পর্ব-১

পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপন কী পাহাড়ের সন্ত্রাস দমনের একমাত্র সমাধান?

fec-image

আমার মূল্যায়ন ভিন্ন। আমরা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম এবং কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশন না বুঝে মুখরোচক ফুচকার মত একটা দাবি করে বসলাম। ভাবলাম একশ’ হাত অন্তর ক্যাম্প বা চৌকী বসিয়ে দিলাম আর তাতে ভয় পেয়ে নাকবোচা সন্ত্রাসী সব গর্তে চলে গেল। অতো সহজ?

একটা উদাহরণ দেই- গত ১৬ এপ্রিল কাশ্মীরের পাহেলগামে সশস্ত্র হামলায় যখন ২৩ জন পর্যটক মারা গেল তার আশেপাশেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল। আপনি এক জায়গায় যত শক্তি নিয়েই অবস্থান করুন না কেনো সন্ত্রাসী হামলা কখন কোথায় হবে তার ‘নির্ণায়ক’ কিন্তু সন্ত্রাসী। আপনি প্রতি ইঞ্চি জায়গা পাহারা দিতে পারবেন না। এটা ফুটবল খেলার ফ্রি কিকের মত। দশ জনের দেওয়াল ভেদ করেও মেসী রোনালদো গোল করতে পারে।

গত ৫০ বছর ধরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সেনাবাহিনী দেখে তার সাথে সমানে অ-সমানে লড়াই করে, গা ঘেষাঁ-ঘেষীঁ করে জানে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা। আমাদের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা যা আমরা জানি না তা হলো এর আইনি সুরক্ষা। আমি কোন আইন কোন ক্ষমতা বলে অভিযান চালাবো? আমার ম্যান্ডেট কি? আমি যখন নিজ দেশের একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক বল প্রয়োগ করতে যাব, তার জন্য আমাকে রাষ্ট্র প্রদত্ত ক্ষমতা থাকতে হবে। এ কথা শুনে অনেকের চোখ কপালে, বলে কি? তাহলে এতো দিন সেনাবাহিনী কীসের বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশন করছে?

উওর সহজ, ‘ইন এইড অফ সিভিল পাওয়ার’। আরেকটু বর্ধিত করে বললে- ইন রেসপন্স টু সেলফ ডিফেন্স। আমরা পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম সন্ত্রাসীরা অকস্মাৎ আমাদের উপর গুলি বর্ষণ করে, আমরা আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা গুলি বর্ষণ করলে ৩ জন সন্ত্রাসী মারা যায়।

ভারতে নাগারা বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে ১৯৫৬ সালে সেনাবাহিনী নিয়োগ করে নেহেরু। সেনাবাহিনীকে বিপুল ক্ষমতা দিয়ে আইন পাশ করে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট। সেই আইন এখনো বলবৎ আছে নাগাল্যান্ডে। ভারতীয় সেনারাও নিয়োজিত আছে। সেনাবাহিনীর  নানান বিচ্যূতি সত্বেও কখনো ভারতের মিডিয়া এবং জনগণ শ্লোগান ধরে না “সেনা হটাও”। ভারতের সেনাবাহিনী শক্ত রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে রাজনৈতিক দলের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে কাশ্মীর সহ উওর-পূর্ব ভারতে নিয়োজিত আছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিদ্যমান বাস্তবতায় পুলিশকে সাথে নিয়ে অভিযানে যেতে হয়। খানা তল্লাশি ও গ্রেফতারের কাজটি পুলিশ করে। সেনাবাহিনী এককভাবে কোনো গৃহে প্রবেশ করে না। করলেই স্বর্নলংকার লুট না হয় কোনো নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করে বসবে হিল ইউমেন্স ফেডারেশন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এককভাবেই সন্ত্রাস দমনের কাজটি করতে হয়। এখানে রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে না তখন গুপ্ত  সন্ত্রাসীদের মাতৃ সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকদের মদদ দেয়। অপপ্রচার মোকাবিলা করে কাজ করতে হয়। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক বাম সংগঠনগুলোর উপর ভর করে চলে গুপ্ত সশস্ত্র দলের ছাত্র সংগঠনগুলো। এদের মিছিল সমাবেশে পাহাড়িদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। এই সব ‘বদ বাম’দের আবার সম্মানীয় আসনে দেখা মেলে পাহাড়িদের কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। গলায় ‘আদিবাসী’ মোটিফযুক্ত উত্তরীয় পড়ে পাহাড়ি নারীদের পাশে এরা হাসি মুখে বসে থাকেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে হঠাৎ করে  সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয় ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপটে শান্তি বাহিনী অকস্মাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্র থানা ফাঁড়ি ফরেস্ট অফিস সহ সরকারি স্হাপনায় আক্রমণ শুরু করলে তা ঠেকাতে সরকারের কোনো কার্যকর ফোর্স ছিল না। আগস্ট পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে ছিল নানান বিশৃঙ্খলা।  অফিসার, সৈনিক, সরঞ্জাম অস্ত্রসহ সব কিছুর কমতি ছিল। পরিবহনের জন্য সেনাবাহিনীর নিজস্ব কোনো হেলিকপ্টার ছিল না।

যে সব ইউনিটকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত করা হয় তাদের অনেক সদস্যই ছিল রক্ষীবাহিনী থেকে আত্মীকৃত এবং কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশন তো দূরে থাক পাহাড়ের ভূমি পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সেনাবাহিনীকে নিজস্ব ক্যাম্পের নিরাপত্তা বিধান করা ছাড়াও চলাচলের পথের নিরাপত্তার জন্য অনেক সদস্যকে নিয়োজিত রাখতে হতো। সব সময় তা করা হতো না বলেই ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত সময়ে সেনাবাহিনীর টহল দলকে শান্তি বাহিনীর  আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

সদ্য স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর তখন পাহাড়ে কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশনের অভিজ্ঞতা ছিল না। সেনাবাহিনী ঠেকে ঠেকে প্রতিটি ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের রণকৌশল ঠিক করে সামনে এগিয়েছে। শান্তিবাহিনীর তখন নব যৌবন, ভারতের প্রশিক্ষণ অস্ত্রসস্ত্রে তারা বলীয়ান সাথে, বিপুল জনসমর্থন।

সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে পাহাড়ে ক্যাম্প বাড়িয়ে, সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে পুলিশ সীমান্তরক্ষী আনসার-ভিডিপিকে সংযুক্ত করে স্ট্যাটিক পোস্ট থেকে সৈন্য উঠিয়ে অ্যাকটিভ কম্ব্যাটে নিয়োজিত করে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনে। ধীরে ধীরে নিরপত্তা বলয়ের পরিধি বড় হতে থাকে।

তরুণ অফিসারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় টহল বা আভিযানিক দলের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। একই সাথে গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি, পাহাড়িদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সূচনা, সন্ত্রাসীদলের আভ্যন্তরীন কোন্দল থেকে সুবিধা আদায়, বেসামরিক প্রশাসনকে সম্পৃক্তকরণ, লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধিসহ সার্বিক কার্যক্রমে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় পাহাড়ের পরিস্থিতি শান্তি আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে। এটাই সেনাবাহিনীর কাজ। বাকী কাজটা রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য শান্তি আলোচনায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অনভিজ্ঞতা, অজ্ঞতা, তড়িৎ বাজিমাত করার মানসিকতা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জসমুহকে না বোঝার কারণে কোন পর্যায়েই এই সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ কোন সামরিক ব্যক্তিকে না রেখে যারা পাহাড়ই চিনে না, কয়টা থানা আছে তাও বলতে পারবেন না এমন আবুল হাসনাতকে করেছে প্রধান সমন্বয়ক। যার বাড়ি বরিশালে। ফলে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।

যেসব কারণে আর পুরনো ক্যাম্পে ফেরত যাওয়া কঠিন এবং জটিল-
একটি উদাহরণ দেই, ১৯৯১-৯২ সালে ডানে আদ্রকছড়া (দিঘীনালা) যে ক্যাম্পটিতে আমি ছিলাম। তা এখন আর নেই। ২০১৯ সালে মাইনীমুখ যাওয়ার পথে কৌতূহল বশত সেই টিলার নীচে যেয়ে দেখি ওখানে হলুদ চাষ হচ্ছে। আলমগীর টিলা বলে একটা ক্যাম্প ছিল দিঘীনালাতে তা এখন কোন পাহাড়ির বসতবাটি। এই সব ছোট উদাহরণ বলে আবার সেই সব ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা নতুন করে কোন পাহাড়ির সাথে সংঘাতে যাওয়া।

আর যেখানে সেখানে জঙ্গল সাফ করে একটা ক্যাম্প তৈরি করে নিলাম তেমন বাস্তবতা এখন নেই।  ক্যাম্পের সাইট নির্ধারণ করার জন্য যে নিরাপত্তার ইস্যুগুলো দেখতে হয় তা সব স্পটে মেলে না। বর্তমানে পাহাড়িরা যেরকম সেনা বিদ্বেষী তাতে জোর করে তো নয়ই টাকার বিনিময়ে লীজও দেবে না দলের ভয়ে। তাই বলা যায় সব পুরাতন ক্যাম্পে আপনি ফেরত যেতে পারবেন না।

আর ঐসব ক্যাম্প তখনকার সময়ের যে সামরিক কৌশলের কথা বিবেচনায় রেখে করা হয়েছে তার প্রয়োজনীয়তা এখন হয়তো আর নেই। যেমন কোন একটা ক্যাম্প হয়তো তখন (২০/২৫ বছর আগে) করা হয়েছে নদী পথের উপর নজর রাখার জন্য। এখন সড়কপথে চলাচলের কারণে সেই স্পটটি আর যৌক্তিক নয়।

মনে রাখতে হবে ৪৫ বছর আগে যে জঙ্গল ইনসারজেন্সি শুরু হয়েছিল তখনকার রণকৌশল এই ডিজিটাল এআই’র যুগে ডিজিটাল আরবান ইনসারজেন্সিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
চলবে…

লেখক : পার্বত্য গবেষক ও সামরিক বিশ্লেষক

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: প্রবন্ধ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন