দেশে ইয়াবার চালান আনার অন্যতম হোতা ‘নবী হোসেন গ্রুপ’
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন আতঙ্কের নাম নবী হোসেন। ক্যাম্পে দুই শতাধিক সদস্যের বাহিনী গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মাদক, অস্ত্র পাচার, অপহরণ ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িত এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তবে এখনও তাকে ধরা যায়নি।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার বড় চালান পাচার করাই নবী হোসেনের প্রধান কাজ। সীমান্তের কাছাকাছি পাঁচটি ক্যাম্পে তার আসা-যাওয়া রয়েছে। দুই শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে তার। মিয়ানমারের বিজিপির সহায়তায় সে দেশের এক নাগরিকের মাধ্যমে দিয়েছে চিংড়ির ঘের। ক্যাম্পে তার ৩০ সহযোগীর নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের মূল কাজ মাদক পাচার ও অর্থ লেনদেন। তিন বছর আগে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ছেড়ে ‘নসুরুল্লাহ নবী’ গ্রুপ তৈরি করে নবী হোসেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ দমনে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে নবী হোসেনের অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠিয়েছি। আমাদের তদন্তে মিয়ানমার থেকে মাদকের বড় চালান পাচারের সঙ্গে জড়িত পাঁচটি ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’ গ্রুপের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম নবী হোসেন গ্রুপ। নদীপথে বেশিরভাগ মাদক চালান নবী হোসেনের হাত ধরে বাংলাদেশে আসে। মিয়ানমারে অবস্থান করলেও মাদক বাংলাদেশে নিয়ে আসে নবী। তার সহযোগীরা কেনাবেচা করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়। একসময় আরএসও’র কমান্ডার ছিল নবী।’
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্টে বসবাসকারী মোস্তাক আহমেদের ছেলে নবী হোসেন (৪৭) মিয়ানমারের মংডু ডেভুনিয়া তুমরা চাকমাপাড়ায় আরএসও কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। সেখানে প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্বে একটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে ২০১২ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। সেখানে মাদ্রাসায় চাকরি নেয়।
২০১৭ সালের আগস্টে তার পরিবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর নবী হোসেন কুতুপালংয়ে পরিবারের কাছে চলে আসে। সে সময় তাকে দলে নিতে চাপ দেয় আরসা। এতে রাজি না হলে ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হয়। তখন মাদক চালানে জড়িয়ে পড়ে। এরপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাহিনী গড়ে। ২০১৮ সালে মাদকের বড় চালান নিয়ে আসে বাংলাদেশে। এরপর থেকে ইয়াবার সব বড় চালান তার হাত ধরে দেশে আসছে। এখনও আরএসও’র কিছু নেতার সঙ্গে নীবর যোগাযোগ রয়েছে। ওপারে তার প্রশিক্ষণ সেন্টার আছে।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, পুলিশের লিস্টে থাকা এই সন্ত্রাসীর স্বজনরা ওই ক্যাম্পের বি-৪১ ব্লকে তালিকাভুক্ত হলেও নবী হোসেন কোনও ক্যাম্পে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নবীর এক ভাই ভুলু মাঝি ক্যাম্প-৮ ইস্টে দায়িত্বে থাকাকালীন তাকে অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করার কারণে দায়িত্বে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে তার আরেক ভাই মো. কামাল ক্যাম্প ৮ ইস্টের বি-৪১ ব্লকের মাঝির দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বরসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে দুই শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে নবীর।
রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্য, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে নবী হোসেন গ্রুপের ২০০ সক্রিয় সদস্য আছে। এর মধ্যে নারী সদস্য আছে। তাদের মধ্যে কিছু সদস্যের বাংলাদেশ-মিয়ানমারে আসা-যাওয়া রয়েছে। তাদের মূল পেশা মাদক চালান এনে ক্যাম্পে মজুত ও বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া। এছাড়া সন্ত্রাসী ইসলাম ও মাস্টার মুন্না গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তার গ্রুপের।
