‘ধূসর পাহাড়ের’ শিল্পী জয়তুর জয়

fec-image

লেখার বদলে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্কের খাতা ভরা থাকত ছবিতে। শুধু খাতা কেন, কোনো কাগজ পেলেই ছেলেটা ছবি আঁকত। এ জন্য অবশ্য মা-বাবা কখনো বকাঝকা করেননি; বরং উৎসাহ দিয়েছেন। ছেলেটার আঁকা ছবিতে থাকত তাঁর দেখা চারপাশ। পাহাড়-জুম খেত-জুমিয়া-বসতবাড়ি আর কাপ্তাই লেক।

নৌকাযোগে ওই কাপ্তাই লেক পাড়ি দিয়েই যেতে হয় মোবাছড়ি; যেখানে শিল্পী জয়তু চাকমার জন্ম, যেখানে আজও সরবরাহের বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। অথচ এই কাপ্তাই লেক করার জন্য পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয় গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। ভেসে যায় লক্ষাধিক পাহাড়ি মানুষের জমি ও আবাসস্থল। সেই দুর্দশা, উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো প্রকল্পের অভিঘাত, পাহাড়ি মানুষের দুর্গতি বারবার উঠে এসেছে জয়তু চাকমার ছবিতে। এই যুবকের এসব ছবি এ বছর জাতিসংঘের একটি সংস্থার পুরস্কার জিতেছে। বিশ্বের আট ‘সংখ্যালঘু শিল্পী’র মধ্যে ছিলেন রাঙামাটির জয়তু চাকমা। পুরস্কার সম্প্রতি নিয়েও এসেছেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে। সেসব কথায় পরে আসছি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার–বিষয়ক হাইকমিশনারে কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে জয়তুর পুরস্কার জয়ের কথা জেনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। কথামতো রাজধানীর কাজীপাড়ায় একটি রেস্তোরাঁয় তাঁর সঙ্গে কথা হয় মধ্য অঘ্রানের এক বিকেলে।

বাবা প্রভাত কিশোর চাকমা ও মা বুদ্ধমালা চাকমার দুই ছেলের মধ্যে ছোট জয়তু চাকমা। রাঙামাটি সদর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে জয়তুদের বাড়ি প্রায় আধঘণ্টার পথ। গ্রামের স্কুলেই পড়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। প্রতি শুক্রবার বাড়িতে থাকা নৌকা চালিয়ে জয়তুকে তাঁর বাবাই নিয়ে যেতেন রাঙামাটি চারুকলা একাডেমিতে। সেখানে শিল্পী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার কাছেই ছবির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু। এএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন রাঙামাটি থেকে। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। সেখান থেকে পেইন্টিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ঢালী আল মামুন ও অলোক রায়ের সাহচর্য তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে, স্বীকার করেন জয়তু। এরপর বৃত্তি নিয়ে যান রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর দেশে ফিরে ঢাকাতেই থিতু হয়েছেন। তবে ছবির অনুষঙ্গ এখনো সেই পাহাড়।

এ শিল্পীর কাজগুলোর একটা বড় অংশজুড়েই কাপ্তাই লেক ও ধ্বংসের মুখে থাকা প্রকৃতি। লেকের পানিতে জয়তুদের আদি বাড়িটিও নিমজ্জিত হয়েছিল। সেই গল্প তিনি শুনেছেন বাড়ির বয়স্কদের কাছে। লেক এখন ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের বড় আকর্ষণের স্থান। কিন্তু তাঁর এক ছবিতে দেখি ত্রিভুজাকৃতির ফ্রেমের মধ্যে গোলাকার এক জলাশয়। সেখানে একজন ডুবে আছে। দেখা যাচ্ছে তার হাতটুকু। সেই হাতও বাঁধা সুতায়।

জয়তু বলছিলেন, ‘যেভাবে পাহাড়ের বাইরের মানুষ কাপ্তাই লেককে দেখেন, আমরা পাহাড়িরা তো সেভাবে দেখি না। এই সৌন্দর্য উৎপন্ন করতে গিয়ে লক্ষাধিক পাহাড়ি উদ্বাস্তু হয়েছেন। আমি তাঁদের কথাই বলতে চেয়েছি।’

পাহাড় তো সবুজ হয়। মূলত তার গায়ের সবুজ গাছগাছালিই এই রং ছড়ায়। সেই পাহাড়ের বুকে থাকে ঝরনা। গাছে বাসা বাঁধে হরেক রঙের পাখি। কিন্তু জয়তুর ছবির পাহাড়ের বেশির ভাগই বিবর্ণ, ধূসর। এমন এক ছবিতে দেখি, গাছহীন বিবর্ণ পাহাড়। রক্ত ঝরছে তার বুক থেকে। পাহাড়ের ঠিক মাথায় একাকী এক রংরাঙ পাখি বসে আছে।

জয়তুর পাহাড় বিবর্ণ কেন? শিল্পীর জবাব, ‘এখন পাহাড় অনেক উন্নত। পাহাড়ের সীমানায় এখন যান চলাচলের রাস্তা। এখন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সুইমিংপুলের শীতল জলে সাঁতরানো যায়। কিন্তু তার বদৌলতে পাহাড়িরা কী পাচ্ছে?’

জয়তু এসব প্রশ্নই তোলেন তাঁর ছবিতে। ওএইচসিএইচআরের যে পুরস্কার জয়তুসহ আটজন শিল্পী পেয়েছেন, তাঁরা সবাই-ই নিজ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। ওএইচসিএইচআর বলেছে, এসব শিল্পী শুধু শিল্পী নন, একেকজন মানবাধিকারকর্মী। তাঁরা তাঁদের আত্মপরিচয়কে উন্মোচন করেন রঙে, ভাস্কর্যে নানা ঢঙে।

‘ইন্টারন্যাশনাল মাইনরটি আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড’–এর ‘ইয়ুথ’(তরুণ) ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন জয়তু। তাঁর ছবি প্রসঙ্গে ওএইচসিএইচআরের চিত্র প্রতিযোগিতার বিচারকেরা বলেছেন, ‘তাঁর শিল্পকর্মে পার্বত্য চট্টগ্রামের না–বলা মর্মান্তিক নানা কথা, পাহাড়ের মানুষের নিরন্তর সংগ্রামের চিত্র ফুটে ওঠে।’

জয়তুর ছবির সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পরিচিত আরেক গুণী পাহাড়ি শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা। তিনি বলছিলেন, ‘পাহাড়ের ধ্বংস হতে থাকা প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র—এই সবই ও তুলে ধরে ভিন্নমাত্রায়। দেখবেন ওর সব ছবি ত্রিভুজাকৃতির। অর্থাৎ একটা পাহাড়ের আদল ও দেওয়ার চেষ্টা করে ফ্রেমেও। এটা আমি খুব কম দেখেছি।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবন ও প্রকৃতিকে রংতুলিতে তুলে ধরার ইতিহাস একেবারে নতুন নয়। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে শিল্পী চুনীলাল দেওয়ান এর পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সহকর্মী। চুনীলাল দেওয়ান কলকাতা আর্ট কলেজেরও ছাত্র ছিলেন। আর জয়তু যে পুরস্কার পেয়েছেন, এর আগে তুফান চাকমা নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একজন শিল্পী পেয়েছিলেন। চিত্রকলার ক্ষেত্রে তুফান ও জয়তুদের এসব আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাহাড়ের তরুণদেরও আকৃষ্ট করবে বলেই মনে করেন শিল্পী কনক চাঁপা।

সূত্র: প্রথমআলো

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন