দুর্বিসহ জীবন কাটছে রাঙামাটি নৌযান শ্রমিকদের

fec-image

বৈশ্বিক করোনায় পুরো পৃথিবী স্তব্দ। স্তব্দ সকল কর্মযজ্ঞ। করোনায় বিশেষ করে চরম বিপাকে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষেরা। যে মানুষেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে সংসারের চাকা ঘুরায় তারাই আজ সকলেই করোনার পাত্র বনে গেছেন।

কর্মযজ্ঞ বন্ধ থাকায় তারা হয়েছে কর্মহীন, হয়েছে ঘরবন্দী। নিজের শেষ সম্বল দিয়ে বেশ কয়েকদিন চললেও তা পুরিয়ে গেছে গত কয়েকদিনে।

করোনার কারণে রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের ৩০০সদস্য প্রায় বেকার বনে গেছে। বাড়িতে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। সন্তানরা কাঁদছে। আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় চূলায় আগুন জ্বালাতে কষ্ট হচ্ছে। হতাশায় অবসাদ জীবন পার করছে। অপেক্ষা করছে কখন তাদের শ্রমের চাকা ঘুরবে, চূলায় নিয়মিত আগুন জ্বলবে, আয়ের টাকায় পকেট ভারী হবে, সন্তান যাবে স্কুলে।

স্থানীয়ভাবে সরকারি কিছু ত্রাণ পেলেও তা পুরিয়ে গেছে অনেক আগে। গত মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় তারা এখন দুর্বিসহ জীবন পার করছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের পুরো শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একবার একটন চালের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এরপর স্থানীয় কোন জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাওয়া হয়নি।

তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ শ্রমিক জেলার বাইরে থেকে এসে কাজ করে। এখানকার ভোটার না হওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিধিরা তাদের কোন খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। কারণ সামনে আসন্ন পৌর নির্বাচন। তাই কাউন্সিলরা সরকারি এসব ত্রাণ তাদের ভোট ব্যাংক এলাকায় দিতে ব্যস্ত সময় পার করছে।

শ্রমিক এবং লঞ্চ মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাঙামাটি জেলা শহরের সাথে ৬টি উপজেলার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো নৌ-পথ। এর মধ্যে নানিয়ারচর, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উল্লেখযোগ্য উপজেলা। এই রুটগুলোতে প্রায় ৫৩টি লঞ্চ চলাচল করে। প্রতিটি লঞ্চে চালক, সারেং এবং মিস্ত্রীসহ ৫-৬জন শ্রমিক নিয়োজিত থাকে।

এদের মধ্যে চালকের বেতন মাসিক ২৫হাজার টাকা, সারেং এর বেতন ২০হাজার টাকা এবং মিস্ত্রির বেতন ১৮হাজার টাকা এবং শ্রমিকদের জনপ্রতি মাসিক বেতন ১২হাজার টাকা মালিক পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়ে থাকে।

বর্তমানে দেড় মাস লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় মালিক পক্ষ তাদের বেতন দিতে পারেনি। দেড়মাস ধরে বেতন না পাওয়ায় তারাও কষ্টে পড়েছে। বেতন না পাওয়ায় বাইরের শ্রমিকরা নিজেদের বাড়ি-ঘরে যেতে পারছেন না। কারণ সামনে ঈদুল ফিতর। টাকা ছাড়া বাড়ি কি ভাবে যাবে। আর স্থানীয় শ্রমিকরা বাড়িতে বেকার থেকে কোন রকমে দিন অতিবাহিত করছে।

রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য লঞ্চ চালক গিয়াস উদ্দীন বলেন, ভাল নেই আমরা, নেই কোন ইনকাম। বেকার সময় পার করছি, পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে জীবন পার করছি। ঘর ভাড়া আটকে গেছে। রোজগার না থাকায় ঠিকমতো খাবার ক্রয় করতে পারছি না। কখন এর থেকে নিস্তার পাবো আল্লাহ ভাল জানেন।

রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দে বলেন, আমাদের সমিতি থাকলেও নেই কোন উল্লেখযোগ্য ফান্ডে টাকা। যে কারণে শ্রমিকদের আপদকালীন কোন সহযোগিতা করতে পারছি না। কারণ আমাদের সমিতির তেমন কোন আয়-রোজগার নেই।

রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল হক বলেন, আমাদের অল্প কিছুদিন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, নৌ-চলাচল সংস্থা রাঙামাটি শাখার চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন সেলিম। এরপর আর কারো কাছ থেকে কোন সাহায্য পায়নি।

আমার শ্রমিকরা অনেক কষ্টে দিন পার করছে। একবেলায় চূলায় আগুন জ্বললেও আরেক বেলায় উপাস থাকতে হচ্ছে। সরকারি প্রণোদনা না পেলে আমাদের টিকে থাকা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা রাঙামাটি অঞ্চলের চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন সেলিম বলেন, আমাদের লঞ্চগুলো দেড়মাস ধরে চলাচল বন্ধ থাকায় আমাদের নিজেদের অবস্থা খুব খারাপ। অনেকে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে লঞ্চগুলো চালাচ্ছে। এখন ঋণের চাপ ঘাড়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, মালিক সমিতির পক্ষ থেকে শ্রমিকদের কয়েকবার ত্রাণ দিয়ে সহযাগিতা করেছিলাম। কিন্তু ত্রাণ দিয়ে তো তাদের জীবন চলে না। তাদের ঘর ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ কে চালাবে। যা ত্রাণ দিয়েছিলাম তা যৎসামান্য।

তিনি জানান, আমার লঞ্চের শ্রমিকদের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে আমি চেষ্টা চালাচ্ছি তাদের মুখে অন্তত অন্য তুলে দিতে। এখন আমার মতো লঞ্চের অন্যান্য মালিকরা সেই কাজ করছে কিনা বা তাদের সেই সামর্থ্য আছে কিনা সেটা বড় বিষয়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস, নৌযান, রাঙামাটি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন