parbattanews

সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার না করা পার্বত্যচুক্তি বাস্তবায়নে অন্তরায়- টিআইবি

Cirdap-Nazmul-bg20130518063556
 
 
পার্বত্য নিউজ রিপোর্ট:

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও পাবর্ত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, পার্বত্য অঞ্চলে সংঘটিত বেশির ভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বর্তমান সরকারের আমলে ঘটেছে। ভূমি দখলসহ সব নির্যাতনের ঘটনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে হয়েছে, এমন অভিযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অন্যান্য অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল অতটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়।

পার্বত্য এলাকা থেকে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার না করাকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম অন্তরায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট একটি রাজনৈতিক সংকট। এটি রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা প্রয়োজন। কিন্তু, সামরিক শক্তি দিয়ে এই সংকট নিরসন সম্ভব নয়। সামরিক শক্তির উপস্থিতির কারণে স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা খর্ব করা হয় এবং বেশিরভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সামরিক শক্তির নীরবতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ কারণে অপরাধ প্রবণতা আরো উৎসাহিত হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সব সামরিক ক্যাম্প (প্রায় ৫ শতাধিক) প্রত্যাহার করার কথা। কিন্তু, সরকার বলছে ২৪০টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো ৭০-৮০টি সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকি সব ক্যাম্প এখনও রয়ে গেছে।

আর ২০০৯ সাল থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা বন্ধ রয়েছে। এই ক্যাম্পগুলো রাখার ক্ষেত্রে সরকার যে সব যুক্তি হাজির করে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার হরণের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, “আদিবাসীদের অধিকার হরণের জন্য আদিবাসীদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছে সরকার।”

মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে একদিন মানবাধিকার নিয়ে কথা বললে- ‘বলা হবে দেশে কোনো মানুষই নেই’ বলেও মন্তব্য করেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক।

পার্বত্য এই অঞ্চলগুলোতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করা যেতে পারে। সেখানে সামরিক বাহিনীকে চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সেনাবাহিনীকে নিয়ে টিআইবি’র বক্তব্যকে অসত্য ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে তা প্রত্যাখান করেছে পার্বত্য নাগরিক পরিষদ। এক বিবৃতিতে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাস আল মামুন এ কথা বলেন।

শনিবার রাজধানী সিরডাপ মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন আয়োজিত  ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে এক হাজার ৪৮৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার মধ্যে বেশির ভাগ ঘটনাই এ সরকারের সময়ে ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে ঘটেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

গোলটেবিল বৈঠক পরিচালনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের কো-চেয়ার সুলতানা কামাল।

 আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “সবার অধিকার নিয়ে কথা না বললে একদিন নিজের অধিকার হরণ হয়ে যাবে।” দেশের সক নাগরিককে মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সরকারের উদ্দেশে সুলতানা কামাল বলেন, “অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান উদ্যোগ নিন, যাতে করে জনগণ আশ্বস্ত হতে পারে যে, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক রয়েছে।”
 
সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, “সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। ভূমি বেদখল, নারী ও শিশুর শ্লীলতাহানির চেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা ও সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরে হামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে।”
 
“আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইস্তেহারে পার্বত্য চুক্তি বাস্তয়নের অঙ্গীকার করেছিল। আমরা আশা করেছিলাম, পাহাড়ে স্থায়ীভাবে শান্তি আসবে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সংঘাত ও নৈরাজ্য বেড়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদকে ভূমি ব্যবস্থাপনা, জেলার আইনশৃঙ্খলা, পরিবেশ ও বন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও সরকার নিজের হাতে রেখেছে” বলেন সুলতানা কামাল।

বিভিন্ন কোম্পানি, এনজিও ও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে হাজার হাজার একর পাহাড়ি জমি বেদখল হয়েছে বলে অভিযোগ করে সুলতানা কামাল বলেন, বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের যে কথা বলেছিল, তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেছে।

সুলতানা কামাল বলেন, “দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার আদিবাসী দিবস পালনেও অনীহা প্রকাশ করেছে।”  

ড. স্বপন আদনান বলেন, “পার্বত্য এলাকায় সবচেয়ে বড় দখলদার হচ্ছে বন বিভাগ। তারা প্রায় ২ লাখ একর জমি দখল করেছে। এছাড়া কিছু এনজিও ও বিমান বাহিনীও জমি দখল করেছে।”
 
নারী নেত্রী খুশি কবীর বলেন, “আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিলেও সংবিধানে আদিবাসীদের অস্বীকার করেছে। ‘আদিবাসী’র বদলে বলেছে ‘ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠী’। দেশে ৪০টি ণৃ-গোষ্ঠী থাকলেও তারা ২৭টির কথা বলেছে।”
 
১৯৯৬ সালে অপহৃত কল্পনা চাকমার বিচার আজও না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে খুশি কবীর বলেন, “ওই ঘটনার অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ায় অন্যরা উৎসাহিত হয়েছে।”

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী ড. জাফর ইকবাল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের উপদেষ্টা ড. মেঘনাগুহ ঠাকুরতা, কমিশনের সদস্য ড. স্বপন আদনান, ড. ইয়াসমিন হক প্রমুখ।

পাবর্ত্য নাগরিক পরিষদের বিবৃতি

পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাস আল মামুন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে টিআইবি যে বক্তব্য দিয়েছে তা শুধু অসত্যই নয়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতও বটে। এ ধরণের বক্তব্য প্রদানের এখতিয়ার টিআইবি’র নেই। বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন ধীরে ধীরে মুখোশ খুলে রাজনীতিসহ সব বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। এদেরকে এখানেই থামাতে হবে।

ইঞ্জিনিয়ার মামুন বলেন, টিআইবি’র এই বক্তব্য নতুন কিছু নয়। এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা সুলতানা কামাল দীর্ঘদিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের কো চেয়ার হিসাবে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার পালিয়ে আসছিলেন। এখন টিআইবিকে ব্যবহার করে তার সেই পুরাতন অবস্থানকেই পুনর্ব্যাক্ত করেছেন মাত্র।

তিনি বলেন, টিআইবি’র নামে এই অনুষ্ঠান ডাকা হলেও মূলত: এখানে তথাকথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের নেতারাই বক্তব্য রাখেন এবং তাদের অবস্থানও এক। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালকও ঐ বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত। মূলত: পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে শন্তু লারমার কথিত অলিখিত চুক্তি বাস্তবায়নে চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে টিআইবিকে ব্যবহার করে এই ধরণের বক্তব্য দেয়া হয়েছে বলেও দাবী করেন তিনি।

দেশের উচ্চ আদালত যখন পার্বত্য চুক্তিকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দিয়েছে সেখানে সেই চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী তোলা অবান্তর মন্তব্য করে ইঞ্জিনিয়ার মামুন বলেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে টিআইবি’র এই বক্তব্য অসত্য ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জে. নুরউদ্দীন খান, বর্তমান মহাজোটের শরীক, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাপা চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী না থাকলে এই অংশ বহু আগেই বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যেত।

তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জনগনের জানমালের নিরাপত্তা বিধানই করছেনা বরং সেবা ও শান্তিরক্ষায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেবা ও শান্তিরক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্জিত এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশ্বের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিয়ে দেশের জন্য বয়ে এনেছে দুর্লভ সম্মান। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সেই গর্বিত অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে টিআইবি বরং দেশের এক দশমাংশ এই ভূখণ্ড নিয়ে পরিচালিত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে।

 

Exit mobile version