parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা উচিত – ড. আনিসুজ্জামান

DSC00120 copy

মেহেদী হাসান পলাশ:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা উচিত। তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে মানুষ মাত্রই অভিবাসী। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা যারা নিজেদের আদিবাসী হিসাবে দাবী করছেন তারা কেউ বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা হিসাবে দাবী করছেন না। তারা জাতিসংঘ ও আইএলও’র কনভেনশন অনুযায়ী দাবী করছেন। সেখানকার বাসিন্দারা ইংরেজ আমল থেকে কিছু সুবিধা পেয়ে আসছিলেন যা তারা এখন আবার দাবী করছেন। ইংরেজ আমলেও বাঙালীরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানে বসতি গড়েছে, তাতে কোনো সমস্যা হয়নি। পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই ড্যামের যথাযথ ক্ষতিপুরণ না পাওযায় তারা ক্ষুব্ধ হয়।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কোনো কোনো সার্কেল চীফ স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও জনগণের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনার সময় সমজাতীয়তার ধারণা প্রবল থাকায় সেখানে তাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব হয়নি। সেকারণে সেখানে ব্যাপকভাবে বাঙালী অভিবাসন হয়েছে। এর একটি রাজনৈতিক কারণ ছিল। এতে করে সেখানকার মূল জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ীদের ভূমির কোনো কাগজপত্র নেই। তারা প্রজন্ম ধরে সেখানে প্রথাগত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে আসছে। কিন্তু সরকার বাঙালীদের অভিবাসন করেছে জমির কাগজপত্র দিয়ে। ফলে ভূমি সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা বহুলাংশে সমাধান হয়ে যাবে।

আজ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের স্পেশাল সেমিনার কক্ষে ‘বাংলাদেশের সকল নৃগোষ্ঠীগত অখণ্ড জনগণসত্তা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে গণদৃষ্টিপাত’ শীর্ষক শাস্ত্রীয় সভায় ড. আনিসুজ্জামান প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপিকা ড. খুরশীদা বেগম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।

ড. আনিসুজ্জামান আরো বলেন, আমি মনে করি না আঞ্চলিক পরিষদ ও স্বায়ত্বসাশনের দাবী সংবিধান বিরোধী। তবে যারা প্রদেশ দাবী করছে তারা সংবিধান বিরোধিতা করছে। তিনি রাষ্ট্র ও সরকারকে পাহাড়ীদের সমস্যা একটু সহানুভুতির দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনার অনুরোধ করেন।

সভাপতির ভাষণে ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের সকল নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে পারষ্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এদেশের ১৬ কোটি মানুষের লিগালিটি, ইন্টিগ্রিটি ও ডিগনিটি এক সূত্রে গাঁথা গেলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।  

অনুষ্ঠানের প্রবন্ধকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ১৭শতকের গোড়া থেকে ইউরোপীয় অভিবাসন শুরু হয়। ঠিক একই সময়ে পার্বত্য জনপদবাসীদেরও অভিবাসন শুরু হয়। তাহলে অভিবাসী মার্কিনীদের আদিবাসী না বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীদের কেন আদিবাসী বলা হচ্ছে? ব্যাখ্যা বোধ হয় এই যে, মার্কিন মুল্লুকে রেড ইন্ডিয়ান নামে আদিবাসী আছে। ওদের ক্ষেপিয়ে তুললে অশনি সংকেত অনিবার্য। সুতরাং বিশ্বপুঁজিবাদপোষিত বুদ্ধিজীবী-গবেষকগণ সে দিকে পা মাড়ান নি। তারা আগ্রহী তৃতীয় দুনিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর প্রতি। কারণ নানা ছলছুতোয় এমন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে পারলে পুঁজিবাদী অনুপ্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণের পথ সুগম হয়।

প্রফেসর আনোয়ার হোসেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অধিবাস তারা ইতিহাসের নিরিখে মূলত অভিবাসী। কিন্তু এখন অভিবাসী নয়, নাগরিক-বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের মতোই। কিন্তু তারা আদিবাসী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোনটিই নয়, তারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, এবং তা আর্থ-সামাজিক- সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে। সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আর বড় জাতিসত্তা বাঙালি নিয়ে বাংলাদেশ। সুতরাং বাংলাদেশ মানচিত্রের ভেতর কোন গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক- নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি যুক্তিযুক্ত হলেও তার আত্মঅধিকার প্রয়োগের প্ররোচণা অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রসূত। একই সমান্তরালে বিবেচ্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের উন্নয়ন ঘাটতি ও অধিকার বঞ্চনার বিষয়সমূহ। সুতরাং মনে হয়, সংবিধান ও শান্তিচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলে বাইরের কোন দুরভিসন্ধি হালে পানি পাবে না। উপরন্তু প্রয়োজন জনগোষ্ঠীসমূহের বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গী ও ভূমিকা। অবশ্য সর্বাগ্রে অনুঘটকের ভূমিকা সরকারেরই; এবং যাতে কোন ভ্রান্তি ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ দেশ ও সরকারের জন্য আত্মবিনাশী হবে।

তিনি আরো বলেন, সরকার নিজেই সংবিধান লংঘন করে আছেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের কোনো সুযোগ নেই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মুস্তাফিজুর রহমান তার প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশর প্রাচীন ভুমি ১৮ লক্ষ থেকে ১০ হাজার বছর আগে গঠিত হয়েছে। কাজেই সে সময় কি এখানে মানুষের বসতি ছিল না? ছিল। বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে মানব বসতি গড়ে ওঠে। এর ইতিহাস এখনো সুনির্দিষ্ট না হলেও এখানে  আধুনিক যেসব বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা চলছে, এবং তা থেকে যেসব প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে তা প্রাগৈতিহাসিক। এ সকল প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নবস্তু বিশ্লেষণ করে এ কথা বলা সম্ভব হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বাংলা আগে পুন্ড্র, সমতট, গৌড়, বঙ্গ নানা নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু পুন্ড্র, গৌড়, সমতট টেকেনি। বঙ্গ টিকে গেছে। এ বঙ্গ কালক্রমে বাংলা নামে পরিচিত হয়েছে যার অধিবাসী আমরা বাঙালী। ওয়ারী বটেশ্বরে বাঙালী সভ্যতার ইতিহাস পাওয়া গেছে। সেখানে গুহা মানবের অস্তিত্ব পাওযা গেছে- তারা কারা ছিলেন? তারা আমাদেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন। আমাদের সত্য কথা বলতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের আদিবাসী দাবী ঐতিহসিকভাবে সত্য নয় এবং এটা টিকবেও না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালযের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. খুরশীদা বেগম তার প্রবন্ধে বলেছেন, আদিবাসী বলতে অভিবাসী বোঝায় না। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী হচ্ছে আদিবাসী। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯৮.৫%-৯৯% হচ্ছে বাঙালী এবং বাকি ১-১.৫% হচ্ছে অর্ধশতাধিক গোষ্ঠীবদ্ধ নৃগোষ্ঠী। এখানে ৭০টির মতো নৃগোষ্ঠীর বসবাস।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সমস্যা ভূমি দখল। এটা সারা বাংলাদেশেই রয়েছে। নৃগোষ্ঠী বিচারে তা হচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের চেয়ে অনেক বেশী নৃগোষ্ঠী সমতলে রয়েছে। সমতলে বাঙালী ও ছোট নৃগোষ্ঠীগুলো একসাথে থাকতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন পারছেনা সেটা বিবেচনা করে দেখতে হবে। এর পেছনে কাদের ইন্ধন রয়েছে তা বের করতে হবে।

তিনি বলেন মুক্তিযুদ্ধে চাকমা রাজা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতার পর চাকমা রাজা দেশত্যাগের আগে তার পরিবারকে কি নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল বা পাকিস্তানে বসে তার পরিবারের সাথে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তা বিবেচনা করে দেখা দরকার। বাংলাদেশের ঝড়, বন্যা, মহামারী, দুর্দশা, লাঞ্ছনা, সীমান্ত হত্যা, কোনো বিপদে- বিপর্যয়ে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় কেন কোনো কথা বলেন না তাও বিবেচনা করে দেখা দরকার। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধীরা পিস কমিটি বা শান্তি কমিটি তৈরী করেছিল। তাদের নামানুসারেই পরে শান্তিবাহিনী তৈরী করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে জেএসএস এর প্রতিষ্ঠাতা এমএন লারমা নিরোপেক্ষ ছিল। জাতির এমন ক্রান্তিকালে কারা নিরোপেক্ষ থাকতে পারে তা বিবেচনা করে দেখা উচিত। এর সাথে অনেক প্রশ্নের উত্তর নিহিত।

ড. খুরশীদা বলেন, তারা এমন এক সময় শান্তিবাহিনী তৈরী করে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল যখন দেশের মাটিতে শহীদের রক্তের দাগ শুকায়নি। নতুন জন্ম নেয়া একটি রাষ্ট্র নানা সমস্যা মোকাবেলা করে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। তখন তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। আমরা তাদের আত্ম পরিচয়ের সংগ্রামকে স্বীকার করি কিন্তু তার জন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয়া মেনে নেয়া যায়না। তাদের সংগ্রাম চলতে পারে কিন্তু তা রাষ্ট্রকে অতিক্রম করে নয়।

তিনি আরো বলেন, এক বিদেশী অধ্যাপক এসে জুম চাষের উপর ভিত্তি করে একটি জাতীর নাম দিয়ে গেলেন জুম্ম জাতি। তাহলে বাংলাদেশের ধান চাষী, পাট চাষীকে কি বলা যাবে? তাছাড়া সমতলের অনেক উপজাতি জুম চাষ করে থাকেন। তাদেরকে কিভাবে জুম্মজাতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবেন?

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীর সংখ্যা ৪৮.৫৭%। কিন্তু সেখানে ব্যয়িত বৈদেশিক সহায়তার ৯৮% উপজাতিদের কল্যাণে ব্যয় হয়। মাত্র ২% বাঙালীদের জন্য ব্যয় হয়। বাঙালীদের কি দুঃখ কষ্ট বঞ্চনা নেই? মানবাধিকারের কথা বলে বৈষম্য করেন কিভাবে- প্রশ্ন করেন ড. খুরশীদা।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৫০টি তথাকথিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার দিতে গেলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু থাকে না। কারণ সার্বভৌমত্ব বিভাজিত হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ রক্ত দিয়েছে বিভাজিত সার্বভৌমত্বের জন্য নয়।

Exit mobile version