পাকুয়াখালি গণহত্যা: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
আতিকুর রহমান:
বনই হলো সন্ত্রাসী শান্তিবাহিনীর আখড়া। জীবিকার তাগিদে ঐ হিংস্র সন্ত্রাসীদের সাথে শ্রমিকরা গোপন সমঝোতা গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। তারা সন্ত্রাসীদের নিয়মিত চাঁদা ও আহরিত গাছ, বাঁশের জন্য মোটা অংকের সালামী দিতো। অনেক সময় মজুরীর বিনিময়ে শান্তিবাহিনীর পক্ষেও গাছ, বাঁশ কাটতো, এবং তা খরিদ বিক্রির কাজে মধ্যস্ততা করতো। ব্যবসায়ীরাও তাদের মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ ও লেনদেন সমাধা করতো। জীবিকার স্বার্থে তারা ছিলো রাজনীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক শ্রমিক মাত্র।
শান্তিবাহিনীর রেশন, ঔষধ, পণ্য ও লেনদেন সংক্রান্ত যোগাযোগ ও আদান-প্রদান এদের মাধ্যমেই পরিচালিত হতো। ঐ বাহিনীর অনেক গোপন ক্যাম্পে তাদের প্রয়োজনে আনাগোনা এবং ওদের কোন কোন সদস্যের ও শ্রমিক ঠিকানায় যাতায়াত ছিলো। এই যোগাযোগের গোপনীয়তা উভয়পক্ষ থেকেই বিশ্বস্ততার সাথে পালন করা হতো। উভয় পক্ষই প্রয়োজন বশতঃ পরস্পরের প্রতি ছিলো বিশ্বস্ত ও আস্থাশীল। এরূপ আন্তরিক সম্পর্কের কারণে পরস্পরের মাঝে বৈঠক ও যোগাযোগ নিঃসন্দেহে ও স্বাভাবিকভাবে ঘটতো। এ হেতু ৯ সেপ্টেম্বরের আগে মাহাল্যা অঞ্চলের নিকটবর্তী পাকুয়াখালি এলাকায় শান্তিবাহিনীর সাথে বৈঠকের জন্য নিহত ব্যক্তিদের ডাকা হয়। আহুত ব্যক্তিরা নিঃসন্দেহেই তাতে সাড়া দেয় এবং বৈঠকস্থলে গিয়ে পৌঁছে।
ঘটনাস্থল পাকুয়াখালি হলো, মাহাল্যাবন বীটভুক্ত বেশ কিছু ভিতরে পূবদিকে গহীন বন ও পাহাড়ের ভিতর জনমানবহীন অঞ্চল। মাহাল্যাসহ এতদাঞ্চল হলো উত্তরের বাঘাইছড়ি থানা এলাকা। আহুত লোকজন হলো দক্ষিণের ও নিকটবর্তী লংগদু থানা এলাকার বাসিন্দা। তাদের কিছু লোক হলো আদি স্থানীয় বাঙ্গালী আর অবশিষ্টরা হাল আমলের বসতি স্থাপনকারী। এই সময়কালটাও ছিলো শান্ত নিরূপদ্রব। স্থানীয়ভাবে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বিরোধ নিয়ে তখন কোন উত্তাপ উত্তেজনা ছিল না। এমন শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রতিশোধমূলক ও হিংসাত্মক কোন দুর্ঘটনা ঘটার কার্যকারণ ছিলো অনুপস্থিত।
এটি কার্যকারণহীন নির্মম গণহত্যা। এটি মানবতার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত নৃশংস অপরাধ। ন্যায় বিচার ও মানবতা হলো বিশ্ব সভ্যতার স্তম্ভ। জাতিসংঘ এ নীতিগুলো পালন করে। তাই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানদের হাতে গণহত্যার শিকার ইহুদীদের পক্ষে এখনো বিচার অনুষ্ঠিত হয়। এখনো ঘোষিত অপরাধীদের পাকড়াও করা হয়ে থাকে। অধুনা যুগোস্লাভিয়ায় অনুষ্ঠিত গৃহযুদ্ধে গণহত্যার নায়কদের পাকড়াও, বিচার অনুষ্ঠান ও শাস্তি বিধানের প্রক্রিয়া চলছে। কম্বডিয়ায় অনুষ্ঠিত পলপট বাহিনীর গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াটিও জাতিসংঘ ও কম্বডিয়া সরকারের প্রক্রিয়াধীন আছে। এই বিচার তালিকায় পাকুয়াখালি, ভূষণছড়া ইত্যাদি গণহত্যাগুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য। সভ্য জগতে উদাহরণ স্থাপিত হওয়া দরকার যে, মানবতার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রতিটি অপরাধ অবশ্যই বিচার্য। সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতি তা অবহেলা করলেও জাতিসংঘ তৎপ্রতি অবিচল।
স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার দাবী-দাওয়ার পক্ষে, পরিচালিত রাজনীতি, আন্দোলন ও সশস্ত্র তৎপরতায়, নির্বিচারে গণহত্যা কোন মতেই অনুমোদন যোগ্য নয়। এখন স্বাভাবিক শান্ত পরিবেশে গণহত্যার অভিযোগগুলো যাচাই করে দেখা দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে এরূপ বিচারযোগ্য ঘটনা অনেকই আছে ও তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। সাধারণ ক্ষমার আওতা থেকে গণহত্যার অপরাধটি অবশ্যই বাদ যাবে।
পার্বত্য ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে, আমার নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ হলোঃ এই পর্বতাঞ্চলের প্রতিটি দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যা ও পীড়নের অগ্রপক্ষ হলো জনসংহতি সমিতি ও তার অঙ্গ সংগঠন শান্তিবাহিনী। বাঙ্গালীরা তাতে পাল্টাকারী পক্ষ মাত্র। এমতাবস্থায় জনসংহতি সমিতি নেতৃবৃন্দ হলেন আসল অপরাধী। মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠনে তাদের নির্দেশ ও অনুমোদন না থাকলে, তারা প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে অবশ্যই দমাতেন বা শাস্তি দিতেন। পাকুয়াখালি ঘটনা তাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়নি, অনুরূপ অস্বীকৃতি আমলযোগ্য নয়। কারণ অনুরূপ ঘটনা ঘটাবার দ্বিতীয় কোন প্রতিষ্ঠান এই সময় অত্রাঞ্চলে উপস্থিত নেই। ভুক্তভোগীপক্ষ একমাত্র তাদেরকেই তজ্জন্য দায়ী করে। তাদের অস্বীকারের অর্থ নিজেদের সংগঠনভুক্ত অপরাধীদের অপরাধ ঢাকা। সুতরাং জনসংহতি নেতৃবৃন্দই অপরাধী।
এখন গণহত্যার অভিযোগটি বিদ্রোহী সংগঠনের প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয লারমার উপরই পতিত হয়। তিনি অপরাধী না নির্দোষ তা বিচার প্রক্রিয়াতেই নির্ধারিত হবে।
এ সংক্রান্ত আরো লেখা: