parbattanews

নাইক্ষ্যংছড়িতে যৌথবাহিনী-শান্তিবাহিনী বন্দুকযুদ্ধের অজানা কাহিনী

নাইক্ষ্যংছড়িতে যৌথবাহিনীর অপারেশন

বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নের বাকখালী মৌজার ছাগল খাইয়া এলাকার কামিরমুখ চাকপাড়া এলাকায় ১ সেপ্টেম্বর বুধবার সকাল ১০ টা থেকে ১২টা পর্যন্ত যৌথবাহিনীর সাথে পাহাড়ি সন্ত্রাসী জেএসএস এর গুলি বিনিময়ের ঘটনায় বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনেও যৌথ বাহিনীর অভিযান চলেছে। তবে এদিনে আর কোনো গুলির শব্দ শোনা যায়নি বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার বিজিবির পাঠানো এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে দাবী করা হয়েছে, যৌথ বাহিনীর অভিযানে সন্ত্রাসীদের আস্তানা ও অবস্থান অনুসন্ধানে ড্রোন প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হয়েছে।

বিজিবির উপ পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম ভূ্ঞা পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “ বান্দরবান রিজিয়ন পরিচালনা প্রসঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, নারী ও শিশু পাচার রোধ ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনে নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন (১১ বিজিবি) শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এরই ধারাবাহিতকতায় সম্প্রতি দোছড়ি এবং বাইশারী ইউনিয়ন এলাকায় জেএসএস সশস্ত্র দলের সন্ত্রাসীদের আনাগোনা ও দৌরাত্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদেরকে গ্রেপ্তার/নির্মূল করার লক্ষ্যে বান্দরবান সেনা রিজিয়নের নির্দেশনা মোতাবেক নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন (১১ বিজিবি) কর্তৃক গত ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ হতে ২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত একটি বিশেষ অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছে।

উক্ত অপারেশনের অংশ হিসেবে গত ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন (১১ বিজিবি) এর অধিনায়ক বিএ-৪৯৪৯ লে. কর্নেল শাহ আবদুল আজীজ আহমেদ, এসপিপি এর নেতৃত্বে ২ জন অফিসারসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র সমন্বয়ে সর্বমোট ৬ টি টহল দল বিশেষ অপারেশেনের উদ্দেশ্যে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি এবং বাইশারী ইউনিয়ন এলাকার মধ্যবর্তী স্থান হাতিরঝিড়ি/চাকপাড়া এলাকায় গমন করেন।

উক্ত এলাকায় গমনের পর সশস্ত্র সন্ত্রাসী/জেএসএস সদস্যরা বিজিবি টহল দলের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তৎক্ষণাৎ অপারেশন কমান্ডারের নির্দেশনা মোতাবেক বিজিবি টহল দল কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘেরাও করে রাখে। পরবর্তীতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী/জেএসএস সদস্যরা পালাতে না পেরে বিজিবি সদস্যদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ী গুলিবর্ষণ করে। জবাবে বিজিবি টহল দল তাদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে।

অতঃপর বিজিবি টহল দলের সমন্বিত আক্রমণে সন্ত্রাসী দল পাহাড়ী ঘন জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকে। বিজিবি টহল দল তাদেরকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে উক্ত এলাকাটি রাতভর ঘেরাও করে পাহারা দেয়। উক্ত অপারেশনের অংশ হিসেবে আজ ২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে চাকপাড়া এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী/জেএসএস এর আস্তানা এবং তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার জন্য উন্নত প্রযুক্তি (ড্রোন) ব্যবহার করে ব্যাপক তল্লাশী (সার্চ) করে কোন আলামত পরিলক্ষিত হয়নি ।

পরবর্তীতে বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপারেশন দল বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বর্ণিত এলাকায় সরেজমিনে তল্লাশী (সার্চ) করা হয়। সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধ অস্ত্র, অবৈধ কাঠ পাচার ও পরিবহন, মাদকদ্রব্য পাচার, অন্যান্য যে কোন ধরনের অবৈধ পণ্য সামগ্রী পাচার, চাঁদাবাজি এবং এই এলাকায় যে কোন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে বিজিবি’র এ ধরনের কার্যক্রম ও তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। ”

এদিকে নাইক্ষ্যংছড়িতে এই গুলি বিনিময়ের পর পার্বত্যনিউজ একাধিক প্রতিনিধির মাধ্যমে ঘটনাস্থলে সরেজমিনে ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। এর অংশ হিসেবে স্থানীয় এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি, কৃষক, রাবার শ্রমিক, বাবার ফার্মের মালিক, যৌথ বাহিনীর সাথে গুলিবিনিময়ের সময়কালীন প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সাথে কথা বলে। তবে নিরাপত্তা সংকটের কারণে স্থানীয়দের কেউই গণমাধ্যমের কাছে পরিচয় প্রকাশে রাজী হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও রাবার বাগানের শ্রমিকরা পার্বত্যনিউজকে জানায়, বিগত কিছুদিন যাবত নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দৌছড়ি ইউনিয়নের কামির মুখ, লংগদু, ছাগল খাইয়া, বাইশারী ইউনিয়নের আলিক্ষং মৌজার বিভিন্ন এলাকায় জলপাই রংয়ের পোশাক পরিহিত ১৫/২০ জনের সশস্ত্র লোকজন নিজেদের শান্তিবাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে ভারী অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। স্থানীয়রা অনেকেই তাদের জেএসএস সশস্ত্র গ্রুপের কমান্ডার কাজল তঞ্চঙ্গা গ্রুপের লোক বলে সনাক্ত করেছে।

