parbattanews

পানছড়ি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা

sawtal pic

শাহজাহান কবির সাজু, পানছড়ি প্রতিনিধি:

আনন্দপ্রিয় একটি জনগোষ্ঠী নাম সাঁওতাল সম্প্রদায়। বিভিন্ন পূজা পার্বন ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নেচে-গেয়ে এরা খুশীতে থাকে মাতোয়ারা, তাই প্রকৃতির সাথে রয়েছে তাদের নিবিড় সম্পর্ক। এক যুগে গ্রাম বাংলার রাস্তা-ঘাট মেরামত, বনাঞ্চলে সামান্য চাষাবাস, বিভিন্ন পশুপাখি শিকার করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি জোতদারদের জমাজমি চাষ করাই ছিল তাদের প্রধান পেশা।

পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার সাঁওতাল সম্প্রদায়ে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। এখন আর বাঁশ দিয়ে নিজ হাতে তৈরী তীর ধনুক দিয়ে বিভিন্ন শিকার ও বনে জঙ্গলে কাঠ পাতা সংগ্রহের দৃশ্য তেমন চোখে পড়েনা বললেই চলে।

জেলার পানছড়িতে সাঁওতাল পাড়া নামে একটি পাড়া থাকলেও বর্তমানে গুটি কয়েক সাঁওতাল ছাড়া বাকীরা সব বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের। তবে বর্তমানে কানুনগো পাড়া এলাকায় বেশীরভাগ সাঁওতাল সম্প্রদায় বসবাস করছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, পানছড়ি উপজেলায় বর্তমানে তেষট্টি পরিবার সাঁওতাল বসবাস করছে। যার লোকসংখ্যা দুইশত সত্তর জন। এর মাঝে পুরুষের সংখ্যা একশত পঁচিশ ও মহিলার সংখ্যা একশত পঁয়ত্রিশ জন মহিলা। আর এদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রয়েছে তিন জন কার্বারী। সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা ও অনুষ্ঠানা দিতে কার্বারীরাই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।

সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর পোশাক পরিচ্ছেদ এক সময় ছিল নানা বৈচিত্রময়। পুরুষরা পড়তো লেংটি আর মেয়েদের ছিল বিচিত্র নকশার মোটা কাপড়ের দু’খন্ড বস্ত্র। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় কৃষিজীবি পুরুষরা পড়ছে ধুতি ও লুঙ্গি, মেয়েরা পড়ছে তাদের নিজস্ব ধারায় পেচানো শাড়ি আর শিক্ষিতদের মাঝে দেখা যায় প্যান্ট-শার্ট পড়তে।

সরেজমিনে পানছড়ি সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সাথে আলাপকালে জানা যায়, উদীয়মান ছেলে-মেয়েরা তাদের জীবন যাত্রার পরিবর্তন ঘটাতে সবাই স্কুলমুখী। এরি মাঝে এসএসসি ও এইচএসসি পাশের সংখ্যা প্রায় দশ এর অধিক। নাম প্রকাশ না শর্তে একজন মুচকি হেঁসে জানালেন, বাঙ্গালীদের সাথে এখন সাঁওতাল মেয়েদের বিয়েও হচ্ছে। তাও আবার প্রেমের বিয়ে। স্কুল-কলেজমুখী হওয়ায় ডিজিটাল সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে আজ তারা পাখি জামা ক্রয় থেকে শুরু করে কম্পিউটার চালনায়ও পারদর্শী বলে জানান সুজন সাওঁতাল।

পানছড়ির কানুনগো পাড়া এলাকায় কয়েকজন সাঁওতালের সাথে আলাপকালে জানা যায়, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, কোন এনজিও সংস্থা বা সরকারী প্রতিষ্ঠানের সু-নজরে না পড়ায় তারা আজ অবহেলিত বলে জানান। কৃষিকাজ ছাড়া তাদের আর কোন কাজ নেই। সারাদিন অন্যের জমিতে কৃষি কাজের বদলা দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চালাতে চালাতে সারা বছরই অভাবের গ্লানি টানতে হয়। তাছাড়া খাবার পানির সংকট ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত থাকার কথা বার বার তুলে ধরেন।

সদ্য এসএসসি পাশ করা পানছড়ি ডিগ্রী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী লক্ষী হেমরাং জানান, অনেক কষ্ট করে লেখা-পড়া করতেছি। সেই কলেজ থেকে এসে জঙ্গল থেকে লাকড়ি এনে বিক্রি করেই পড়া-লেখার খরচ যোগাড় করি। কিন্তু ভবিষ্যতে একখানা সরকারী চাকুরী পাব কিনা সেই টেনশনে আছি।

এদিকে চন্দন হেমরাং, যীশু হেমরাং ও আকাশ মুরমু জানান, আমরা বিভিন্ন খেলাধুলা ও সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত একটি সম্প্রদায়। তাই নিজেরা ফুটবল ক্রয় করে এখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফুটবলও খেলি। আমরা বিভিন্ন টূর্নামেন্টে সাঁওতাল একাদশ নামে একটি দল অর্ন্তভুক্ত করার চিন্তা ভাবনা করছি।

পানছড়ির অভিজ্ঞ মহলের সাথে আলাপকালে জানা যায়, সাঁওতালরা জাতি হিসাবে খুবই পরিছন্ন এবং সমাজবদ্ধ। এরা কোর্ট কাছারির ধারও ধারেনা। এদের বিভিন্ন বিচার-বিবাদ মাঝিরাই (কার্বারী) মিমাংসা দিয়ে থাকে। মাঝিদের বিচার ব্যবস্থা এদের কাছে দেবতার নির্দেশের মত।

পানছড়ির কানুনগো পাড়া সাঁওতালপল্লীর অসহায়দের জীবন চিত্র নিজ চোখে না দেখলেই নয়। আসলেই তারা আজও সমাজে অবহেলিত। এই অবহেলিতদের ভাগ্য উন্নয়নে বে-সরকারী সংস্থার পাশাপাশি সরকারী বিভিন্ন সংস্থা থেকেও কিছু সহযোগিতা দরকার। তবেই তারা দিন দিন আরো উন্নতির শিখরে পা রাখতে সক্ষম হবে।

Exit mobile version