্রে মিলেছিল চাহিদার মাত্র ৬৯ শতাংশ- ৬৩৫ মিলিয়ন ডলার।

জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর হিসাব মতে, ক্যাম্পে যে হারে রোহিঙ্গা কমছে, বিদেশি অর্থ সাহায্যও একই হারে কমছে। ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দায়ভার আপনাআপনিই পড়ছে এই দেশের কাঁধে।

কক্সবাজারে আইএসসিজির সমন্বয় কর্মকর্তা সৈকত বিশ্বাস বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিশ্রুত তহবিল না মেলায় পরিকল্পিত অনেক ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে।

স্থানীয়দের জন্যও অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এতে দাতা সংস্থাগুলোও উদ্বিগ্ন। আইএসসিজির তথ্যমতে, দাতা দেশগুলোর মধ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি ১৭৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছে আমেরিকা।

এরপর অস্ট্রেলিয়া সরকার দিয়েছে ৩৮ মিলিয়ন ডলার। সমপরিমাণ অর্থ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাজ্য।

কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ৩৪টি ক্যাম্পে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার ৪৩৮ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এ হিসাব যোগ করলে গত তিন বছরে ক্যাম্পে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা।

কিন্তু শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন দপ্তর এবং জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের যৌথ উদ্যোগে চলতি বছর সর্বশেষ ডিজিটাল নিবন্ধনে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা আট লাখ ১৯ হাজার ৭৮৭ জন।

আর পরিবারের সংখ্যা এক লাখ ৭৯ হাজার ৫৯০। ক্যাম্পের ২০১৮ সালের জুন মাসের আগের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের সঙ্গে তুলনা করে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান এই কর্মকর্তা।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও স্বীকার করছেন বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার ক্যাম্প থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার কথা। উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ছে অথবা বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছে। তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে ও স্থানীয়দের শ্রমক্ষেত্র কেড়ে নিচ্ছে।

অধ্যক্ষ হামিদ বলেন, মিয়ানমার থেকে আগে এসেছে- এমন অনেকে এখন কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় জনপ্রতিনিধি। তারা রোহিঙ্গাদের এখানে স্থায়ী হতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বসতি স্থাপন করেছে- এমন রোহিঙ্গার সংখ্যা অনেক।

এ ছাড়া উখিয়া উপজেলার পালংখালী, জালিয়াপাড়া, মাছকারিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠে বলে জানান উপজেলা চেয়ারম্যান হামিদ। তার মতে, প্রশাসনিকভাবে কোনো অভিযান নেই, তাই বেপরোয়া রোহিঙ্গারা।

এর আগে দেখা গেছে, অভিযানে যারা ধরা পড়ত, তাদের ৯০ শতাংশই রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে তারা ব্যাপকহারে মাদক ব্যবসায় যুক্ত। অবৈধ ব্যবসায় তারা বিপুল অর্থ আয় করছে, যা দিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী হচ্ছে তারা।

উপজেলা চেয়ারম্যান হামিদ বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি হচ্ছে। জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্রও দেখা যাচ্ছে। তারা এখন স্থানীয়দের জন্যও বিষফোঁড়া। তার মতে, একটি স্থানে এত বিপুল রোহিঙ্গা রাখার পদক্ষেপ সঠিক নয়।

স্থানীয়দের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পে পূর্ণ নিরাপত্তার ভেতর রাখা দরকার। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে- এমন কিছু এনজিও কর্মকর্তা নানাভাবে তাদের মদদ দিচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মতো বিশ্ব সমস্যা যেন স্থানীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আমাদেরই এর সমাধান খুঁজে নিতে হবে।

টেকনাফ পৌরসভার মেয়র হাজি মো. ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের অনেকেই বিভিন্ন স্থানে খাস জমি ও বনভূমি দখল করে বসতি গড়ে তুলছে। টেকনাফের পৌরশহর, হ্নীলা, বাহারছড়া, হোয়াইক্যংসহ বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপনকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা কম নয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন টেকনাফ পৌর মেয়র।

উখিয়ার বালুখালী ১০নং ক্যাম্পের মাঝি মাস্টার নূরল কবির জানান, রোহিঙ্গারা জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। অনেক পরিবারেই এক বা একাধিক সদস্য বিভিন্ন কাজে যুক্ত। পরিবারের বাকি সদস্যরা নিয়মিত ত্রাণসামগ্রী নিচ্ছে ক্যাম্পে।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা আট লাখ ৫৮ হাজার ৪০১ রোহিঙ্গার জন্য খাদ্যসামগ্রী দিচ্ছে। বাকি রোহিঙ্গারা কোথায় রয়েছে এবং কীভাবে তারা জীবিকা নির্বাহ করছে, এ তথ্য তাদের কাছে নেই। সংস্থার তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে তারা নয় লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য খাদ্যসামগ্রী দিয়েছিল।

উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্যমতে, আশ্রয়কেন্দ্রে নিবন্ধন করেনি- এমন রোহিঙ্গার সংখ্যাও লক্ষাধিক। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অবস্থাপন্ন রোহিঙ্গা পরিবারগুলো ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়নি।

কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, ঝিলংজা, সদর উপজেলার ঈদগাঁও এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ভাড়া নিয়ে থাকছে এমন অনেক রোহিঙ্গা পরিবার। ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরিও করছে তারা।

কক্সবাজার ফিশারি ঘাটের বোট মালিক সমিতির একটি সূত্র জানিয়েছে, সাগরে মাছ ধরা নৌকায় মাঝিমাল্লাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমদ বলেন, রোহিঙ্গাদের কাজ না দিতে নির্দেশনা রয়েছে।

কিন্তু অনেক বোট মালিক কম বেতন দিতে পরিচয় গোপন রেখে রোহিঙ্গাদের শ্রমে লাগাচ্ছেন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গ্রামের বিভিন্ন পথ রয়েছে, যেখানে কোনো চেকপোস্ট নেই। রোহিঙ্গারা এসব পথ ব্যবহার করে দিনে বা রাতে অন্যখানে চলে যাচ্ছে। কক্সবাজার শহর থেকে অন্য জেলায় যেতে তাদের কোনো চেকপোস্ট সামনে দিয়ে যেতে হয় না।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানান, অধিকাংশ রোহিঙ্গা মহাসড়কের চেকপোস্ট এড়ানোর জন্য হাঁটা পথ ব্যবহার করে। এসব কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বেষ্টনী নির্মাণের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয় মিয়ানমার : রোহিঙ্গা সংকটের তিন বছরে তিন দফায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে গেছে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল। বৈঠক করেছেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। তারপরও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি।

কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুবুল আলম তালুকদার বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৮ পরিবারের পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৯ রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ।

মিয়ানমারের কাছ থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১০ হাজার ৭০৪ রোহিঙ্গার ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার আন্তরিক নয়।

কমিশনার বলেন, ‘রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাহলেই রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হবে।’

কক্সবাজার বন বিভাগের হিসাব মতে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে সাড়ে ছয় হাজার একর বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অকল্পনীয় ক্ষতি হয়েছে। পাহাড় কাটায় বদলে গেছে ভূমির প্রকৃতি।

১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস ও কার্যক্রমের প্রভাব পড়েছে আশপাশের বিস্তৃত এলাকায়। নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বন ও জীববৈচিত্র্য যেমন বিপন্ন হবে, তেমনি মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে এ অঞ্চল।

সূত্র: সমকাল

Exit mobile version