নবী হোসেনের সক্রিয় সদস্যরা হলো- হাফেজ ইদ্রিস, মোহাম্মদ আনোয়ার, মোহাম্মদ সেলিম, মোহাম্মদ আয়াস, কামাল হোসেন, ইব্রাহিম, মোহাম্মদ আমিন, হামিদ হোসেন, মোহাম্মদ কাসিম, ইসমাইল, মো. রফিক, হারুনুর রশিদ, মো. জোবাইর, মো. জুনায়েদ, মো. ইসমাইল, শাহেরা জান্নাত, রিদুয়ান আক্তার, নুর তাজ বিবি, আনোয়ারা বেগম, মিনারা বেগম, রবিউল ইসলাম, রোমান, হোসেন জোহার, আবদুল আমিন, বদি আলম, সামছু আলম, কবির আহমেদ, হোসেন আহম্মদ, মো. শফিক ও মো. সেলিম। তারা উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।
সম্প্রতি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে নবী হোসেন এবং তার সহযোগীদের নাম উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে নবী হোসেনকে মাদক পাচারের মূলহোতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উখিয়া ক্যাম্পের ৮-ইস্টের বাসিন্দা মো. ইসলাম বলেন, ‘আগে আরসা আর এখন নবী হোসেনের গ্রুপের ভয়ে আছি। ক্যাম্পে নবী হোসেনের সদস্যরা ভিন্ন কৌশলে সক্রিয়। তার দলে নারীও আছে। সবার হাতে অস্ত্র আছে। তবে পুলিশের তৎপরতায় ইতোমধ্যে তার অনেক সহযোগী ক্যাম্প ছেড়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৮ এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. কামরান হোসেন বলেন, ‘ক্যাম্পে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নবী হোসেন মাদক ব্যবসায়ী এবং তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার প্রধান কাজ মিয়ানমার থেকে মাদক এনে বাংলাদেশে বিক্রি করা। একাধিক সংস্থা তার বিষয়ে কাজ করছে। তারাও প্রমাণ পেয়েছে। ইতোমধ্যে তার সহযোগীদের শনাক্ত করতে পেরেছি আমরা।’
তিনি বলেন, ‘নবী হোসেন ক্যাম্পে নেই। তাকে আমরা খুঁজছি। তার স্বজনদের নজরদারিতে রেখেছি। শুধু নবী হোসেন নয়, সব দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছি। গত এক বছরে ১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২১৪টি দেশি অস্ত্র উদ্ধার করেছি। এসব ঘটনায় ২৯৫ মামলায় ৮০৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
নবী হোসেন এখন কোথায়?
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে নবী হোসেন বর্তমানে মিয়ানমারের নাফ নদীর তোতাল দ্বীপ ও কোয়ানচিমং (যা হোয়াইক্যংয়ের কাছে) নামক স্থানে বসবাস করছে। সেখানে একজন জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে তিনটি বড় বড় চিংড়ির ঘের লিজ নিয়ে মাছ চাষের নামে মাদক ও চোরাচালান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে গরু ও মহিষের খামার রয়েছে। তার গ্রুপের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে। দুই দেশে তার অনুসারী আছে। তার গ্রুপের সদস্যরা ক্যাম্পে মাঝেমধ্যে ত্রাণ দেয়। ত্রাণের ছবি ও ভিডিও তুলে সেগুলো ‘মানবিক নবী হোসেন’ দাবি করে রোহিঙ্গাদের পরিচালিত ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করা হয়। এমনকি ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে তার গ্রুপের সদস্যরা।
পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘কক্সবাজারের বড় সমস্যা এখন রোহিঙ্গা। আমাদের প্রতিনিয়ত প্রাণের ভয়ে থাকতে হয়। কারণ ক্যাম্পজুড়ে রয়েছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। দ্রুত সময়ে এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা না হলে সামনে ভয়াবহ দিন আসবে। পাশাপাশি ক্যাম্পে থেকে রোহিঙ্গাদের পরিচালিত সব ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে ফেসবুক পেজ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
পুলিশ বলছে, নবী ও তার গ্রুপের সঙ্গে ক্যাম্প-২২ (উনচিপ্রাং) এ একসময় আধিপত্য বিস্তারকারী ইসলাম গ্রুপের জিয়াবো, কালাপুতু, গুনাইয়া, রাইউল্লাহর সখ্যতা রয়েছে। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর উখিয়া থানায় ডাকাতের প্রস্তুতিসহ অস্ত্রের মামলায় কারাভোগও করেছিল নবী। তিন বছর আগে আরএসও ছেড়ে বাহিনী গড়ে তোলে। কিছু সময় আরসা তাকে অর্থ সহায়তা দিতো। যখন থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করা হয় তখন থেকে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যত বড় অপরাধী হোক ক্যাম্পে ঠাঁই হবে না। নবী হোসেনসহ সব অপরাধীকে ধরতে আমাদের অভিযান চলছে।’
ক্যাম্পে বসবাসকারী আরএসও’র সাবেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নবী হোসেন ছিল আরএসও’র কমান্ডার। এখন আলাদা গ্রুপ রয়েছে তার। পাশাপাশি এখানে বেতনভুক্ত সোর্স হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করছে অনেকে। এজন্য তাকে ধরা যায় না।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন