parbattanews

দুর্গম পাহাড়ে করোনার টিকা: প্রচারে ভরসা হেডম্যান-কারবারী

বান্দরবানের বড়মদক, রেমাক্রি, তারগুপাড়া, লাংলাইপাড়া বা কুরুকপাতার মতো অন্তত শতাধিক গ্রাম রয়েছে যেখানে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট পৌছাইনি। দুর্গম এলাকায় ম্রো, ত্রিপুরা, বম, খুমি, লুসাই এবং পাংখুয়া সম্প্রদায় বসবাস করে। এসব সাধারণ পাহাড়িরা এখনো করোনা ভাইরাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেনি।

হামের টিকা থেকে শুরু করে অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণেও তাদের তেমন কোন আগ্রহ নেই। এই অবস্থায় কোভিড প্রতিরোধে দেশের সিংহভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু দুর্গম এলাকার এসব মানুষকে কিভাবে করোনার টিকা প্রয়োগ করা হবে কিংবা তাদের উদ্বুদ্ধকরণের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানেনা স্থানীয়রা। এদিকে সারাদেশের ন্যায় আগামী ১৪ আগস্ট থেকে বান্দরবানের সাত উপজেলায় টিকার ক্যাম্পেইন শুরু হতে যাচ্ছে।

জেলা সিভিল সার্জন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে বান্দরবান সদরে ১৩ হাজার ৩৪৭, লামা ৪ হাজার ১৮২, নাইক্ষ্যংছড়ি ৩ হাজার ৯৪০, থানচি ১ হাজার ১৪৫, রুমা ১ হাজার ৬৯০ ও আলীকদম উপজেলায় ৩ হাজার ৬৪৭জন এবং রোয়াংছড়ি উপজেলায় ৮৯৭জন টিকা নিয়েছে।

জানা গেছে, সর্বশেষ সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক ১৮ বছরের উর্ধ্বে জাতীয় পরিচয়পত্রধারী যে কেউ রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান কেন্দ্র থেকে কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণ করতে পারবেন। প্রথম পর্যায়ে ইউনিয়ন সমূহের পুরনো ১নং ওয়ার্ডের নির্ধারিত স্থানে গিয়ে টিকা নিতে পারবে। দুর্গম এলাকার মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা গ্রহণের সুযোগ থাকছে। আর টিকা গ্রহীতাদের সেই তথ্য সংগ্রহে রাখবে হাসপাতালগুলো।

বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা প্রতিরোধে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মাইকিং করা হলেও দুর্গম এলাকায় টিকা গ্রহণের জন্য এলাকার মানুষের মাঝে উৎসাহ দেওয়ার বিশেষ কোন উদ্যোগ শুরু হয়নি এখনো। যার কারণে দুর্গম এলাকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ টিকা কেন্দ্রে আসবে কিনা তা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন নানা পরিকল্পনায় এগুচ্ছে। স্থানীয়দের মতে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নিজ গ্রামের কারবারী কিংবা হেডম্যানের কথায় অনেক ক্ষেত্রে আশ্বস্থ হয়ে থাকে। এছাড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ সাধারণ মানুষকে টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের একমাত্র ভরসা হতে পারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ হেডম্যান-কারবারীরা।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার দোছড়ি ইউনিয়নের তারগু মৌজা প্রধান (হেডম্যান) মংনু মারমা বলেন, এখনো পর্যন্ত প্রশাসন কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে দুর্গম এলাকায় টিকা প্রদানের বিষয়ে তাদের কোন সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। প্রচার প্রচারণা না থাকলে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ টিকা দিতে আসবে-না বলে মনে করেন তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দা পায়ইং ম্রো জানান, পাহাড়ে থাকায় তাদের স্বাভাবিকভাবে তেমন কোন রোগবালাই নেই। এছাড়া করোনার টিকা অনেক দূরের কথা, রোগটি সম্পর্কে পর্যন্ত অনেক মানুষ এখনো পরিচিত নয়।

এই প্রসেঙ্গে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সালমা ফেরদৌস বলেন, ইতোমধ্যেই স্থানীয় কয়েকটি মিটিংয়ে টিকা প্রদানের নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। এই সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের আরও একটি মিটিং রয়েছে। এরপর দুর্গম এলাকায় টিকা পৌছানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ করবে।

থানচি উপজেলা ইউএনও আতাউল গণি ওসমাণি বলেন, আগামী ১৪ আগস্ট থেকে উপজেলার দুর্গম রেমাক্রি, বড় মদক, ছোট মদকসহ প্রত্যেক ইউনিয়নে একযোগে টিকা প্রদান করা হবে। দুর্গম এলাকার মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে টিকা দেওয়া হবে। পরবর্তী তাদের তথ্য উপজেলায় এসে সংরক্ষণ হবে। এছাড়া চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমে ওয়ার্ড পর্যায়ে গঠিত কমিটি দ্বারা প্রচারণ প্রচারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে টিকা প্রদানের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে একই তথ্য জানান রুমা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইয়ামিন হোসেনও।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও প: প: কর্মকর্তা ডা. আবু জাফর মোহাম্মদ ছলিম জানান, দুর্গম এলাকার বিষয়ে এখনো আলেদা কোন নির্দেশনা আসেনি। ১৪ আগস্ট থেকে ইউনিয়নের পুরনো তিন ওয়ার্ডে টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। তার উপজেলায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষের টিকার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এই পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ টিকা গ্রহণ করেছে।

এদিকে দেশের কভিড পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিস (সিজিএস) বিভাগ। এই প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে, টিকা গ্রহণের হারে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বান্দরবান জেলা। এখানে ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষ টিকা গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলাগুলো ভালো করছে বলে উল্লেখ করেছে। তবে টিকা কার্যক্রম ও নিবন্ধন প্রক্রিয়াসহ আরও বেশি সহজ করার পরামর্শ দেন প্রতিষ্ঠানটি।

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন অংসুই প্রু মারমা জানান, চলতি মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত বান্দরবানের সাত উপজেলায় মোট ৩৬ হাজার ৭২১ জন টিকার জন্য নিবন্ধন করেছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৬জনকে সিনোফার্ম প্রথম ডোজের টিকা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করেছে ৮৩ জন মানুষ। জেলার থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি ও আলীকদম উপজেলায় টিকা গ্রহীতার সংখ্যা কম বলে স্বীকার করেন তিনি।

Exit mobile version