সন্ত্রাসীরা কৃষকদের সাফ জানিয়ে দেয় পাহাড়ে গাছ, বাঁশ কাটতে হলে চাঁদা দিতে হবে। যারা ব্যবসায়ী রয়েছে তাদের অবশ্যই যোগাযোগ করতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ে যাদের রাবার বাগান রয়েছে তাদের প্রতি একর ৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। অন্যথায় বাগান থেকে রাবারের কষ আহরণ করতে দেওয়া হবে না।

গত ১ সপ্তাহ আগে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বাগানে গিয়ে বাকখালী মৌজায় অবস্থিত বাগান শ্রমিকদের তাড়িয়ে দেয় এবং বলে দেয় মালিক যতদিন চাঁদা না দিবে ততদিন বাগান বন্ধ থাকবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তারা দেখতে সুন্দর, সকলেই অল্প বয়সের। তবে কমান্ডার যিনি মেজর হিসেবে পরিচিত, তার বয়স ৪০ এর কাছাকাছি হবে। সকলেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। চেহারা ও কথার ধরণ থেকে শ্রমিকদের ধারণা এরা চাকমা ও তঞ্চঙ্গা সম্প্রদায়ের ধারণা করা হচ্ছে চাকমা বা তঞ্চঙ্গা সম্প্রদায়ের হতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী পার্বত্যনিউজকে জানান, তাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক মরণাস্ত্র। এনিয়ে স্থানীয় বাগান মালিক ও গাছ, বাঁশ ব্যবসায়ীরা প্রচণ্ড আতঙ্কে রয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, চাঁদা দেয়ার পরও সন্ত্রাসীরা শ্রমিকদের কাজে ফিরতে দেয়নি এবং তারাও তাদের অবস্থান থেকে সরে যায়নি। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সন্ত্রাসীদের মূল উদ্দেশ্য চাঁদাবাজী ছিলো না। তারা মূলত এই সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারের সাথে সংযোগ ও রুট স্থাপনের চেষ্টা করছিল। যার মাধ্যমে তারা মিয়ানমারে গমনাগমন, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের কাজে ব্যবহার করতে সচেষ্ট ছিলো।

এ বিষয়টি বুঝতে পেরে যৌথ বাহিনী গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্ত্রাসীদের অবস্থান চিহ্নিত করে অপারেশন পরিচালনা করে এবং একেবারে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় পৌঁছে যায়। এবং সন্ত্রাসী আচমকা তাদের আস্তানার খুব নিকটে যৌথ বাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে দিশেহারা হয়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলে নিরাপত্তা বাহিনীও পাল্টা গুলিবষর্ণ শুরু করে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বেঁধে যায় যা দুই ঘণ্টা ব্যাপী স্থায়ী হয়। এক পর্যায়ে যৌথ বাহিনী তাদের অবস্থান আরো শক্তিশালী করলে সন্ত্রাসীরা যৌথ বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে লামা আলীকদম সীমান্তের দিকে সরে যেতে শুরু করে।

এদিকে উক্ত ঘটনায় বুধবার সকাল থেকে পাহাড়ের ভিতর সেনাবাহিনী ও বিজিবি যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করার সময় সন্ত্রাসীরা যৌথবাহিনীকে লক্ষ করে গুলি করায় যৌথবাহিনী পাল্টা গুলি চালালে একজন সন্ত্রাসী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে জানা যায় এবং বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরটি জানা যায়। তবে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।

তবে অনুসন্ধানের সময় একটি সূত্র পার্বত্যনিউজকে জানায়, অভিযানের পরে পাহাড়ি কিছু নতুন মুখ পার্শ্ববর্তী বাজার ও রাস্তাঘাট এলাকায় গাড়ীতে করে বিভিন্ন বাজার ঘাটে যাওয়া আসাসহ গাড়ীতে করে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে। উক্ত ঘটনায় স্থানীয় লোকজনের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় লোকজনের দাবী এই সাদা পোশাকের লোকজনকে নজরদারি করা হউক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, পাহাড়ি সন্ত্রাসী ধরতে চিরুনি অভিযান চালানো হবে এবং বর্তমানে পাহাড়ি সন্ত্রাসী ধরতে যৌথ বাহিনীর কয়েকটি দল পৃথক পৃথক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে স্থানীয় একজন প্রত্যক্ষদর্শী পার্বত্যনিউজকে জানায়, সামনে শুকনো মৌসুমে তামাক চাষ, গাছ ব্যবসা, সবজি চাষ, রাবার বাগানের কষ বৃদ্ধির আগেই চাঁদা আদায়ের জন্য স্থানীয় কিছু উপজাতীয় সন্ত্রাসীর সহযোগিতা নিয়ে এরা প্রতি বছর লামা উপজেলার বনপুরু, গয়াল মারা, তীরের ডীব্বা, সাপের গারা, নাইক্ষংছড়ি উপজেলার আলিক্ষং, লংগদু, বাকখালীর কামিরমুখ, ছাগলখাইয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরাঘুরি করে ও চাঁদা আদায় করে থাকে।

একাধিক ব্যবসায়ী পার্বত্যনিউজকে জানান, তাদেরকে জেএসএস এর মেজর পরিচয় দিয়ে মোবাইলে টাকার জন্য ফোন করেছে। টাকা না পরিস্থিতি খারাপ করে দিবে বলে ও অনেককে হুমকির মাধ্যমে জানিয়েছেন।

দৌছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ হাবিবউল্লাহ পার্বত্যনিউজকে এ অপারেশনের ব্যাপারে জানান, যৌথ বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনা প্রায় মানুষই শুনেছে। সন্ত্রাসীর কিছু সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। উক্ত ঘটনায় স্থানীয় লোকজনের মনে আতংক বিরাজমান রয়েছে।

Exit mobile version