১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এই অনাকাক্সিক্ষত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পাহাড়ি এবং বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ যেমন হতাহতের শিকার হয়েছে, তেমনি পুড়েছে তাদের বাড়ি-ঘর। জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন পর্যায়ে এ ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল। এমনকি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ঘটনার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর স্থানীয় ইউনিটকে দায়ী করে অভিযোগ উত্থাপন করার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে ঘটনার পর গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে জানানো হয়েছিল। সে যাইহোক, সেসব নিয়ে পাঠকদের বিস্তারিত জানানোর জন্য এ লেখাটি লিখছি না, বরং সে ঘটনাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়ের দু’জন বিশিষ্টি মানুষের লেখায় কীভাবে এসেছে এবং সেখানে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত পার্থক্যটা আসলে কত ব্যাপক সে ব্যাপারে ইঙ্গিত করাই মূল উদ্দেশ্য। যাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যারা জানতে চান, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যারা অবহিত হতে চান তারা অতীতের ঘটনাগুলোর পাশাপাশি চলমান ঘটনাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় একাধিক সোর্স থেকে জানার চেষ্টা করার ব্যাপারে যেন সতর্ক থাকতে পারেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা মূল্যায়ন প্রকাশের পূর্বে সংশ্লিষ্টরা যত বেশি সম্ভব ভিন্ন ভিন্ন সোর্স থেকে সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েই যেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে সচেতন থাকতে পারেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান বিদ্রোহ, বিশৃঙ্খলা, সহিংসতার শুরুর প্রেক্ষাপট এবং সমকালীন রাজনীতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের লেখক সিদ্ধার্থ চাকমা। “প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম” শীর্ষক বইটিতে লেখক কাউখালীর কলমপতি ইউনিয়নের ঘটনাটি যেভাবে তুলে ধরেছেন,
‘আশির পঁচিশে মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের কলমপতি ইউনিয়নে সামরিক বাহিনীর একটি দল নৃশংসতার চরম নজীর রাখে। দিনটি ছিল হাটবার। স্থানীয় মিলিটারি কমা-ার হাটে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দেয় যে, পোয়াপাড়া বৌদ্ধ মন্দির মেরামত করা হবে। তাই উপজাতি বৌদ্ধরা যেন পোয়াপাড়া বৌদ্ধমন্দির প্রাঙ্গণে অনতিবিলম্বে হাজির হয়। পবিত্র মন্দির মেরামত করতে সোৎসাহে উপজাতি বৌদ্ধরা এগিয়ে আসে। মন্দির মেরামতের কাজে অংশগ্রহণে আসা সকলে মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত হলে স্থানীয় মিলিটারি কমা-ার তাদের উপর গুলি ছুঁড়তে নির্দেশ দেয়। স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ারের গুলিতে ঘটনাস্থলে নিমিষে মারা যায় শতাধিক সরলবিশ^াসী ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ উপজাতি। পোয়াপাড়া বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার ও স্থানীয় স্কুল কমিটির সেক্রেটারি কাশীদেব চাকমাও নিহতদের মধ্যে ছিলেন। প্রকাশ্য দিবালোকে গণহত্যায় ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে উপজাতিদের গ্রামে। তারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটে। পোয়াপাড়া বৌদ্ধমন্দিরে গণহত্যার অব্যবহিত পর মিলিটারির প্ররোচনায় একদল শরণার্থী উপজাতি গ্রামগুলো লুঠ করতে শুরু করে। কাউখালি, মুখপোড়া এবং হেডম্যান পাড়া পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। তাদের আক্রমণে মারা যায় অনেক নিরীহ উপজাতি। আরও নয়টি বৌদ্ধমন্দির ধ্বংস করা হয়। পেটানো হয় কুড়িজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে।’ সূত্র: সিদ্ধার্থ চাকমা, প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম, নাথ ব্রাদার্স, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, অগ্রহায়ণ ১৩৯২ বঙ্গাব্দ (১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ), পৃ. ৮৪।
সিদ্ধার্থ চাকমার বর্ণনার সারমর্ম: স্থানীয় মিলিটারি কমান্ডার বৌদ্ধমন্দির মেরামতের কথা বলে ডেকে এনে বৌদ্ধ উপজাতীয় শতাধিক ব্যাক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন। এর পর শরণার্থীদের প্রোরচনা দিয়ে আশপাশের গ্রামের উপজাতীয়দের হত্যা এবং তাদের বাড়ি-ঘর-মন্দির লুটপাট করে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। অর্থাৎ এই বর্ণনা থেকে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, স্থানীয় মিলিটারি এবং তাদের প্ররোচনায় এ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে। আরো সংক্ষেপে বলা যায়, স্থানীয় মিলিটারি ইউনিট ঠা-া মাথায় পরিকল্পিতভাবে নিরাপরাধ মানুষদের হত্যা করেছে এবং তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়েছে। এখানে আর কারো কোনো দায়-দায়িত্ব বা অপরাধ নেই।
এখন আসুন, একই ঘটনা আমরা বিশিষ্ট চাকমা লেখকের ভাষায় কীভাবে ফুটে উঠেছে, সেটাই দেখার চেষ্টা করি। রাঙ্গামাটি বারের সিনিয়র আইনজীবী জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা তার “ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ” শীর্ষক বইয়ে কলমপতি ইউনিয়নের ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন,
‘স্থানীয় উপজাতীয় জনগণ এবং পুনর্বাসিত বাঙ্গালীদের মধ্যেকার বিরোধেরে প্রথম ভয়াবহতম বিস্ফোরণ ঘটে ২৫শে মার্চ ১৯৮০ ইং তারিখে বর্তমান কাউখালী থানাধীন কাউখালী থানা সদর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায়। ঐদিনের ঘটনার বিবরণ সেই সময় তাৎক্ষণিকভাবে রাঙ্গামাটিতে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে এলাকায় বসবাসকারী উপজাতীয় এবং পুনর্বাসিত বাঙালী নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে ঘটনার পূর্বেকার অবস্থা এবং মূল ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।’
‘পুনর্বাসিত বাঙালী নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী ২৫শে মার্চের পূর্ববর্তী সপ্তাহ থেকে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা পুনর্বাসিত বাঙালীদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ সম্বলিত বেশ কিছু পোষ্টার লোক চলাচলের রাস্তায় লাগাতে থাকে। এমনকি তারা রাতের অন্ধকারে এধরণের পোস্টার রাস্তায় ফেলে রেখে যেত। এতে স্বাভাবিকভাবে পুনর্বাসিত বাঙ্গালীদের মনে দারুন আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তারা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে থাকে।
‘বিভিন্ন হুমকি সম্বলিত শান্তিবাহিনীর এসব পোস্টার এবং প্রচারপত্র বিলির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা এবং ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কল্পে কর্মসূচী প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষ ২৫শে মার্চ সকাল ৯টায় পোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানীয় উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং পুনর্বাসিত বাঙালী দলপতিদের এক সভা আহ্বান করেছিলেন। স্থানীয় উপজাতীয় জনগণের সূত্রে জানা গেছে যে, ২৬শে মার্চ উদযাপন কল্পে ২৫শে মার্চ সকালে পোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন পোয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহারের বাগান ও জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন করে লোক দেওয়ার জন্য স্থানীয় ক্যাম্প অধিনায়ক পূর্বেই উপজাতীয় পাড়ার কার্বারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদনুযায়ী কাউখালী সদরের পাশর্^বর্তী পাড়া থেকে আনুমানিক ৫০/৬০ জন উপজাতীয় লোক ঘটনার দিন সকালে পোয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহারের বাগান ও জঙ্গল পরিষ্কার করতে এসেছিল।
‘সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আহুত সভায় যোগদানের জন্য ৯টার আগেই কিছু পুনর্বাসিত বাঙালী দলপতি এবং উপজাতীয় নেতা কাউখালী বাজারে এসে বিভিন্ন চায়ের দোকানে বসে চা নাস্তা খাচ্ছিলেন। এ সময় কাউখালী থানা সদর এবং পার্শ্ববর্তী পাড়ার কার্বারীগণের একটা অংশ পোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন সেনা ছাউনিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সভা শুরু হবার পূর্ব মুহুর্তে সকাল আনুমানিক ৯টার সময় কাউখালী বাজারের পশ্চিম দিক থেকে একটি গুলির আওয়াজ হয়। পরক্ষনেই কাউখালী বাজারের চারদিক থেকে ব্যাপকভাবে গোলাগুলি শুরু হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুনর্বাসিত বাঙালী নেতাদের কাছ থেকে জানা যায় যে, গোলাগুলির সাথে সাথে পোয়াপাড়া, মাইগ্যামাছড়া, বেতছড়ি, মিতিঙ্গাছড়ি, হাতিমারা, কাশখালী, ছোট ডলু ইত্যাদি গ্রামে পুনর্বাসিত বাঙালীদের বাড়ীঘরে আগুন জ¦লতে থাকে এবং কিছুক্ষনের মধ্যে পুনর্বাসিত বাঙালীদের কয়েক হাজার বাড়ী পুড়ে ছারখার হয়।
‘এদিকে কাউখালী সেনা ছাউনির দিকে চারদিক থেকে বৃষ্টির মত গুলি আসতে থাকে এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় পুনর্বাসিত বাঙালীরা ভয়ে আর্তচিৎকার করতে থাকে। পুনর্বাসিত বাঙালী নেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে যে, ঐ সময় কাউখালী সদরের এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে ৩০১৯ পরিবার পুনর্বাসিত বাঙালী বসবাস করছিলেন। গোলাগুলি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এসব বাঙালীরা প্রান ভয়ে কাউখালী বাজারে এসে সমবেত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তারা সেখানেই সাময়িকভাবে আশ্রয় নেয়।
‘শান্তিবাহিনীর হামলায় উপজাতীয়দের একটা অংশ সহযোগিতা করেছে এবং পুনর্বাসিত বাঙ্গালীদের বাড়ীঘর জ¦ালানোর কাজে অংশগ্রহণ করেছে বলে অভিযোগ আছে। শান্তিবাহিনী এবং উপজাতীয়দের এই সম্মিলিত হামলায় ৭ জন পুনর্বাসিত বাঙ্গালী নিহত হয়েছে বলে হিসাব পাওয়া গেছে। শান্তিবাহিনীর হামলা সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। শান্তিবাহিনীর হামলা প্রতিহত হওয়ার পর পরই পুনর্বাসিত বাঙ্গালীরা কাউখালী থানা সদর এবং এর পার্শ্ববর্তী পোয়াপাড়া, বেতছড়ি, মিতিঙ্গাছড়ি, রাঙ্গীপাড়া, কচুখালী, ছোট ডলু, মাইগ্যামাছড়া, কাশখালী, হারাঙ্গীপাড়া ইত্যাদি উপজাতীয় পাড়ায় পাল্টা হামলা চালিয়ে শত শত ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। পুনর্বাসিত বাঙ্গালীদের এই হামলায় শতাধিক উপজাতীয় লোক মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সরকারীভাবে এর কোন পরিসংখ্যান বা হিসাব পাওয়া যায়নি।—
‘সেনাবাহিনী কর্তৃক আহুত সভায় যোগদানকারী যে সকল নেতৃস্থানীয় উপজাতীয় ব্যক্তি ঘটনার সময় কাউখালী সদরে উপস্থিত ছিলেন অথচ প্রানে বেঁচে গেছেন, তাদের মধ্যে পোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব অমরেন্দ্র রোয়াজা, কলমপতি ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান জনাব চাইন্দ্যু কার্বারী এবং পোয়াপাড়ার মৃত ক্ষিতিশ রঞ্জন তালুকদারের পুত্র জনাব পরিমল কান্তি তালুকদারের নাম পাওয়া গেছে। শেষোক্ত ব্যক্তি কাউখালী সদরে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। স্থানীয় সেনাকর্তৃপক্ষ তাকে কাউখালী থেকে হেলিকপ্টার যোগে চট্টগ্রাম সামরিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। চিকিৎসার ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত প্রানে বেঁচে যান। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পরবর্তীকালে তারা ২৫ শে মার্চের ঘটনা বিশেষতঃ কাউখালী থানা সদর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় সংঘটিত ঘটনার বিবরণ স্থানীয় জনগণের কাছে দিয়েছিলেন।’ সূত্র: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাক্মা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ, স্থানীয় সরকার পরিষদ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, সংশোধিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ: ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ইং, পৃ. ১৪৪-১৪৬।
জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমার লেখা বিবরণের সারমর্ম: শান্তিবাহিনী শরণার্থীদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছিল। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সেনাবাহিনী মিটিং ডেকেছিল। সেই সাথে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য মাঠ পরিষ্কার করাও উদ্দেশ্য ছিল। সেখানে ৫০/৬০ জন উপজাতীয় লোক এসেছিলেন। তাদের কিছুসংখ্যক লোক বাজারে চা-নাস্তা করছিলেন। অন্যরা মন্দিরপ্রাঙ্গণে উপস্থিত হওয়ামাত্রই শান্তিবাহিনী বাজার এবং সেনাক্যাম্প লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ শুরু করে। একই সময়ে তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে আগুন দিয়ে বাঙালিদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ধ্বংস করে। এ সময় বাধ্য হয়েই হোক আর নিজেদের ইচ্ছাতেই হোক স্থানীয় উপজাতীয় কিছুসংখ্যক মানুষ শান্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে বাঙালিদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ধ্বংস করতে। সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে যখন শান্তিবাহিনী পালাতে বাধ্য হয়, তখন দেখা যায় ৭ জন বাঙালি নিহত হয়েছেন এবং তাদের অসংখ্য ঘর-বাড়ি পুড়ে ছাড়খার হয়েছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে বাঙালিরা আশেপাশের উপজাতীয় গ্রামগুলোতে হামলা করে তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং এতে অনেক উপজাতীয় লোকজন হতাহত হয়। অপর দিকে সেনাবাহিনী আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। উপজাতীয় কোনো কোনো আহত ব্যক্তিকে জরুরিভিত্তিতে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ-এ নিয়ে গিয়েও চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেছে সেনাবাহিনী।
অর্থাৎ ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে শান্তিবাহিনী, প্রথম আক্রমণ করে বাঙালিদের হত্যা করেছে শান্তিবাহিনী, তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে ছাড়খার করেছে শান্তিবাহিনী, সেনাক্যাম্প এবং থানা সদরে পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে শান্তিবাহিনী। তাদেরকে সহযোগিতা করেছে স্থানীয় কিছু উপজাতীয় লোক। আর সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালিয়ে শান্তিবাহিনীর হামলা প্রতিহত করেছে, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। অন্যদিকে শান্তিবাহিনীর হামলা প্রতিহত হওয়ার পর ক্ষুব্ধ বাঙালিদের পাল্টা আক্রমণ শুরু হওয়ার আগে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারাই এখানে সেনাবাহিনীর স্থানীয় ইউনিটের একমাত্র ব্যর্থতা। কিন্তু সিদ্ধার্থ চাকমার লেখা পড়লে কি সেটা বোঝা যায়?
দ্রষ্টব্য: এখন কেউ যদি শুধুমাত্র সিদ্ধার্থ চাকমা বা অনুরূপ কারো লেখা পড়ে কাউখালীর কলমপতি ইউনিয়নের ঘটনা সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন। কিংবা এ ধরনের একপেশে লেখা পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য ঘটনার স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা করতে চান তাহলে কী ভয়াবহ অন্ধকারের মধ্যেই তাকে থাকতে হবে সেটা কি ভাবা যায়? তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যারা জানতে চান, যারা গবেষণা করতে চান, যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে লিখতে চান তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, যতদূর সম্ভব প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সোর্স থেকে জানার চেষ্টা করলে কিছুটা হলেও সঠিক তথ্য পাওয়া বা জানার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলেই সচেতন থাকবেন, সেটাই প্রত্যাশা।
[উদ্ধৃতাংশে বইদুটিতে বিভিন্ন শব্দের বানান যেভাবে এসেছে, এখানেও তা হুবহু রাখা হয়েছে।]
লেখক: সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক
sayedibnrahmat@gmail.com
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর গণহত্যা ভূষণছড়া হত্যাকাণ্ড
পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন নিয়ে বাঙালিরা শঙ্কিত কেন?
শান্তিচুক্তির ২২ বছর: পার্বত্য চট্টগ্রামে গুম খুন চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না কেন?
দুই যুগেও হয়নি পাকুয়াখালী গণহত্যার বিচার
পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন ও দীপংকর তালুকদারের বক্তব্য
মাটির পাহাড়ের বিমান বন্দর হবে না!
পর্যটন পরিকল্পনার লক্ষ্য হোক সাজেক থেকে সেন্টমার্টিন
পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃশংস গণহত্যা পাকুয়াখালী ট্রাজেডি
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেই নিহিত আছে পার্বত্য ভূমি সমস্যার সমাধান
ভূমি কমিশন আইন: পার্বত্যাঞ্চল থেকে বাঙালি উচ্ছেদের হাতিয়ার
পার্বত্য সংকট ও রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ প্রসঙ্গ
পার্বত্য চট্টগ্রামে অপ্রতিরুদ্ধ খ্রিস্টান মিশনারীরা
পার্বত্যাঞ্চলে সাধারণ মানুষের উচ্চ শিক্ষার পথ রুদ্ধ করার পাঁয়তারা
পার্বত্য চুক্তিতে জাতিগত বৈষম্যসমূহ