parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রামের চিনা জোঁকের আক্রমণ একটা মহাসমস্যা

(আট)

ফারুয়াতে ব্যটালিয়ানের কমান্ড টেকওভার করেছি সতের দিন । ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে মেসেজ আসলো প্রেসিডেন্ট ও চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তিনি দুমদুমিয়া থুমে অপারেশনাল ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন যা আমাকে আগামী বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে স্হাপন করতে হবে ।

দুমদুমিয়া থুম বাংলাদেশ ভরতের মিজোরাম রাজ্যের সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফারুয়া থেকে সোজা পুর্বে পাহাড়ীদের জন্য দেড়দিনের এবং আমাদের জন্য দুই থেকে আড়াই দিনের পথ । একটা কথা বলে নেয়া জরুরী মনে করছি । পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় বা রিজলাইনসমুহ উত্তর- দক্ষিণে লম্বালম্বি চলে গেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত । একবার রিজলাইনে উঠতে পারলে রিজের উপরের পথ সমতল এবং সহজ পরিক্রমণযোগ্য । কিন্তু কঠিন হলো পুর্ব পশ্চিমের হাটা পথ । একবার পাহাড়ে কষ্ট করে উঠতে হবে এবং একই রকম কিংবা আরো কষ্টসাধ্য ভাবে পাহাড় থেকে নীচে নেমে পথ বের করে তার পরে পথ চলতে হবে ।


এই ধারাবাহিকের আগের লেখাগুলো পড়ুন

  1. ♦ পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার অভিজ্ঞতা

  2. ♦ জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে পোস্টিং করেন

  3. ♦ বঙ্গবন্ধু আর্মি অফিসার মেস থেকে মদের বার তুলে দেন

  4.  ফারুয়া ব্যাটালিয়ান সদরে প্রথম দিন 

  5.  পাহাড় পথে হাঁটার প্রথম অভিজ্ঞতা হলো

  6.  সব হেডম্যানের সাথে শান্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে

  7.  পাহাড়ীরা সর্বভূক এমন কিছু নাই যে খায় না


রিজলাইন ছাড়া পাহাড় ডিঙ্গিয়ে চলার পথ বের করে তার পরে পথ চলতে হবে । গভীর জঙ্গলে ভরা পাহাড়ের মধ্যে পথ বের করে তার পরে পথ চলা যে কি কঠিন কাজ তা পাহাড়ে না চললে উপলব্ধি করা সম্ভব নয় । মাঝে মাঝে পাহাড়ের কাঁটাভরা জঙ্গল কেটে কেটে অগ্রসর হতে হয়। এই জন্য পাহাড়ে চলার সময় দা বহন করতে হতো। তার উপরে বন্য হাতির উপস্থিতি । পথ চলছি, হঠাৎ বন্য হাতির পাল নজরে এলে তখন কি যে ভীতিকর অবস্থা হয় এটা বলে বুঝানো যাবে না ।

আমার সময় শক্কুরছড়িতে তিন / চারটি বন্য হাতির একটি দল আটকা পড়ে মহা তান্ডব সৃষ্টি করেছিলো । সে ব্যাপারে পরে আলোচনা করব ইনশাল্লাহ । পাহাড়ে বন্য হাতির পালের সাথে সাথে চরতে থাকা হাতি দল ছাড়া হয়ে ভীত সন্ত্রস্ত বন্য হাতি মানুষকে আক্রমণ করে বসে । সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো গহীন জঙ্গলে বন্য হাতিকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন কাজ । মনে হবে সবখানেই বন্য হাতি দাঁড়িয়ে আছে এই বুঝি আক্রমণ করে বসবে?

এই সময়ে সৈনিকদের মধ্যে একধরনের আক্রান্ত হবার ভয় কাজ করে ফলে গুলি ফায়ার করার প্রবনতা বেড়ে যায় । আমার ব্যটালিয়ানের অনেক সৈনিক পেট্রলিং এ গিয়ে বন্য হাতির ধাওয়া খেয়ে পাহাড়ের খাদে পড়ে কঠিন ভাবে আহত হয় । পরে তাদের অনেকের ক্যাটেগরি ( সক্ষমতা ) ডাউন হয়ে সামরিক বাহিনীতে চাকরির অযোগ্য হয়ে পড়ে । এমনিতেও ঘন জঙ্গলে কোথায় পাহাড়ের খাদ লুকিয়ে আছে আগাম জানতে পারা যায় না। ফলে গহীন জঙ্গলে পাহাড়ী পথে চলাচলের সময় একটু অসাবধান হলে পাহাড়ের খাদে পড়ে হাত, পা এবং কোমরে ভীষণ অঘাত পাওয়ার একটা সাধারণ ব্যাপার ।

পাহাড়ী পথে গাছের ডালে একপ্রকারের বিষধর সবুজ ভাইপার জাতীয় সাপ অনেক সময় পথচারীদের দংশন করে । সেটাও একটা বিপদ বটে । পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের লেপার্ড বা চিতাবাঘ বাচ্চা দেবার পরে তার ডেনের সামনে দিয়ে কেউ গেলে তাকে আক্রমণ করে। পাহাড়ের ভল্লুকের আক্রমণে পড়ে অনেকে পাহাড় থেকে নীচে পড়ে হাত পায়ের চামড়া ছিলে ফেলে এমন ঘটনা প্রায় ঘটে। সাপের কামড় থেকে বাঁচার জন্য পাহাড়ে প্রবেশের পুর্বে সব র‌্যাঙ্কের অফিসার ও সৈনিকদের বিশেষ করে সাপে কাটলে করণীয় কি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা হয় ।

পাহাড়ে যে হাতির বিপদ তা শুধু নয়, হাতি পোকা নামে এক ধরনের কালো ছোট্ট পোকা যা আর্মির দ্বারা সরবরাহকৃত মশারিতে অনায়াসে ঢুকে শুধু রক্ত যে খায় তা নয়, এর কামড়ের হাত থেকে বাঁচতে মশারি টানা বিছানার চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করতে হয়।

কল্পনা করতে পারেন, পাহাড়ের গহীন বনে ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বিছানার চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টির পরে সেই বিছানায় কেমন আরামের ঘুম হতে পারে? তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে রাত যাপনের রোমান্টিকতা বর্ণনা করার মতো নয় । রাত তিনটার পরে পাহাড়ের আবহাওয়া শীতল হয়ে আসে এবং গাছের পাতা বেয়ে টপটপ করে শিশির পড়তে আরম্ভ করে । ঐ সময়টাতে মনে হবে আমি কোন রোমান্টিক দুনিয়াতে হারিয়ে গেছি!

অামাদের সময় পেট্রলিংএ যাবার কালে পঞ্চ ( মালয়েশিয়ার তৈরী হ্যামাকজাতীয় বৃষ্টি প্রতিরোধক বিছানা সবাইকে বিগপ্যাকে কেরি করতে হতো ) । যেখানেই রাত হতো এই হ্যামাকজাতীয় বিছানা গাছের কান্ডের সাথে ঝুলিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা । এটাকে পঞ্চ বলা হতো কারণ, হ্যামাকের উপরে পাঁচ কোনার একটি তাঁবু ও মশারিরমতো কাভার ঝুলিয়ে দিতে হতো বৃষ্টির পানি, হাতিপোকা এবং মশার কামড় থেকে মুক্ত থাকার জন্য । কিন্তু পাহাড়ের বৃষ্টির তোড় এতো বেশী যে সবাইকে কাক ভেজা হতে হতো । নিরাপত্তার জন্য গায়ের কাপড় গায়ে শুকানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না । মশার কামড় থেকে মুক্ত থাকাতে হাতে পায়ে মসকিটো র্যাপালেন্ট ব্যবহার করতে হতো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চীনা জোঁকের আক্রমণ একটা মহা সমস্যা বলে মনে করি । পেট্রলিংএ প্রেরিত প্রত্যেক সৈনিক এবং অফিসারের শরীর চীনা জোঁকের আক্রমণে যেন ঝাঁঝরা হয়ে যেতো। এই জন্য সবাইকে বাধ্যতামুলক ভাবে লবন বহন করতে হতো । পাহাড়ে একপ্রকারের আটালী পোকা আছে যা বিশেষ করে মাথায় এবং কানের ছিদ্রে ঢুকে রক্ত চুষে খায় । সমস্যা সেটা নয় । এই আটালী পোকার অস্তিত্ব শরীরে যখন টের পাওয়া যায় তখন আক্রান্ত ব্যক্তি ব্যথায় কাতরাতে থাকে । মাথার আটালী পোকা সহজে চিমটি দিয়ে ধরে টেনে উঠানো সম্ভব হলেও কানের ভিতরের আটালী পোকা রক্ত খেয়ে এমন ফুলে ঢোল হয় যে একে বের করার সময় ব্যথায় সৈনিকদের চিৎকার দিতে দেখেছি ।

আমি ফারুয়াতে যাবার পরে পেট্রলিংএ সৈনিকদের প্রেরণের সময় যে প্রধান অসুবিধা ফেস করেছিলাম তাহলো ঐসময় আর্মিতে ড্রাই ফুড সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা তখনও গড়ে ওঠেনি । যে যে যার মতো ইম্প্রোভাইজড মেথডে পেট্রলিং এ সৈনিকদের ফুড সপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করতো ।

আমি সংবাদ পেলাম যে ফারুয়ার দক্ষিণ পুর্বে জনমানবহীন গভীর জঙ্গলে শান্তি বাহিনীর ক্যাম্পের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা গেছে। আমি এডজ্যুটেন্ডকে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়? এডজ্যুটেন্ডের উত্তর ছিলো পেট্রোলিংএ যাবার সময় সৈনিকদের রেশন মানি দেওয়া হতো । প্রয়োজনে সৈনিকরা বাজার থেকে বা লোকালয় থেকে খাবার কিনে খেতো । যদি খাবার কম পড়তো তাহলে নিকটবর্তী ক্যাম্পে সংবাদ দিলে সেখান থেকে খাবার সরবরাহ করা হতো । এটা ভালো ব্যবস্হা । কিন্তু আমি যেখানে শান্তি বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সংবাদ পাচ্ছি সেখানে কোনো গ্রাম বা জনবসতি নাই । তদুপরি ঐএলাকা আমাদের ক্যাম্প থেকে অনেক দুরে । চিন্তায় পড়ে গেলাম কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়?

ব্যাটালিয়ান সেকেন্ড ইন কমান্ড ( টুআইসি ) আমার কোর্সমেট মেজর কাদেরের ( বর্তমানে লে : কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত ) সাথে পরামর্শ করে আমরা ঠিক করলাম সৈনিকদের তিনদিনের খাবার হিসেবে শুকনা চিড়া এবং ঢেলা গুড় দেব । সৈনিকরা হ্যাভার্সেকে এই খাবার সংরক্ষণ করবে । একদিন পরে ওয়ারলেসে সংবাদ এলো সৈনিকদের শুকনা খাবার ( রেশন ) শেষ হয়ে গেছে । এমনতো হবার কথা নয়। পেট্রোল কমান্ডারকে বললাম ব্যাটালিয়ানে ফিরে আসতে। পরদিন সকালে পেট্রোল কমান্ডারকে আমার অফিসে ডেকে জানতে চাইলাম সৈনিকরা তিনদিনের শুকনা খাবার ( রেশন ) একদিনে কিকরে খেয়ে ফেললো? তার জবাবে সে এক মজার ঘটনা বললো। সে বললো স্যার চিড়া আর গুড় মিশানো খাবার সৈনিকরা তাদের হ্যাভার্সেকে রেখে পথ চলার সময় আস্তে আস্তে কখনযে খেয়ে শেষ করে ফেলেছে তা নিজেও টের পাই নাই ।

আমি পেট্রোল কমান্ডারকে বিদায় করে দিয়ে রাতে সমস্যাটি নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করে করণীয় ঠিক করে ফেললাম । আমি সকালে ব্যাটালিয়ানের টেইলর মাষ্টারকে আমার অফিসে ডেকে পাঠালাম । তাকে আদেশ দিলাম প্রায় দুইশতের মতো ছোট পোটলার মতো ব্যাগ এবং একশত মধ্যম সাইজের পোটলা বানাতে । টেইলর মাষ্টার ভ্যাবাচাকার মতো আমার মুখের দিকে চেয়ে জ্বী স্যার বলে চলে গেলো । এর কয়দিন পরে আমাকে সব পোটলা ব্যাগ দেখানো হলো । সুবেদার মেজর সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন স্যার এই সব পোটলা দিয়ে কি হবে? আমি বললাম পেট্রলিংএ নিয়ে যাওয়া হবে । পরদিন তিনদিনের খাবার হিসেবে শুকনা চিড়া আর গুড় মিশানো খাবার ব্যাটালিয়ান কোয়ার্টার মাষ্টার হাবিলদারকে প্রত্যেক সৈনিকের জন্য বরাদ্দ তিনদিনের রেশন ছোট ছোট পোটলাতে ভরতে নির্দেশ দিলাম। অর্থাৎ প্রত্যেক সৈনিকের জন্য বরাদ্দ তিনদিনের রেশন ন’টি ছোট পোটলাতে ভরা হলো। এবং এই তিনটি খবার ভর্তি ছোট্ট পোটলা একটি মধ্যম সাইজের পোটলায় ভরতে বললাম। এভাবেই পেট্রলিংএ গমনকারী সৈনিকদের জন্য পোটলা রেডি করা হলো।

পরদিন সকালে একই সৈনিকদের দ্বারা গঠিত লংরুট পেট্রলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম একটি মধ্যম সাইজের পোটলা তুলে ধরতে । সব সৈনিক তুলে ধরলো । বললাম পোটলা খোলো । সব সৈনিক পোটলা খুললো । এই পোটলায় কয়টা ছোট পোটলা আছে? সবাই বললো স্যার তিনটা । এবারে বললাম একটা ছোট পোটলা তোলো । সব সৈনিক তুলে ধরলো । বললাম এটা সকালের ব্রেকফাস্ট, দ্বিতীয়টা দুপুরের লাঞ্চ এবং তৃতীয়টা রাতের ডিনার । এবারে পেট্রোল কমান্ডারকে ডেকে ব্রিফ করলাম । বললাম যখন খাবার সময় হবে তখন তুমি নিজে সবাইকে বসিয়ে একটা মধ্যম সাইজের পোটলা খুলে তাথেকে একটা ছোট পোটলা বের করে খাবার আদেশ দিবে। খাওয়া শেষে মধ্যম পোটলা বেঁধে হ্যাহ্যাভার্সেকে রেখে পথ চলবে। তোমার আদেশে পোটলা খুলবে এবং তোমার আদেশে খাওয়া হবে এবং তোমার নির্দেশে হ্যাভার্সেক বন্ধ হবে। তোমার আদেশ ছাড়া কেউ খাবার পোটলায় হাত দিবেনা । ঠিকই একই পেট্রোল একই খাবার খেয়ে তিনদিনের সাক্সেসফুল পেট্রলিং করে ব্যাটালিয়ানে ফিরে আসলো ।

-চলবে

♦ মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান: প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর ।

Exit mobile version