পাক-ভারত যুদ্ধ পরবর্তী মোদীর নিউ নরমাল তত্ত্ব ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা


পটভূমি
দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে বন্ধুহীন রাষ্ট্র ভারত-ইজরাইল এর ন্যায় একটি ‘আঞ্চলিক উৎপীড়নকারী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হয়ে ওঠার দিকে অধিক মনোযোগী হচ্ছে স্পষ্ট প্রতীয়মান। সদ্য স্তিমিত হওয়া ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর পাহেলগাও সন্ত্রাসী হামলার কথিত বদলা “অপারেশন সিঁদুর” থেকে বাস্তবে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে ভারতের ইজরাইল এর মতো কিছু হয়ে ওঠতে হয়তো আরো কয়েক শতাব্দী বাকী। কিন্তু ইজরাইল এর প্রকাশ্য সহযোগিতায় ভারতের দক্ষিণ এশিয়ার ইজরাইল হয়ে ওঠার মানসে চালু করা ব্যাপক আধিপত্যবাদী কর্মযজ্ঞ, ভারতীয় রাজনৈতিক ও সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চরম অসংলগ্ন বক্তব্য, পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের সাথে সম্পূর্ণ প্রমাণবিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী অন্যান্য দেশ সমূহের নীতিনির্ধারকগণের অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে আরো গভীরে ভাবা উচিত। যেহেতু সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে মোটেই পাকিস্তানের ধারে কাছেও নেই বাকি দেশগুলো।
লক্ষণীয় বিষয় হলো: ভারত ইজরাইল এর ন্যায় একই সাথে একাধিক দেশের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার কৌশলও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সীমিত আকারে শুরু করে দিয়েছে, পাকিস্তানকে অবৈধভাবে আক্রমণের মাঝেই ভারত বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে কিছু বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলিম এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পুশ ইন করেছে। ভারতের ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান দল বিজেপি ১৩ মে ২০২৫ তারিখ হতে ২৩ মে ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত ১০ দিন দেশব্যাপী ‘অপারেশন সিঁদুর’ এর সাফল্য উদযাপনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে! বাস্তবতা হলো, ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখের পাহেলগাও সন্ত্রাসী হামলার পর হতে ভারত প্রায় দুই সপ্তাহের অধিক মিথ্যা অভিযোগ ও হম্বিতম্বি ছড়িয়ে পাকিস্তানের কিছু মসজিদ-মাদ্রাসা ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা করে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করে অপারেশন সিঁদুর শুরু করেছিলো ৭ মে ২০২৫ তারিখে, ৯ মে ২০২৫ তারিখ রাতে পাকিস্তানের পাল্টা আক্রমণের পরদিনই দুপুরে যুদ্ধের তিন দিনের মাথায় মার্কিন মধ্যস্ততায় যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে ভারত, তাও সবার আগে টুইট করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলেও ভারত সরকার এখনও পর্যন্ত নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতির অফিশিয়াল কোন বিবরণ প্রকাশ করেনি, নিজস্ব মিডিয়ায় বলে বেড়াচ্ছে অপারেশন সিঁদুর চলমান আছে! শুধুমাত্র স্থগিত করা হয়েছে। তাহলে ক্ষমতাসীন বিজেপি কিসের সাফল্য উদযাপন করছে এবং কেন উদযাপন করছে? এসব দেখে ভারতীয় অভিনেতা ও স্ক্রিপ্ট রাইটার কামাল রশিদ খান প্রকাশ কেআরকে এর মতো বিশ্বের সকল স্বাভাবিক মানুষের মনের বহু প্রশ্ন জাগছে! কি প্রমাণ আছে পাহেলগাও সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তান জড়িত? কিসের ভিত্তিতে এটা ধরে নেওয়া হলো সন্ত্রাসীগুলো কোন ভাড়াটে খুনী নয়? ভারত কখন খুনী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করবে বা হত্যা করতে সমর্থ হবে? ঘটনার আগে কেন ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয়েছিলো? ভারত সরকার কেন ঘটনার যৌথ আন্তর্জাতিক তদন্তে রাজি নয়? কাউকে গ্রেফতার কিংবা কোন পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ব্যতিত কিভাবে ঘটনার প্রায় পরপর হতেই পাকিস্তান কে দায়ী করা হচ্ছে? আসন্ন বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে সুবিধা দেওয়া এবং কেন্দ্রে নড়বড়ে বিজেপি জোট সরকার এর অবস্থান সুসংহত করার জন্যই কি এই সন্ত্রাসী হামলা ও খণ্ড যুদ্ধের অবতারণা? নাকি ওয়াকফ বিল নিয়ে ভারতে সৃষ্টি সমালোচনা ধামাচাপা দিতে এই যুদ্ধের নাটক। নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মূলতঃ গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য সংগঠিত সন্ত্রাসী হামলার সাথে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তির কী সম্পর্ক? কীভাবে ভারতীয় দালাল (গদি) মিডিয়া আন্তর্জাতিক নদীর পানিকে ভারতের অস্ত্র হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে?
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ নিজস্ব কোন ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করছেন না, প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের পরিবারের কারো সাথে এখনও পর্যন্ত দেখা করেননি, সর্বদলীয় জাতীয় নিরাপত্তা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী অনুপস্থিত থেকে বিহারে রাজনৈতিক সভা করেছেন, এখন দল হিসেবে ক্ষমতাসীন বিজেপি কাল্পনিক ও গদি মিডিয়া সমর্থিত সাফল্য উদযাপন শুরু করেছে, প্রধানমন্ত্রী ছুটে গেছেন আদামপুর বিমান ঘাঁটিতে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতে! অদ্ভুত ও অসংলগ্ন সব কর্মকাণ্ড, যা খোদ ভারতীয় ইতিহাস অনুযায়ীও গেলে ভাবতে চরম আজগুবি!
ভারত-পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যাপক গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে এটা পুরো বিশ্ব জানে। গত ১১ মার্চ ২০২৫ তারিখে পাকিস্তানের কোয়েটা হতে পেশোয়ারগামী ট্রেন ‘জাফর এক্সপ্রেস’ কে অপহরণ করে বালুচ বিদ্রোহীরা ৫০ জন পাক সৈন্য এবং ২১৪ জন পাক সেনা পরিবারের সদস্য হত্যার দাবী করে, যদিও পাকিস্তানি অফিশিয়ালগণের দাবী মোট নিহত ৬৪ জন, যার মধ্যে ১৮ জন পাক সেনা ও ৩৩ জন বালুচ বিদ্রোহী, সফল অভিযানে বাকি সবাই মুক্ত। ঐ নারকীয় হত্যাকাণ্ড ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী ঘনিষ্ঠ সুপরিচিত সকল সাংবাদিক ও ইউটিউবার সহ প্রায় পুরো ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উদযাপন করেছে, ভারতীয়রা সন্ত্রাসী হামলায় সাফল্য অর্জনের জন্য ব্যাপকভাবে বালুচ বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে! পাকিস্তান হামলায় ভারতের যোগসাজশ আছে দাবী করলেও বরাবরের মতো অকাট্য প্রমাণ না থাকায় কোন কূটনৈতিক পদক্ষেপ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। নিকট অতীতে বালুচ বিদ্রোহীরা রিমোট কন্ট্রোলার এর মাধ্যমে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাক সেনা সমেত বেশ কয়েকটি পাক টহল যান ধ্বংস করার ভিডিও প্রকাশ করেছে! পাকিস্তানকে ঘিরে চলমান ভূরাজনীতি এবং বিভিন্ন ভারতীয় রাজনৈতিক/অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এর অতীত একটি বক্তব্য থেকে এটা প্রায় স্পষ্ট প্রতীয়মান বালুচ বিদ্রোহীরা অস্ত্র-গোলাবারুদ-প্রশিক্ষণ কোথায় থেকে পায়!
মোদী সরকারের আমলে ব্যাপক ধর্মীয়করণ ও রাজনীতিকরণে একেবারেই জর্জরিত ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী! এরই সাথে ফ্রান্সের ডেসাল্ট থেকে রাফাল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ে ঋণের দায়ে ডুবতে থাকা অনিল অম্বানিকে জড়িয়ে দূর্নীতি, নিম্নপদস্থ সেনাদের চাকরি অস্থায়ী করণের প্রকল্প ‘অগ্নীবীর’ ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর জনবল এবং সামর্থ্য সংকটকে আরো জটিল করেছে, অগ্নীবীর প্রকল্পের কারণে ঐতিহাসিক চুক্তির বিপরীতে নেপাল থেকে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীতে গোর্খা সৈন্য ভর্তি হওয়াও ব্যাপকভাবে কমেছে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পরে ঠিক এরকমই বিজেপিকে রাজনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়া বালাকট হামলা ও পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারতীয় বিমান বাহিনী বুঝে গিয়েছিলো তাদের প্রকৃত মান আসলে কী।
পুলওয়ামার সন্দেহজনক হামলার ঘটনায় তত্কালীন জম্মু ও কাশ্মীর এর গভর্নর সত্যপাল মালিক আজ পর্যন্ত উন্মুক্ত মিডিয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে চরম সব অভিযোগ আনলেও মোদীজী ঠিকই ঐ হামলা ব্যবহার করে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাজিমাত করেছিলেন। যেহেতু সাবেক গভর্নর সত্যপাল মালিক এর বিরুদ্ধে আজ অবধি মোদীজী বা দোভাল কোন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমর্থ হননি, সেহেতু এটা ধরে নেওয়া বেশি বড় ভুল হবে না পুলওয়ামা সন্ত্রাসী হামলাও সাজানো ছিলো এবং যেটার কোন না কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ এই সাবেক গভর্নর এর নিকট আছে! অনলাইনে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত পর্যবেক্ষণে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানে সাথে আবারও ভয়ংকর খণ্ড যুদ্ধে জড়াতে রাজি ছিলো না। কিন্তু দাঙ্গা ও সংঘর্ষের রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ায় চরম অভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী, ব্যাপক শক্তিশালী গদি মিডিয়া এবং উন্মাদ চাটুকার ও ধর্মান্ধ জেষ্ঠ সামরিক কর্তাদের চাপে তাদেরকে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে হয়েছে, এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান তারা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না, তাই আক্রমণের পর থেকেই প্রতিটি অফিশিয়াল প্রেস রিলিজে ভারত যুদ্ধ চায়না বার্তাটির ওপর প্রবল জোর দেওয়া হয়েছে!
বস্তুত ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে গালওয়ান উপত্যকায় চীনা সৈন্যদের সাথে হাতাহাতি সংঘর্ষে বিহার রেজিমেন্টের তত্কালীন অধিনায়ক কর্ণেল সন্তোষ বাবু সহ ২০ জনের অধিক ভারতীয় সৈন্য নিহত এবং অগণিত আহত হওয়ার পর ভারত এক প্রকার গোপনে পাকিস্তানের কাছে নাকে খত দিয়ে পাক লাইন অফ কন্ট্রোল হতে সৈন্য কমিয়ে চীনকে কোন রকম ঠেকিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ বিমানবাহিনীর দূর্বলতার পাশাপাশি সার্বিকভাবে সৈন্য ঘাটতি বা বাড়তি মোতায়েনের চাপ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রকট, যেটা গদি মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বীকার না করলেও পাক-ভারত সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ কর্তাগণ ঠিকই জানেন! বিজেপি ও গদি মিডিয়ার চরম ঘনিষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জি ডি বকশি’র মতে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ১৮০০০০ সৈন্যের ঘাটতি আছে! উপরন্তু জ্বলন্ত মনিপুর পরিস্থিতিতে নর্থ -ইস্ট থেকে সৈন্য সরানোর কোন বাস্তব সুযোগ আসলেই ভারতীয় বাহিনীর নেই! এরকম নাজুক অবস্থায় ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী কিভাবে পাকিস্তানকে আক্রমণের সাহস করলো সেটাই আসলে ভাবার বিষয়!
সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা প্রবীন শেওয়ানী তাঁর ফোর্স ম্যাগাজিন ইউটিউব পেইজে একেবারে হাতে কলমে সব কিছু বিশ্লেষণ করে দেখানোর পরও পাকিস্তানে আক্রমণ, তারপর তড়িঘড়ি করে আমেরিকাকে দিয়ে তিন দিনের মাথায় যুদ্ধ বিরতি ঘটানোর আসল কারণ একটাই হতে পারে প্রতিবেশী দূর্বল রাষ্ট্রসমূহের নিকট দক্ষিণ এশিয়ার ইজরাইল হিসেবে আবির্ভূত হওয়া! আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে, বর্তমান নতুন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ভারতীয় অবৈধ আধিপত্যবাদ এবং অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী সমূহের পানি ডাকাতি/অপব্যবহার নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার, কাশ্মীরী জনগণের কাশ্মীরের উপর বিশেষ অধিকার রদ করায় গালওয়ানে ড্রাগনের আগমন ঘটেছে। এরকম একটি চতুর্থমুখী প্রতিকূল পরিস্থিতি উগ্র হিন্দুত্ববাদের ক্ষমতাসীন বিজেপি জোট তাই সুপরিকল্পিতভাবে সংঘাত লাগিয়ে সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের অনৈতিক সুবিধা নিতে চাচ্ছে!
এক্ষেত্রে পাকিস্তান কেন প্রথম লক্ষ্য? সেখানেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য! মার্কিনীদের বৈশ্বিক আধিপত্য ধরে রাখতে হলে ডলারে আরবদের তেল বিক্রি বজায় রাখা অতীব জরুরি, ডলারে তেল বিক্রি বজায় রাখতে হলে সৌদি আরবে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ সুসংহত থাকা অতীব জরুরি! সৌদি আরবে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হলে সৌদি আরবের একনায়কতন্ত্রকে শিয়া ইরান থেকে নিরাপদ রাখা ও প্রত্যক্ষ মার্কিন সামরিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান হলো সৌদি একনায়কতন্ত্র তথা রাজপরিবারের প্রধান চাহিদা! এতে আমেরিকাকে হয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে হবে না হয় সৌদি আরবকে পারমাণবিক কর্মসূচির মালিক হতে দিতে হবে, পাশাপাশি থাকতে হবে প্রত্যক্ষ মার্কিন সামরিক সুরক্ষার চুক্তি! অর্থাৎ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আমেরিকার উপর চাপ শুধু ইহুদীবাদীদের দিক থেকেই নয়, সৌদি আরব তথা সুন্নী আরবদের নিকট থেকেও আছে! হুতিদের সাথে মার্কিন বাহিনীর সংঘর্ষে এটা পানির মতো পরিস্কার হয়ে গেছে ইরানের সাথে সংঘর্ষে কি ঘটবে, সবচেয়ে বড় কথা হুতিদের মারই হজম করার ক্ষমতা আমেরিকার কল্পনার বাইরে, কৌশলগত কারণে হুতিরা কখনও পুরো শক্তি প্রয়োগ করেনি মার্কিন বিমানবাহী রণতরীগুলোর বিরুদ্ধে, ওরা চাইলেই বহু আগেই এগুলো হয়তো ডুবিয়ে দিতে পারতো! অর্থাৎ যে মিসাইল থেকে বাঁচতে আকস্মিক টার্ন করতে গিয়ে রণতরী হ্যারি এস ট্রুম্যান থেকে এফ-১৮ বিমান সাগরে পরে গেছে, হুতিরা চাইলে বহু আগেই ঐ ধরনের মিসাইল একসাথে ২০-৫০ টি ছুড়তে পারতো, সেটা আমেরিকা বুঝে গেছে! বিপরীতে গাজা গণহত্যায় পুরো বিশ্বে এবং নিজ জনগণ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের চোখে মার্কিন প্রশাসন কোনঠাসা, আরব একনায়কগণ ইরানের বাড়ন্ত সক্ষমতা ও নিজ দেশের জনগণের ফুঁসে ওঠার ভয়ে ইরানের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধে আমেরিকাকে নিজ দেশের ভূমি ও জলসীমা ব্যবহার করতে দিতে নারাজ!
ইজরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর গাজায় হামাসের হাতে থাকা বন্দীদের বিসর্জন দিয়ে দখলদারিত্ব কায়েমের দৃঢ় সংকল্প ও ইজরাইলে উগ্রবাদের চরম উত্থান নিয়ে ইহুদিদের অধার্মিক অংশ আপাততঃ বর্তমান ইজরাইলি প্রশাসনের উপর ক্ষ্যাপা! অতএব প্রয়োজনে নেতানিয়াহুকে বাদ দিয়ে হলেও সৌদি আরব ও ইরানের সাথে চুক্তি ব্যতিত ট্রাম্পের সামনে আর কোন পথ আপাততঃ হয়তো খোলা নেই! না হয় চীন-রাশিয়ার তথা ব্রিকস এর নিয়ন্ত্রণে আরব্য তেল চলে গেলে ডলারের পতন ঘটবে! বিপরীতে ইজরাইল এর শর্ত ছিলো সৌদি আরবকে পারমাণবিক বোমা পেতে হলে তাদের সাথে সম্পর্ক অফিশিয়ালি স্বাভাবিক করতে হবে, আর সৌদি আরবের শর্ত ছিলো লোক দেখানো হলেও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাস্ট্র মেনে নিতে হবে আমেরিকা-ইজরাইল কে! কিন্তু সেটা নিয়ে নেতানিয়াহু-বেন গবির- স্মটরিচ ত্রয়ী বর্তমান ইজরাইলি নেসেটে ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় চিন্তা করা আসলেই সময় নষ্ট ব্যতিত আর কিছু নয় নিশ্চিত হয়ে গেছে মার্কিন প্রশাসন!
ট্রাম্প ইতিমধ্যেই হামাসের সাথে ইজরাইল কে বাদ দিয়ে আলোচনা করে আমেরিকান-ইজরাইলি দ্বৈত নাগরিক এক বন্দীকে মুক্ত করিয়েছেন। বর্তমানে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে (সৌদি আরবে) আছেন, মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশ সফর করার সিডিউল থাকলেও ট্রাম্প ইজরাইল সফর করবেন না, এমনকি ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেথ হেগসেথ এর নির্ধারিত ইজরাইল সফরও বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে কাতার ৪০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বিলাসবহুল বিমান এয়ারফোর্স ওয়ান তথা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমানে রুপান্তরিত করার জন্য উপহার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে, পাশাপাশি ডলারের এমন দুঃসময়ে ২০০ বিলিয়ন পেট্রো-গ্যাস ডলার আমেরিকায় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। উগ্রবাদী ইহুদিদের জন্য গোদের উপর বিষফোড়া ইরানও আমেরিকার সাথে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখাচ্ছে! এরদোয়ান ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে শান্তি স্থাপনে কার্যকরী দূতিয়ালির আভাস দিচ্ছেন, বিনিময়ে ট্রাম্প তুরস্ককে পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ জঙ্গি বিমান প্রদানের ইঙ্গিত দিচ্ছেন! তুরস্ক এফ-৩৫ হাতে পেলে তাদের নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের বিমান তৈরী প্রজেক্টে সাফল্য পাওয়া আরো সুনিশ্চিত হবে, যেখানে পাকিস্তানও অংশীদার। পর্দার অন্তরালে যা-ই থাকুক না কেন, আপাতত দৃষ্টিতে মার্কিন প্রশাসনের উপর উগ্রবাদী ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে! প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবারের মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট এর সাথে বৈঠক করে ফেললে কিংবা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাস্ট্রের ঘোষণা না দিলেও রূপরেখা ঘোষণা দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!
এখন কথা হলো আমেরিকা কি সরাসরি সৌদি আরবকে পারমাণবিক শক্তিধর করে দিবে? না, মোটেই না! তাহলে জাপান-জার্মানী-ব্রাজিল – কানাডা- পোল্যান্ড – ইতালি সহ বহু দেশ আলোচনায় চলে আসবে। বিষয়টি ঘটবে ফ্রান্স বা অন্য কাউকেকে সামনে রেখে পাকিস্তানের মাধ্যমে! অন্যদিকে আবারও ক্রমশ হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার দিকে ধাবিত হতে থাকা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানও পারমাণবিক শক্তিধর হতে চান, তাঁরও মূল ভরসা পাকিস্তান! বর্তমান ভারত ও ইজরাইল এর ক্ষমতাসীন দলগুলো আদর্শিকভাবে চরমপন্থী ও রিভিশনিস্ট, একটি পুরো ভারতে হিন্দুত্ববাদ ও তত্পরবর্তী পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অখণ্ড ভারত কায়েম করতে চায়, বেনজামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইজরাইলি উগ্রবাদীরা গাজা গণহত্যা সফল করে পশ্চিম তীরের সিংহভাগ সংযুক্ত করে অতি সম্প্রতি সিরিয়া ও লেবাননের নতুন দখলকৃত অংশ সহ গ্রেটার ইজরাইল ঘোষণা করতে চায়! ইন্ডিয়া-ইজরাইল এর চরম মিতালীর অসামান্য সংমিশ্রণ সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ঘটেছে, পাশাপাশি গাজা গণহত্যায় অস্ত্র-গোলাবারুদ ও লোকবল সরবরাহের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ইন্ডিয়ার অবদান অনেক বড়। মোটাদাগে মূলত ইজরাইল চাচ্ছে ইন্ডিয়াকে সামনে রেখে পাকিস্তানকে ঘায়েল করতে, যেটাতে আবার আমেরিকা রাজি নয়! কারণ চীন, ইরান ও আফগানিস্তানকে পর্যবেক্ষণ/চাপে রাখতে হলে আমেরিকার পাকিস্তানকে হাতে রাখা দরকার। আবার বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার দেশ ভারতীয় বাজার হাতছাড়া করাও আমেরিকার পক্ষে সম্ভব না। ইজরাইলি মন্ত্রণায় রাশিয়াকে ছেড়ে পশ্চিমাদের দিকে ধাবিত হওয়া ভারতের সাথে আমেরিকার যথেষ্ট গভীরতা বাড়ছে। ভারতের অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারীদের মধ্যে এখন আমেরিকাও একটি, চীনের নেতৃত্বের ব্রিকস জোটে মার্কিন স্যাবোটাজের একমাত্র নির্ভরযোগ্য পথ হলো ভারত। ভারতের বিরোধিতার কারণে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকস জোটের সম্মিলিত মুদ্রা এখনও বাজারে আসেনি! চীন-রাশিয়া-ব্রাজিল এর হয়তো বাধ্য হয়ে ভারতকে বাদ দিয়েই এই মুদ্রা বাজারে আনতে হবে।
অপারেশন সিঁদুর-এ কি ঘটেছে?
দ্য টেলিগ্রাফ এর সাংবাদিক মেম্পিস বেকার তাঁর ৮ মে ২০২৫ তারিখের প্রতিবেদনে লিখেছেন সিএনএন ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থার নিকট হতে নিশ্চিত হয়েছে ৭ মে ২০২৫ তারিখ রাতে প্রায় ১০০ কিঃমিঃ এর বেশি দূরত্বে অবস্থান করে পাক-ভারত জঙ্গি বিমান সমূহ নিজস্ব আকাশসীমায় থেকে লিপ্ত হওয়া ডগফাইটে কমপক্ষে ১টি রাফাল যুদ্ধ বিমান ঘায়েল হয়েছে, আরো কোন বাড়তি বিমান ঘায়েল হয়েছে কিনা তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। এর পরবর্তীতে মার্কিন সামরিক কর্তারা জানিয়েছেন তাদের খুবই উচ্চ আত্মবিশ্বাস ভারতের ২টি রাফাল যুদ্ধ বিমান পাকিস্তানের হাতে ঘায়েল হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ফ্যাবিয়ান হফম্যান জানিয়েছেন, পাকিস্তানের জঙ্গি বিমানগুলোতে Active Electronic Scanned Array (ASEA) রাডার প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে, যা প্রায় ৪৫০ কিঃমিঃ দূরে থাকতে শত্রুর অবস্থান পাইলটকে জানিয়ে দেয়, অপরদিকে সম্ভবত চীন ৩০০ কিঃমিঃ রেঞ্জের পিএল-১৫ই এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল পাকিস্তান কে দিয়েছে (যদিও প্রকাশ করা হয়েছিলো ১৪৫ কিঃমিঃ রেঞ্জে গুলো দেওয়া হয়েছে), এই মিসাইল এর গতি ম্যাক ৫ বা শব্দের চেয়ে ৫ গুণ বেশি, এর ডুয়াল পালস মোটর টার্গেটের ১০ কিঃমিঃ বা আরেকটু আগে দ্বিতীয় ধাক্কা দিয়ে গতি আরো বেশি বাড়িয়ে দেয় এবং মিসাইল ASEA রাডার ডাটায় যুক্ত হয়ে শত্রু বিমানের জন্য পুরোপুরি “পালানোর পথবিহীন এলাকা” তৈরি করে। অর্থাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভারতের ৪.৫ প্রজন্মের বিমানগুলো ঘায়েল হয়েছে! ০৭ মে ২০২৫ তারিখ রাতে ও ৮ মে ২০২৫ তারিখ পুরোদিন পাকিস্তানের আর্টিলারি গোলাবর্ষণ এর কোন জবাব ছিলো না ভারতের কাছে। ২০২২ সালে চীন থেকে গ্রহণ করা ১৫৫ মি:মি: গানগুলোর লং রেঞ্জ ও নির্ভুলতা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে হতবাক করেছে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞ বিজেন্দর কে ঠাকুর এর মতে, পাকিস্তানের নিজস্ব ফতেহ-১ এমএলআরএস কেও ভারত অতিনিম্ন মূল্যায়ন করেছিলো, বাস্তবে দেখা গেছে এর ১৪০ কিঃমিঃ রেঞ্জ ও মাকহ্ ৩-৪ গতি রোধ করতে ভারত ব্যর্থ হয়েছে, ফলশ্রুতিতে সীমান্তবর্তী বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা খুব সহজেই পাকিস্তানের আয়ত্তে চলে গেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বীরেন্দর সিং ধানোয়া একমত হয়েছেন যে, পাকিস্তানের ৯ মে ২০২৫ তারিখ রাতে ভারত আক্রমণের সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয় হচ্ছে প্রথাগত আক্রমণের আগ মুহুর্তের সাইবার এ্যাটাক। আরেক নিরপেক্ষ ভারতীয় বিশেষজ্ঞ প্রভীণ শেওয়ানি এর বিশ্লেষণ ধর্তব্যে নিলে ঐ সাইবার এ্যাটাক পাক-চীন সম্মিলিত, না শুধু পাক বা চীনা সাইবার ফোর্সের বুঝা মুশকিল! অসম্ভব দম্ভ ও হম্বিতম্বি থেকে হঠাৎ মার্কিন মধ্যস্ততায় যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা পাকিস্তানিদের চেয়েও ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদী ধর্মান্ধের আঘাত করেছে সবচেয়ে বেশি। তাই তারা নিজস্বভাবে আবিস্কার করেছেন তাদের সিংহ পুরুষ মোদীজী নয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি চক্রান্ত করে এই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছেন, তারা সে অপরাধে জনাব মিসরি ও তার পরিবারের সদস্যদের উপর অনলাইনে অশ্লীল আক্রমণ চালিয়েছেন, বাধ্য হয়ে জনাব মিসরি তার টুইটার একাউন্ট সাময়িকভাবে প্রোটেক্টেড করেছেন, এই অশ্লীল আক্রমণের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলো জনাব মিসরি এর কন্যা দিদন মিসরি। নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করলে কিংবা যুদ্ধ বিরতির দায় ঘাড়ে নিলে স্বাভাবিকভাবেই অপারেশন সিঁদুর এর রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার সুযোগ কমে যাবে বিধায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিংবা কোন মন্ত্রী-এমপি জবাব বিক্রম মিসরি এর সমর্থনে এগিয়ে আসেননি! তবে ভারতীয় প্রশাসনিক সার্ভিস এসোসিয়েশন (আইএএস) জনাব মিসরি এর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ধর্মান্ধদের উদ্দেশ্য দাপ্তরিক প্রক্রিয়া পুরো তুলে ধরে জনাব মিসরিকে সমর্থন জানিয়েছেন।
পাকিস্তানি আক্রমণের সাথে সাথেই ভারতের আমেরিকার মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণায় আক্রমণের ভয়াবহতায় ভারত অবাক হয়েছে এবং পাক বিমান ভারতে ঢুকে অক্ষত ফিরে গেছে সাইবার ওয়ারফেয়ার শ্রেষ্ঠত্বের কারণে দাবীর যৌক্তিকতা বাড়িয়েছে বহুলাংশে। পাকিস্তানের অবিশ্বাস্য আক্রমণের পর ভারত তাদের সেরা অস্ত্র ব্রাহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র ও ইজরাইলি ড্রোন ব্যবহার করে আবারও পাল্টা আক্রমণ করেছে, সুপারসনিক গতির সবগুলো ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তান প্রতিরোধ করতে পারেনি, তাই পাকিস্তানের কয়েকটি বিমান ঘাঁটিতে কিছু কিছু ক্ষতি হয়েছে।
এই যুদ্ধের আরো একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো ড্রোন যুদ্ধেও পাকিস্তান ভারতকে অভিভূত করেছে। ভারত যেখানে খুব হিসাব কিতাব করে ইজরাইলি হারপ আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করেছে, বিপরীতে নিজস্ব উত্পাদন ও বৃহত্ তুর্কী সরবরাহের কারণে পাকিস্তান শত শত ড্রোন পাঠিয়ে ভারতীয় এয়ার ডিফেন্সকে পুরোপুরি উন্মুক্ত ও অভিভূত করে ফেলেছে। মোটাদাগে বললে ব্রাহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র ও হারপ ড্রোন ব্যতিত ভারতীয় কোন অস্ত্র সফল হয়নি। ৭ মে ২০২৫ তারিখের পর থেকে ভারতীয় কোন বিমান হয়তো পাকিস্তানি বিমানের বিরুদ্ধে কিংবা পাকিস্তানে আক্রমণে যায়নি, যেটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া বক্তব্য গভীরভাবে লক্ষ্য করলেও পরিস্কার, তিনি শুধু ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের সাফল্য দাবী করেছেন । পাকিস্তান দাবী করেছে তারা ভারতের ২৬টি সামরিক স্থাপনায় হামলা করেছে, ভারতও অফিশিয়ালি স্বীকার করেছে পাকিস্তান ২৬টি স্থাপনায় ৯ মে ২০২৫ তারিখে রাতে হামলা করেছে! ৭ মে ২০২৫ তারিখের পর থেকে ভারত প্রায় ৮০০০ এর বেশি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম/সাংবাদিক/ফ্রিল্যান্সার জার্নালিস্ট এর একাউন্ট ব্লক করেছে, অপরদিকে পাকিস্তানে ব্লক থাকা টুইটার বা এক্স খুলে দেওয়া হয়েছে, আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ বিজয় ঘোষণা করেছে।
ধরাশায়ী হওয়ার পরও সামর্থ্যের গভীরতা কাজে লাগিয়ে অবৈধ আধিপত্য সৃষ্টির অপতত্পরতা
যুদ্ধের ময়দানে চরম মার খাওয়ার পরও ভারতের প্রধান উদ্দেশ্য হলো নিজেদের সামর্থ্যের গভীরতা এবং বিশাল অর্থনীতির প্রভাবের জোরে একটি মিথ্যা বিজয়ের দাবী জারী রেখে আঞ্চলিক একতরফা আধিপত্য নীতি প্রতিষ্ঠা করা। যার লক্ষ্য আসলে মোটেই পাকিস্তান নয়, এছাড়াও পাকিস্তানও হয়তো সব ফাঁকা বুলির জবাব দিতে পারবে না। দূর্বল সমরনীতিতে সৃষ্ট দূরাবস্থা ও চীন প্রভাবের কারণে ভারত যেমন এখন পাকিস্তানের সাথে পূর্ণ যুদ্ধ করতে পারবে না, ঠিক তেমনি সামরিক সক্ষমতা থাকলেও পাকিস্তান ভারতের সাথে পূর্ণ যুদ্ধ করতে গেলে অর্থনৈতিক কারণে বহু মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। নিখাঁদ সামরিক দৃষ্টিতে দেখলে উভয় দেশই একে অপরকে কয়েকবার ধ্বংস করার সামর্থ্য রাখে, কিন্তু দেশ দুটি মূলত যুদ্ধ করেছে পারমাণবিক যুদ্ধে পৌঁছাবার সীমার নিচের স্তরে থেকে। এই সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে মোদীজী তার জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণে দাবী করছেন, পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি চেয়েছে! টেরর ও টক, টেরর ও ট্রেড, পানি ও খুন (রক্ত) একসাথে চলতে পারে না! ভারতে কোন সন্ত্রাসী হামলা হলে ভারত এটার জন্য যাকে দায়ী মনে করবে সেখানে হামলা হবে, তিনি এটাকে “নিউ নরমাল” বলে দাবী করেছেন। এখন মোদীজীর গদি মিডিয়া ও উগ্রবাদী সমরবিশারদগণ এই নিউ নরমাল তত্ত্বকে ফলাও করে প্রচার করছে! এতো কিছুর ভীড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং বর্তমানে প্রখ্যাত সামরিক ও ভূরাজনীতি বিষয়ক সাংবাদিক সুশান্ত সিং মন্তব্য করেছেন, “তাহলে বন্দুকধারী চারজন লোক অথবা ২০ কেজি আরডিএক্সধারী একজন লোক ভারতকে যুদ্ধে ঠেলে দিতে পারে। এটা কীভাবে সরকারি নীতি হতে পারে? আপনি কি পাগল নাকি?” আরেকজন মোটামুটি বস্তুনিষ্ঠ সামরিক বক্তা মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত বীরেন্দর সিং ধানোয়া মন্তব্য করেছেন, “যদি সব কিছুই ‘যুদ্ধের ঘটনা’ হয়, তবে কোন কিছুই ‘যুদ্ধের ঘটনা’ নয়।” সাবেক ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান মনোজ নারাবেন ৭ মে ২০২৫ তারিখ টুইট করেছিলেন, “এখনও চিত্রনাট্য বাকি আছে…”, যুদ্ধ বিরতির পর নিউ নরমাল ঘোষণা হলে কলাম লিখে তিনি বলছেন, “যুদ্ধ প্রেমময় নয়। এটা আপনাদের প্রিয় বলিউড মুভি নয়, এটা খুবই মারাত্মক কর্মকাণ্ড। সৈনিক হিসেবে আদিষ্ট হলে যুদ্ধে যাবো, তবে সেটা প্রথম পছন্দ নয়। আমার প্রথম পছন্দ সব সময় কূটনীতি।” আরেক প্রখ্যাত ভারতীয় সমরবিশারদ লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এইচ এস পানাং আক্রমণ শুরুর আগে দ্য প্রিন্টে নিবন্ধ লিখে বলেছিলেন, “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের কোন অতিরিক্ত সক্ষমতা নেই, তাই তাড়াহুড়ো না করে মোতায়েন থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতি করা উচিত ও সুযোগ বুঝে আঘাত করা উচিত (অর্থাৎ কভার্ট গেম)।” সেই তিনিই রহস্যময় কারণে মোদীজীর নিউ নরমালকে প্রমোট করে টুইট করলে, উন্মুক্তভাবে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম(বর্তমান লেখক) “এতে তো রাজনৈতিকদের দায় এড়ানো ও সামরিক ক্ষমতার রাজনৈতিক ব্যবহারের পথ খুলে যাবে, এমনকি চীনও ছায়া যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারবে, এছাড়াও মনিপুরে একদিনে পহেলগাও থেকেও বহু বেশি লোক মারা যাওয়ার রেকর্ড আছে! ওখানেও কি এই নিউ নরমাল প্রযোজ্য হবে?” জবাবে তিনি লিখেছেন, “এছাড়া আর কি আপনি করতে পারবেন? আমি সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা নীতির অন্ধ সমর্থক নই। যুদ্ধ কৌশল পরিবর্তন হয়ে গেছে।” এরপর আমি তাকে তাঁর লেখা নিবন্ধের লিংক দিয়ে বলেছিলাম আপনার বক্তব্য আগের বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। পাকিস্তানের চেয়েও বাড়তি সক্ষমতা অর্জন ও চীনের সাথে নির্দিষ্ট বোঝাপড়া ব্যতিত ফলাফল সব সময় একই আসবে! শুধু ময়দানের সৈনিকরা হয়তো জানে আসলে কি ঘটেছে।” ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ক্যাপ্টেন পদবিতে যুদ্ধ করে যাওয়া ঝানু জেনারেল ঠিকই বুঝেছেন আমি কোন পয়েন্টে হিট করতে চাচ্ছি, তিনি আর কোন পাল্টা জবাব দেননি! পাকিস্তানের বিলওয়াল ভূট্টো জারদারি বলেছেন, “হয়তো সিন্ধু নদীর পানি না হয় ভারতীয়দের রক্ত প্রবাহিত হবে!” চীন, আমেরিকা সহ সবাই বলছে দু’দেশ বসে আলোচনা করো। যুদ্ধের ফলাফল সবার চোখের সামনে বিদ্যমান। তাহলে এই ’নিউ নরমাল’ ফাঁকা আওয়াজ ও মিথ্যা নাটক সাজিয়ে ঘায়েল করার হুমকি আসলে কাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই গভীরে বুঝার চেষ্টা করতে হবে! সামর্থ্য অর্জন ও কূটনৈতিকভাবে দেশপ্রেমের সহিত দক্ষতা প্রদর্শনের দিকে মনযোগী না হলে জাতির জন্য চরম দুর্দিন নেমে আসতে পারে।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য করণীয় কি হতে পারে?
ভারত কেন তাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নাম Ministry of Tribal Affairs রেখেছে, সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমূহকে সাধারণ নাম শিডিউল ট্রাইব/কাস্ট দিয়ে তালিকাভূক্ত করেছে সেটার মর্মার্থ বুঝার জন্য কি আইনস্টাইন হওয়া লাগবে? অথচ আমাদের সর্বোচ্চ সরকারি দপ্তর থেকে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে চরম বিতর্কিত ’আদিবাসী’ শব্দ সম্বলিত বিভিন্ন সুপারিশ পোস্ট করা হয়েছে। চলমান পাক-ভারত যুদ্ধে আমাদের পাহাড়ের দেশদ্রোহীদের অন্ধ ভারত ভক্তিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিপূর্ণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কমানো, পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা লংঘন করার বহুবিধ প্রস্তাবনা তৈরি করায় মনে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অর্থে গঠিত কিছু কিছু আজগুবি কমিশনের মূল লক্ষ্য!
একবার চিন্তা করুন, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় হয়তো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খর্ব শক্তির ৩টি ব্রিগেড আছে, কোন সাঁজোয়া ইউনিট/ব্রিগেড নেই, কোন ম্যাকানাইজড ইনফেন্ট্রি বা স্পেশালাইজড ইউনিট নেই, নেই কোন বিমান- ড্রোন- এন্টি ড্রোন -আকাশ প্রতিরক্ষা! উল্টো আছে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ৬টি দেশদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা ইতিমধ্যেই এই ঘোলাটে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণাত্মক হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে! এখন যদি দু’পাশ দিয়ে কোন শত্রু দেশের দুটি স্পেশালাইজড ডিভিশন/ব্রিগেড ঢুকে যায়, এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি দেশদ্রোহীরা বিদেশি অস্ত্র হাতে ওদেরকে সাথে নিয়ে নাচতে শুরু করে ঠিক আরাকান আর্মির সাথে আরাকান সীমান্তে জল কেলী নাচের মতো, তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও কথিত স্যাটেলার বাঙ্গালি ব্যতিত এই দূর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বলতে আর কিছু কি অবশিষ্ট থাকবে?
২০২০ সালের চীন-ভারত গালওয়ান সংঘর্ষে দেখা গেছে পাহাড়ি এলাকায় কাউন্টার ইন্সারজেন্সীতে অভ্যস্ত ভারতীয় সৈন্যরা পার্বত্য এলাকায় প্রথাগত যুদ্ধে চরমভাবে পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ পার্বত্য এলাকায় আধুনিক প্রথাগত যুদ্ধের জন্য বিশেষ সামর্থ্য, প্রশিক্ষণ, ফায়ার পাওয়ার ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অতীব জরুরি। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে এককভাবে কোন পরাশক্তির সাথে মিত্রতা করলে পরাশক্তি সমূহের মধ্যে পরে প্রচণ্ড রোষানলে পুড়তে হবে! উত্তর বঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গে উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থ সুসংহত করণে আমার দৃষ্টিতে চীনের চেয়ে ভালো কেউ নেই। বঙ্গোপসাগরে এরচেয়ে বরং কোন একটি মধ্যম সামরিক শক্তির শিল্পোন্নত পশ্চিমা মিত্রের পাশাপাশি মুসলিম সামরিক শক্তি তুরস্ককে নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পূর্ণ নিজেদের আয়ত্তে রাখতে হবে না হয় কোন মুসলিম মিত্র দেশের সাথে মিলে যৌথভাবে কিছু করতে হবে। সেভেন সিস্টার্স, মায়ানমার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মিলে খ্রীস্টান মিশনারীর যে শিকড় প্রোথিত হয়েছে, এর ভিন্ন কিছু করতে গেলে মহাবিপদের সম্ভাবনা বেশি।
সদ্য স্থিমিত হওয়া পাক-ভারত খন্ড যুদ্ধ থেকে আসল শিক্ষা হলো সূলভ মূল্যের কার্যকরী অফুরন্ত UAV, UCAV ও Kamikaze/Loitering Munition ব্যতিত আধুনিক যুদ্ধে টিকে থাকা যাবে না! এছাড়াও ইরান-ইজরাইল-হুতি-আমেরিকা এর সংঘর্ষ থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান কোন আকাশ প্রতিরক্ষা-ই সুনিশ্চিত সুরক্ষা নয়। এরচেয়ে ইরান/হুতিদের খন্দকের যুদ্ধের আদলে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়/পর্বতের অভ্যন্তরে লুকায়িত সামরিক স্থাপনা অধিক সুরক্ষিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশ্বের সর্বোচ্চ সামরিক শক্তিরও আয়ত্তের বাইরে। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য কয়েকটি ড্রোন ব্রিগেড বা একটি ড্রোন কোর গঠন করা অতীব জরুরি! ইমারজেন্সী ক্রয় হিসেবে তুরস্ক বা ইরান এর মতো দেশগুলো থেকে থেকে কামিকাজে ক্রয় করা যেতে পারে! কূটনৈতিক/আর্থিক কারণে সমস্যা হলে অন্তত চীন থেকে!
UAV বা UCAV সম্ভব না হলেও অন্তত যৌথ মালিকানায় হলেও কামিকাজে উত্পাদন সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এবং সেই কারখানা অবশ্যই ইরান এর ন্যায় কোন পর্বতের অভ্যন্তরে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামে! পার্বত্য রাঙ্গামাটির সাপছড়ি এলাকার মতো পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাহাড় গুলো প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত বেস হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কাজে লাগানো যেতে পারে। আশাকরি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহ পর্যালোচনা করে আমাদের নীতি নির্ধারকগণ তড়িৎ ব্যবস্থা নিবেন। যেখানে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার সুরক্ষার মতো বিষয় গুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দিলে হয়তো আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক।