parbattanews

‘পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না’

পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলছেন, পার্বত্য চুক্তির মূল বিষয়বস্তু ভূমির মালিকানা। এই একটিমাত্র বিষয় বাস্তবায়ন করলে আর কিছুই করতে হবে না। এমনিতেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়ে যাবে।

বুধবার (৪ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এএলআরডি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন বনাম পার্বত্য চট্ট্রগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এ সব কথা বলেন।

সভায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমি শান্তিচুক্তি পূর্ণবাস্তবায়নের জন্য আশা জিইয়ে রাখছি। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের এখনকার যে পরিস্থিতি এবং কিছুদিনের পত্রিকা দেখে আমার মনে হয়েছে আমরা যেন জিয়া-এরশাদের আমলে ফিরে গেছি। সেদিন যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামরিক সমাধানের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিলো তেমনি মনে হচ্ছে এখনও সেই সামরিক সমাধানের পক্ষেই আমরা এগুচ্ছি। শুধু এগুচ্ছি না, আমরা এ ব্যপারে অগ্রসর হচ্ছি।

তিনি বলেন, আমি মনে করি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই চুক্তির বাস্তবায়ন হবে না। চুক্তির যে মূল বিষয় সেটি হচ্ছে ভূমি বিরোধ নিরসন। ভূমির প্রশ্ন বাদ দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে গেলে এটি সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, আমরা বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম এই সমস্যার সমাধানে। কিন্তু ভূমি কমিশন আইনের ব্যপারে সংসদীয় কমিটি থেকে আইনটি পাশ হলেও এটি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে চলে আসত। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপেই ভূমি কমিশন আইন সংশোধন হলো। এখন এটি বাস্তবায়নে দু’ পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।

মেনন বলেন, চুক্তির মধ্য দিয়ে যে অস্থায়ী ক্যাম্প তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেটি না হয়ে আরও অস্থায়ী ক্যাম্প করার কথা বলা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সামরিক কায়দায় সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে পাহাড়িরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। পাহাড়ে যে চার সংগঠন আমরা জানি কিভাবে এগুলোকে পোষণ করা হয়েছে, তোষণ করা হয়েছে। এরপরও আমরা যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলি পার্বত্য কমিশনসহ সকল সুশীল সমাজ এগিয়ে এলে এর সমাধানের পথে আমরা এগুতে পারবো।

এ সময় তিনি আরও বলেন, জিয়াউর রহমানের আমলে চরের মানুষকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছিল। তখন সেখানে সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল। কিছু পাহাড়িরা রিফিউজি হয়ে ভারতে চলে গেছেন। ৯০-৯১তে তখন একটি রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করা হলো। সে সময় পার্লামেন্টে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। সেখানে আমাদের চেষ্টা ছিলো আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করা যায় কী না। সেই গভীর জঙ্গলে গিয়ে সন্তু লারমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোতে গিয়েছি। তখন আমাদের চেষ্টা ছিলো পার্বত্যবাসীদের ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আর দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু তা্ই না সমতলের যাদের সেখানে অভিবাসন দেয়া হলো তাদেরকে কিভাবে সমতলে পুনর্বাসন করা যায়। তৎকালীন সরকারের কাছে এ বিষয়ে সমাধানের জন্য সুপারিশ করেছিলাম একটা সমাধানের পথে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু সে সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা সেটা মানতে রাজি ছিলেন না। এরপর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে খুব সাহসিকতার সঙ্গে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিক হয়ে উদ্যোগ নিলেন। তার উদ্যোগে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা হলো। এটি বড় ধরণের অগ্রগতি হয়েছিলো।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, চুক্তি সম্পাদনের ২২ বছরে এখনও সব চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। সরকার দাবি করছে শান্তিচুক্তির ৭২টির মধ্যে ৪৮টি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্যদিকে পার্বত্য জনগোষ্ঠী বলছে শুধুমাত্র ২৪টি বিষয়ে চুক্তি পুর্ণবাস্তবায়িত হয়েছে। বাকিগুলো একদমই থেমে আছে। সরকারি ক্রোড়পত্রে প্রতি বছরের ২ ডিসেম্বর যে বাণীগুলো থাকে সেখানে একই রকম বাক্য আমরা দেখি। সেখানে বলা হয়, পূর্ণ বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার আছে এবং সেই প্রক্রিয়া চলছে। এরপর থেকে আর ৪৮ থেকে ৪৯ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না।? এটি হতে কত সময় লাগবে, আদৌ হবে কিনা জানি না। তাই এই ক্রোড়পত্রগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করতে আমরা বাধ্য হই।

তিনি বলেন, মিথ্যার বেসাতি দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। চুক্তির বাস্তবায়ন করাটা আইনগত বাধ্যবাধকতা। এটি না মেনে চললে যিনি চুক্তি লঙ্ঘন করছেন তার উপর এর দায় বর্তায়। এটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও এটি প্রযোজ্য। যখন রাষ্ট্র একটি পক্ষ। তখন রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব থাকে বেশি। রাষ্ট্রপক্ষ কখনও অন্যপক্ষকে দোষারোপ করে নিজের দায়িত্ব থেকে বিরত থাকলে এটি যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।

তিনি বলেন, ৭২টার মধ্যে ৭১টা চুক্তি বাস্তবায়ন হলেও আমি সন্তুষ্ট হবো না। কেননা চুক্তির বিষয়বস্তুর একটি কেন্দ্র থাকে। চুক্তির মূল বিষয়বস্তুকে যদি এড়িয়ে যাওয়া হয় তখন চুক্তির অন্যান্য যে বিষয়বস্তু বাস্তবায়ন করলাম কি করলাম না এটিতে কিছু এসে যায় না।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তির মূল বিষয়বস্তু ভূমির মালিকানা। আমি সবসময় বলেছি একটি মাত্র বিষয়বস্তু বাস্তবায়ন করুন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভূমি মালিকানা ফিরিয়ে দিন। আপনাকে আর কিছুই করতে হবে না। আপনারা আপনাদের মন্ত্রণালয়ে বসে থাকুন। এমনিতেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। সাধারণ এই সোজাসাপ্টা কথাটা রাষ্ট্রের কানে কেন পৌঁছায় না। আমি মনে করি চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই মৌলিক প্রশ্নে আমাদের সোচ্চার হতে হবে।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সুলতানা কামাল বলেন, যে চুক্তি ভঙ্গ করছেন, তাকেই সেই দায় নিতে হবে। যে কেউই হোক। দায় এড়ানো যায় না। চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যপারে তিনি বলেন, ৪৮টি ধারা বাস্তবায়ন হলেই কি হবে। আসল যে ধারা সেটিই তো বাস্তবায়ন হয়নি। এখন সময় আমাদের অধিকারের জন্য আমাদের দাঁড়াতে হবে।

তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় অবস্থা আরও বেগতিক হয়েছে। সেখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পাচ্ছি। চলাচলে বাধা ও নিষেধাজ্ঞা চলছে। যাই হোক চুক্তির ফলাফল আমরা বাস্তবায়িত হতে দেখতে চাই।

চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রনালয় থেকে একটি পরিপত্র দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী এবং প্রশাসন কর্তৃক বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবিক আচরণ এবং হেয় প্রতিপন্ন না করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে। এছাড়া্ও বলা হয়েছে সোনামিয়া টিলাসহ বাঙালিদের বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধারে বাঙালিদের পূর্ণ প্রশাসনিক ও আইনী সহায়তা প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ পরিপত্রে উপজাতিদের জন্যও বিষয়গুলো নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছেনা কেন?

তিনি বলেন, বাঙালিদের ভূমি উদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু পাহাড়িদের ভূমি উদ্ধারের কোন কথা বলা হচ্ছে না। এরকম একটি লিখিত দলিল যদি সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ে দিতে পারে তাহলে আর কি কি অলিখিত কার্যকলাপ করা হচ্ছে এটা যারা পার্বত্য অঞ্চলে থাকেন না তারা কল্পনা করতে পারবেন না।

ভূমি কমিশন আইনটি তিন বছর আগে পর্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ছিলো। আমরা আশা করি খুব শীঘ্রই এর বিধিমালা হয়ে যাবে। আর এর শুনানি হবে। আমরা আশা করি আমরা সুবিচার পাবো।

সুলতানা কামালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অ্যড. নিজামুল হক, মেঘনা গুহঠাকুরতা, নীলুফা দেওয়ানসহ বিভিন্ন উপজাতির প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।

Exit mobile version