parbattanews

নীরবে চলে যাওয়া একজন সোনা মিয়ার দীর্ঘশ্বাস ও হতাশার গল্প

গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসিত পার্বত্য বাঙালিদের নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন আন্দোলনের অগ্রজ পুরুষ দীঘিনালার সেই বাঙ্গালী নেতা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সোনা মিয়া আর নেই। হতাশা, দীর্ঘশ্বাস ও অতৃপ্ত মন নিয়ে পরপারে চলে গেছেন। তবে রেখে গেছেন, বাঙালিদের অধিকার আদায় আন্দোলন-সংগ্রামের বহু স্মৃতি।

তিনি ছিলেন, বাবুছড়াস্থ সোনামিয়া টিলার ৮১২ বাঙালি পরিবারের দলপতি ও বাঙালি নেতা।
পারিবারিক সূত্র জানায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শনিবার(১৮ জানুয়ারি) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

তিনি শুক্রবার(১৭ জানুয়ারি) বুকে ব্যাথা অনুভব করলে তাকে প্রথমে দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকগণ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেলে প্রেরণ করা হয়।

সোনামিয়া ১৯৫৬ সনে ঢাকার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন| তার পিতার নামঃ মৃত আইনুদ্দিন শেখ| সোনামিয়া ২৬-২৭ বছর বয়সে প্রথমে রাঙ্গামাটি আসেন| পরে সেখান থেকে দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়ায় ৮শত ১২ পরিবার নিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন|
পরবর্তীতে ১৯৮৬ সনে পরে আবার বোয়ালখালী এলাকায় বসবাস করেন|

৯০দশকে তিনি আওয়ামীলীগ করলেও পরবর্তীতে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যোগদান করেন| তিনি বর্তমানে দীঘিনালা উপজেলা বিএনপির সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন| দাম্পত্য জীবনে তিনি দুটি বিয়ে করেন| প্রথম সংসারে তিন ছেলে তিন মেয়ে রয়েছে এবং দ্বিতীয় সংসারে দুই ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে|

পাহাড়ে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী বাঙ্গালীর অধিকার ও শিক্ষার জন্যে সার্বক্ষণিক কাজ করে গেছেন, সোনামিয়া শেখ| তিনি দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়ায় গড়ে তোলেন ” সোনামিয়া টিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়”| ১৯৮২ সনে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি তার অনন্য কৃর্তী হিসেবে এখনো টিকে আছে| এছাড়াও তিনি দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন|

তাঁর মৃত্যুতে দীঘিনালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ কাশেম গভীর শোক প্রকাশ করেছেন, উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ মোসলেম উদ্দিন, মেরুং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ রহমান কবির রতন এবং দীঘিনালা উপজেলা পার্বত্য নাগরিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের পক্ষ হতে রুহের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। গত শনিবার রাতে সোনামিয়া চেয়ারম্যান এর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়|

দীঘিনালা সদর উপজেলা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত সোনা মিয়া টিলা। সোনা মিয়ার নামেই এই টিলার নামকরণ। এখানে রয়েছে বাঙ্গালীদের বাপ- দাদার কবরস্থান এবং বাগান-বাগিচা ও রয়েছে “সোনা মিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়”। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ এই সব শুধুই স্মৃতি। বাঙ্গালীদের সে বসত ভূমি আজ উপজাতীয়দের জবরদখলে । সেখানে বাঙ্গালীদের প্রায় ৩শ একর বসত ভূমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে “ সাধনা বৌদ্ধ বিহার” নামে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সে সাথে “সোনা মিয়া টিলার” নাম রাতারাতি পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে “সাধনা” পাহাড় নামে।

১৯৮১-৮২ সাল থেকে “সোনা মিয়া টিলায়” ৮শ ১২টি বাঙ্গালী পরিবার বসবাস করে আসছিল। বাঙ্গালীরা এখানে তিল, তিল করে তোলে তাদের স্বপ্নের বাগান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সোনা মিয়া চেয়ারম্যানের এর নামে এ এলাকার নাম রাখা হয় “সোনা মিয়া টিলা”। এক সময় তাদেরও বসত বাড়ী, বাগান-বাগিচা, মাছের পুকুর ও পশুপালন ছিল। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ সুখের জীবন ছিল তাদের।

কিন্তু উপজাতীয়দের একটি উগ্র গোষ্ঠী তা সহ্য করতে পারেনি। তাই বাঙ্গালীরা তাদের টার্গেটে পরিণত হয়। সশস্ত্র উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা অসহায় বাঙ্গালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা ও তাদের বাড়ী-ঘরে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ লুন্ঠনসহ সব ধরনের অত্যাচারের শিকার হয় বাঙ্গালীরা। এমন কি সরকারও এদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়।
৯৮৬ সালে সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য স্থানের মত এখানকার বাঙ্গালীদেরও গুচ্ছ নামক ‘বন্দীশিবিরে’ আবদ্ধ করে। কথা ছিল পরিস্থিতি শান্ত হলে এদের আবার নিজ বসত ভূমিতে পূর্নবাসন করা হবে।

কিন্তু গত প্রায় দেড় যুগেও এসব পরিবার গুলোকে স্ব-স্ব ভূমিতে পূর্নবাসন করা হয়নি। এদিকে গুচ্ছগ্রামে বসবাসকারী সেদিনের দুই জনের পরিবার আজ ৮-১০ জনে পরিনত হয়েছে। একটি ছোট্র কুড়ে ঘরে একুই কক্ষে পিতা-মাতার সাথে ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে বাস করছে।

এদিকে বাঙ্গালীদের অনুপুস্থিতিতে “সোনা মিয়া টিলাটির” উপর নজর পড়ে পাশ্ববর্তী গ্রামের উপজাতীয়দের। ২০০৫ সালে বাঙ্গালীরা যখন নিজ বসত ভূমিতে ফিরে যেতে শুরু করে ঠিক তখনী উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে তাড়িযে দেয় এবং রাতারাতি বাঙ্গালীদের প্রায় ৩শ একর বৈধ জায়গা দখল করে “সাধনা বৌদ্ধ বিহার” নামে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে। সম্প্রতি কিছু বাঙ্গালী পরিবার “সোনা মিয়া টিলা” এলাকায় ফিরে গিয়ে ঘর-বাড়ি নির্মাণ শুরু করলে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা এসে ভেঙ্গে ফেলে। ফলে পাহাড়ী বাঙ্গালীর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশাসন সেখানে স্থিস্তাবস্থা জারি করে।

কিন্তু সশস্ত্র উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের প্রহরায় বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ কাজ চালিয়ে যায়। ১৯৮৩ সালে স্থাপিত “সোনা মিয়া টিলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়” এখনো কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সেখানে নেই বাঙালিদের কোন অস্তিত্ব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সোনা মিয়ার নেতৃত্বে নিজের ভূমি ফিরে পেতে বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সহায়তার অভাবে ৮শ ১২টি বাঙ্গালী পরিবার নিজেদের বৈধ ভূমিতে ফিরে যেতে পারেনি।

পার্বত্য চট্রগ্রামে গুচ্ছগ্রাম রয়েছে ৮১টি। ‘সোনা মিয়া টিলার’ মত এক মুঠো ভাতের জন্য যুদ্ধ করছে গুচ্ছগ্রাম নামক অন্যান্য বন্দি শিবিরের বাঙ্গালীরা। এসব গুচ্ছ গ্রামে বাস করে প্রায় ৫৩ হাজার পরিবার। এর মধ্যে ২৬ হাজার ২শ ২০ পরিবার কার্ডধারী, অবশিষ্ট ২৬ হাজার ৮শ ৮৪ পরিবার কার্ড বিহীন। নামে গ্রচ্ছগ্রাম হলেও এটি আসলে একটি ঘিঞ্জি বস্তি। উপড়ে ছন ও বাশেঁর বেড়া দিয়ে নির্মিত ঘর গুলো একটির গায়ে আরেকটি লাগানো। ৫-৬ জন সদস্যের একটি পরিবারের জন্য একেকটি। বসবাস, রান্না, পায়খানা ও পশুপালন সবই এ ঘরের মধ্যে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। টিলাভূমি জুড়ে বস্তি সাদৃশ্য উদ্বাস্তু শিবিরে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে।

গুচ্ছগ্রামে বসবাসকারী কার্ডধারী পরিবারের জন্য সরকার প্রতি মাসে ৮৬ কেজি করে রেশন বরাদ্দ দেয়। তার মধ্যে অর্ধেকটা গম, অর্ধেকটা চাল। যাদের কার্ড নেই তাদের অবস্থা খুবই করুন। বেচেঁ থাকার মতো নূন্যতম সুযোগ তদের নেই। গুচ্ছগ্রামের আশ-পাশে অসংখ্য বনাঞ্চল থাকলেও সেখান থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করবে সে সুযোগও নেই। গুচ্ছগ্রামের বাইরে গেলে উপজাতীরা সন্ত্রাসীরা তেড়ে আসে। গালি দেয়, ‘বহিরাগত, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও সেটেলারের বাচ্চা’ বলে। কুপিয়ে-গুলি করে হত্যা, জখম কিংবা চাঁদার জন্য অপহরণ করে।

গুচ্ছগ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাদের রেশন কার্ড তাদের কাছে নেই। পেটের দায়ে অনেকে তাদের একমাত্র সম্বল রেশন কার্ডটি দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে বন্ধক রেখেছে। পরিস্থিতি শান্ত হলে আমাদের স্ব-স্ব ভূমিতে পুর্নবাসনের কথা ছিল। গুচ্ছগ্রামবাসীর প্রশ্ন, যাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে আমাদের গুচ্ছ গ্রামে আনা হয়েছে তাদের সাথে চুক্তি হয়েছে দেড় যুগ পূর্বে। অথচ আমাদের এখনো নিজ বসত ভূমিতে ফিরে যেতে দেয়া হচ্ছেনা।

এদিকে বাঙ্গালীরা গুচ্ছগ্রামে থাকার কারনে তাদের ফেলে আসা বৈধ বসতভূমি ও জমি উপজাতীরা ইতিমধ্যে দখল করে নিয়েছে। গুচ্ছগ্রামে বসবাসকারীদের মাথার উপড় ঝুলছে সার্টিফিকেট মামলা। বাস্তবে খুবই করুন পার্বত্য বাঙ্গালীদের জীবন। এদের কান্না নির্জন পাহাড়ে প্রতিধবনি তুলে অন্তহীন হতাশার আর নিস্ফল আবেদন নিয়ে ফিরে আসে।

রাষ্ট্র এবং সংবিধান গুচ্ছ গ্রামের হতদরিদ্র বন্দী মানুষের সাধারন নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে স্পষ্টই অসহায়। বন্দী মানুষের সাধারন নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে স্পষ্টই ব্যর্থ। এর দায় কে নেবে?

Exit mobile version