parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ: প্রেক্ষাপট ও শান্তির সম্ভাবনা

PP

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সরোয়ার হোসেন, এইচডিএমসি, পিএসসি

জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ ও বিগত বছরগুলোর অর্থনৈতিক মন্দাসত্ত্বেও প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ও গার্মেন্টশিল্পে নিয়োজিত লাখ লাখ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রম বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই বিপুল জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণ করা রাষ্ট্রের একটি অন্যতম দায়িত্ব। এটা অনস্বীকার্য যে, এই বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য ও আবাসনসহ অন্যসব প্রয়োজনীয়তা মেটাতে প্রতিনিয়তই আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। তাই সার্বিক কল্যাণের জন্য আমাদের প্রতি ইঞ্চি জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চল। দুর্ভাগ্যবশত, ভাতৃঘাতী সশস্ত্র সংঘাত আর বিরাজমান ভূমি সমস্যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় অর্থনীতিতে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। ভূমি সমস্যার সমাধান বিলম্বিত হওয়ার কারণে প্রত্যাশিত উন্নয়নও ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি ভূমি সমস্যা সমাধানে দীর্ঘসূত্রতা শান্তিচুক্তির মতো ঐতিহাসিক অর্জনকে খানিকটা ম্লান করেছে। গত কয়েক শ বছর ধরে বিভিন্ন উপজাতি ও তাদের পূর্বপুরুষরা সীমান্ত অতিক্রম করে পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করে এবং বিশেষ বিধানের আওতায় এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ‘The Chittagong Hill Tracts Regulation-1900’ অনুযায়ী অত্র এলাকার জমির প্রকৃত মালিক জেলা প্রশাসক তথা সরকার। জমির ওপর উপজাতীয় জনগণের অধিকারের ভিত্তি বা যুক্তি যাই হোক না কেন, এটা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর এই সনাতনী চিন্তা-ভাবনা অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রভাব বিস্তার করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা আজ থেকে কয়েক শ বছর আগে মূলত তৎকালীন বার্মা ও আরাকান বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে এই অঞ্চলে আগমন করে। একই সময়ে অর্থাৎ ১৬৬০ দশকের দিকে মোগলরাও অত্র এলাকায় আগমন করে এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে চট্টগ্রামের সমতল ভূমি থেকে বাঙালিদের এনে বসবাসের সুযোগ করে দেয়। মোগল ও ব্রিটিশের পর পাকিস্তান সরকার পাহাড়িদের জমি এবং আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদ করে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। উচ্ছেদ-পরবর্তী সময়ে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের টাকা না পেলে উপজাতীয় জনগোষ্ঠী প্রচণ্ডভাবে সংক্ষুব্ধ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা-পরবর্তী পার্বত্য এলাকায় সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। যাই হোক, সার্বিক প্রেক্ষাপটে বিরাজমান ভূমি সমস্যাই এখন গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনার সঠিক নিয়মনীতির অভাব, এ বিষয়ে সনাতনী চিন্তা-চেতনা, একাধিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও সবশেষে সমতল ভূমি থেকে বাঙালিদের এনে পাহাড়ে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে।

ভূমি সমস্যা নিরসনকল্পে, বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে একটি আইন পাস করেছে এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান করে ভূমি কমিশন গঠন করেছে। পর পর চারটি কমিশন গঠিত হলেও অদ্যাবধি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। সম্প্রতি জনসংহতি সমিতি ‘CHT Land Dispute Settlement Commission Act 2001’ সংশোধনের কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে, যা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। অতি সম্প্রতি সরকার কিছু প্রস্তাবনা মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদনের মাধ্যমে ভূমি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপৃর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তদুপরি, ভূমি সমস্যা সংশ্লিষ্ট অন্তরায়সমূহ সবার প্রজ্ঞা, সহনশীলতা ও সর্বোপরি দেশপ্রেম ছাড়া সমাধান করা কঠিন হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক অনন্য সাধারণ ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল। যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন শ্রেণী-গোত্রের মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর পাহাড়-লেক বেষ্টিত বৈচিত্র্যময় ভূমির অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। জনসংখ্যার জীবনযাত্রার মান পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, গত কয়েক বছর অত্র অঞ্চল আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যা ১৫,৯৮,২৯১ জন। বাঙালি ছাড়াও এখানে ভিন্ন ভিন্ন ১৩টি উপজাতি বসবাস করে। এরা হচ্ছে_ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বোম, পাংখোয়া, খুমি, চাক, লুসাই, উসাই এবং রিয়াং। মোট জনসংখ্যার ৪৭% বাঙালি, ২৬% চাকমা, ১২% মারমা এবং ১৫% অন্যান্য উপজাতি। সব উপজাতীয়র মধ্যে চাকমা উপজাতি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধন-সম্পদে যথেষ্ট এগিয়ে আছে। ভূমি সমস্যা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভের জন্য অত্র অঞ্চলে উপজাতীয় জনগণের আগমন, ধারাবাহিক প্রসার আর ঐতিহাসিক বিবর্তন সম্মন্ধে জানা প্রয়োজন। যার কিছুটা এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা যখন বঙ্গোপসাগর এলাকায় আগমন করে, তখন আরাকান সাম্রাজ্য তাদের সহজ শর্তে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থান করে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেয়। এর মাধ্যমে রেভিনিউ সংগ্রহ ছাড়াও আরাকান রাজ্য-পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী মোগলদের বিরুদ্ধে সমরবিদ্যায় পারদর্শী পর্তুগিজ বাহিনীকে কাজে লাগায়। ১৬০০ সালের শুরুর দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কিছু ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী খাগড়াছড়ি এলাকায় আগমন করে এবং সেখানে জুম চাষের মাধ্যমে জীবনযাপন শুরু করে। চাকমাদের আগমনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও কিছু কল্পকথা প্রচলিত রয়েছে। যার ব্যাপারে অনেক গবেষক একমত পোষণ করেন। ধারণা করা হয়, চাকমারা আরাকানের চম্পকনগর এলাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতবর্ষের বিহার থেকে আরাকান পর্যন্ত বেশ কয়েকটি চম্পকনগর রয়েছে। এমনকি রাঙামাটিতেও চম্পকনগর নামক একটি জায়গা রয়েছে। মোগলদের আগমনের পূর্ব-অবধি চাকমা জাতির ইতিহাস কল্পনাপ্রসূত হলেও তা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। পৌরাণিক সূত্র মোতাবেক, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজপুত্র বিজয়গিড়ী রাজ্য জয়ের জন্য একদা বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে পূর্ব দিকে রওনা দেন। তিনি মেঘনা নদী অতিক্রম করে আরাকান রাজ্য জয় করে সেখানে চাকমা বসতি গড়ে তোলেন। তখন এ অঞ্চলটি ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল থেকে প্রভাবশালী হিন্দু ও শক্তিশালী মুসলিম সভ্যতার প্রভাবে নিষ্পেষিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আশ্রয়স্থল হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্তুগিজ কলোনি যেমন : গোয়া, সেলন, কোচিন, মালাক্কা ও অন্যান্য জায়গার ফেরারি আসামিদের জন্যও এটি ছিল স্বর্গরাজ্য। যাই হোক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পর বিভিন্ন রেকর্ড, দলিল-দস্তাবেজ, মুদ্রা, ছবি ও কাগজপত্র থেকে এ জাতির ইতিহাস আরও গ্রহণযোগ্যতা ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। অত্র এলাকার প্রথম ব্রিটিশ জেলা প্রশাসক Captain T.H. Lewin রচিত ‘The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein’ এ লিপিবদ্ধ তথ্যাদি সে অর্থে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ১৬৬০ সালের শুরুর দিকে বার্মা ও আরাকান বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য চাকমারা নাফ নদীর অপর পাড়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে অবস্থিত রামু পুলিশ স্টেশনের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৬৫৭ সালে যখন ভারতবর্ষের সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন সিংহাসন দখলের জন্য তার চার পুত্র ভাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৫৮ সালে শাহজাহানপুত্র বাংলার সুবেদার শাহ সুজা তার বড় ভাই আওরঙ্গজেবের কাছে ভারতের উত্তর প্রদেশের ‘খাওজা যুদ্ধে’ পরাজিত হয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে আসেন। তখনো চট্টগ্রাম তৎকালীন আরাকান রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলা সুজাকে হত্যার জন্য পিছু নেন। সুজার সঙ্গে তার অনুসারী সেনাবাহিনীর ১৮ জন সেনাপতি এবং লক্ষাধিক সৈন্য আনোয়ারাতে অবস্থান নেয়। মীর জুমলা ঢাকা পৌঁছার পর সুজাকে আত্দসমর্পণের জন্য সংবাদ পাঠান। শাহ সুজা তার পরিবার ও অল্প কয়েকজন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আরাকানের মোরোহং-এ আশ্রয় গ্রহণ করাকেই বেশি নিরাপদ মনে করেন। মোগল বাহিনীর অন্য সহযোগীরা তখন রামুতে অবস্থান নিয়ে দিনাতিপাত শুরু করে। রমণী বিবর্জিত মোগল সৈন্য বাহিনীর সদস্যরা ধীরে ধীরে চাকমা রমণীদের সঙ্গে মিলেমিশে সংসার জীবন শুরু করে। তখন থেকে চাকমারা মোগল সেনাপতিদের রাজা হিসেবে গ্রহণ করে।

এদিকে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা সান্ডা থুডাম্মা, সুজার সুন্দরী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সুজা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন। এ নিয়ে আরাকান সীমান্তে পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি ঘটে। বিয়ে নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে বৌদ্ধ রাজা, সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। ফলে মোগল সৈন্য এবং আরাকান সৈন্যদের মধ্যে বহু খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মোগল সৈন্যরা তখন কৌশলগত কারণে রামু ছেড়ে আলীকদমের গহিন অরণ্যে আবাসস্থল গড়ে তোলে এবং চাকমারাও তাদের সঙ্গে এ এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে। মোগল সৈন্যরা হজরত আলীর (রা.) অনুসারী ছিল, তারই নামানুসারে এ জায়গার নাম রাখা হয় আলীকদম, যা এখনো প্রচলিত।

সুজার সামরিক প্রধান ফতেহ খান, সপরিবারে সুজা হত্যার দুঃসংবাদ নিয়ে আলীকদম থেকে দিলি্ল গমন করেন। এ খবর শুনে আওরঙ্গজেব ভীষণ ক্ষীপ্ত হন এবং সুবেদার শায়েস্তা খানকে আরাকান রাজ্য আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খানও আরাকান জয়ে তার সঙ্গী হন। মোগল গভর্নর শায়েস্তা খান বাংলায় আগমনের পর উপজাতি বিদ্রোহীদের পরাস্ত করার জন্য আত্দনিয়োগ করেন। তিনি আরাকান বাহিনীর হুমকি পর্যালোচনা করে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার ওপর মনোনিবেশ করেন। ধীরে ধীরে তিনি জাহাজের সংখ্যা বাড়িয়ে নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।

অন্যদিকে তিনি সৈন্য ও রশদ দিয়ে আরাকান বাহিনীকে সাহায্য প্রদানকারী ডাচ ও পর্তুগিজ বাহিনীর সমর্থন লাভের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। আরাকান এবং পর্তুগিজদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরলে শায়েস্তা খান বেশ লাভবান হন। ওই বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে শায়েস্তা খানের নেতৃত্বাধীন মোগলবাহিনী আরাকানের দখল থেকে প্রথমে সন্দ্বীপ মুক্ত করে। ১৬৬৫ সালের ডিসেম্বরে শায়েস্তা খান আরাকান বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামে সামরিক অভিযান শুরু করে। এ সময় তিনি সীমান্তে নিরাপত্তার জন্য রাঙামাটি শহরসহ পুরানঘর (রাঙামাটির প্রাণকেন্দ্র) এবং কাঠঘর (দোহাজারীর সন্নিকটে) এলাকায় সেনাছাউনি স্থাপন করেন। এ সেনা ছাউনির আশপাশে প্রচুর বাঙালি বসতি স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে, যাদের স্থানীয় উপজাতিরা আদিবাসী বাঙালি বলে জানে। তখন এ অঞ্চল ছিল হিংস্র জীবজন্তুর অভয়ারণ্য, যেখানে সুদূর চীনের পার্বত্য এলাকা থেকে কুকিরা আগমন করত। কুকিরা ছিল বন্যপ্রাণীদের মতোই ভবঘুরে প্রকৃতির এবং ফলমূল সংগ্রহ ও পশু শিকার করে জীবনধারণ করত। পরবর্তীতে আরাকান, মগ এবং পর্তুগিজ দস্যুরা চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে আস্তানা গেড়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় লুটতরাজ শুরু করে। শায়েস্তা খানের ঐকান্তিক চেষ্টায় এ দস্যুদের নিমর্ূল করা হয়। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর উমেদ খান চট্টগ্রামের নবাব হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সেই সময়ে আলীকদমে অবস্থিত মোগল সৈন্যরা উমেদ খানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে নিয়মিত তুলা কর প্রদান করত। যদিও ১৬৬৬ থেকে ১৭২৪ সাল পর্যন্ত মোগল সেনাপতিরা জমিদারি পরিচালনা করেছে কিন্তু এদের মধ্যে জালাল খান চট্টগ্রামের নওয়াবের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে কর দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাই চট্টগ্রামের নওয়াব দ্রুত জালাল খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ফলে জালাল খান আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মগদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে একপর্যায়ে মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধের ১৩ বছর পর ১৭৩৭ সালে জালাল খানের সহযোদ্ধা শের মস্ত খান চট্টগ্রামের নবাবের সঙ্গে দেখা করে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেন এবং পদুয়া কোদালা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তিনি সেখানে একটি খামারবাড়ি স্থাপন করলে অনেক মগ ও চাকমা জনগোষ্ঠী এসে বসবাস শুরু করে। সেই সময়ে বিশ্বস্ততা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে মোগলরা উপজাতীয়দের ‘দেওয়ান’ ‘তালুকদার’ ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করেন- যা তাদের বংশধররা এখনো ব্যবহার করে থাকে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক দিনের দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা ছিল। সেই লক্ষ্যে কোম্পানি চট্টগ্রামে দুই-দুইবার যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করে কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৭১০ সালে বাংলার নবাব অন্যান্য এলাকার মতো চট্টগ্রাম জেলাকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়। যদিও কোম্পানি দিলি্লর বাদশা শাহ আলমের কাছ থেকে ১৭৬৫ সালের পর রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। অতঃপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের জন্য দুজন রাজা নিয়োগ দেন। তারা হলেন চাকমা রাজা শের দৌলত খান এবং আরাকান বংশোদ্ভূত বোমাং রাজা পোয়াং। মগ এবং খুমি উপজাতিরা বোমাং রাজার অধীনে থাকে। এ রাজারা রাজস্ব আদায়ের জন্য নিজস্ব পদ্ধতি চালু করেন। যতই দিন যাচ্ছিল জনগণের ওপর কোম্পানির করের বোঝা ততই বেড়ে যাচ্ছিল, যা পরে জনগণের অসন্তোষের কারণ হয়। মোগল বাহিনীর চট্টগ্রাম জয়ের পর সীমান্তের ওপারে অস্থিতিশীলতা ও পুনঃপুনঃ সিংহাসন পরিবর্তনের কারণে আরাকানের শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোধপায়া আরাকান জয় করেন। ঠিক এ সময় অনেক মারমা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে। এদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন কক্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যার নামানুসারে কক্সবাজারের নামকরণ করা হয়। বোধপায়া কর্তৃক ঐতিহাসিক আরাকান রাজ্য দখলের পর পৃথিবীর মানচিত্র থেকে এই রাজ্যটি একেবারে হারিয়ে যায়। অতঃপর বার্মার সৈন্যরা ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে, যা ১৭৮৫ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। পরিণামে অনেক চাকমা আরাকান ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নেয়।

১৮৫৯ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত কুকি উপজাতি সম্প্রদায় বহিরাগতদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে বিপুল লোক হতাহত হয়। ১৮৬০ সালে প্রশাসনিক সুবিধাসহ সফলভাবে উপজাতি আন্দোলন দমনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে পৃথক করা হয়। ১৮৮১ সালের শেষের দিকে রাঙামাটি শহরের ১৬৫৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে চাকমা সার্কেল, বান্দরবানের ১৪৪৪ বর্গমাইল নিয়ে বোমাং সার্কেল এবং ৬৫৩ বর্গমাইল নিয়ে রামগড়ে মং সার্কেল গঠিত হয়। চাকমা সম্প্রদায়ের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মং সার্কেল গঠন করে বলে জানা যায়। উপজাতি জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য ১৯০০ সালের মে মাসে CHT Regulation 1 of 1900 কার্যকর করার মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার সার্কেল প্রধানদের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এই রেগুলেশনের ৩৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী যে কোনো ধরনের জমি বন্ধক, বিক্রি, পরিবর্তন এবং অধিগ্রহণ জেলা প্রশাসকের এখতিয়ারভুক্ত। যার অর্থ হচ্ছে জেলা প্রশাসকই হচ্ছে জমির প্রকৃত মালিক। ম্যানুয়েল অনুযায়ী সার্কেল প্রধান এর অধীনস্থ হেডম্যান এবং কারবারিরা মৌজা এবং পাড়ায় রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত, যা সংগ্রহের পর সার্কেলপ্রধান কর্তৃক জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তিন সার্কেল প্রধান এবং তাদের অধীনস্থ হেডম্যান এবং কারবারিরা হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিনিধি। ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক সার্কেল প্রধানদের ওপর কর্তৃত্ব করে থাকেন। আরও পরে, ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা অত্র উপ-মহাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে, তখন চাকমারা নিজেদের পাকিস্তানি মুসলমানদের চেয়ে ভারতীয় হিন্দুদের নৈকট্য প্রত্যাশা করে এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একটি স্বাতন্ত্র্য ভূমির স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সীমানা নির্ধারণী কমিশন চাকমাদের এই সুপ্ত বাসনার মূল্যায়ন করেনি। যাই হোক, ১৯৫৬ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী লেকের জমি অধিগ্রহণ করে। যার ফলে প্রায় ৫৪ হাজার একর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। এ ছাড়াও সংরক্ষিত বনাঞ্চল বিস্তারের জন্য পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল থেগামুখ, সুবলং এবং রাইংখিয়াং এলাকা থেকে ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে উল্লিখিত এলাকার অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে, যা এই এলাকার জনগোষ্ঠীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ওই সব এলাকার জনগণ এখনো বিশ্বাস করে যে, তাদের নিজস্ব ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক জটিলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান মার্চ-১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়সহ কতিপয় চাকমা এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করে। পরবর্তীতে রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করে আমৃত্যু পাকিস্তানে বসবাস করেন। তাই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে অনেক উপজাতি ভারতে পালিয়ে যায়। আর সে সুযোগে দেশে থেকে যাওয়া উপজাতিরা অত্র অঞ্চলের জমির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তরুণ প্রতিবাদী পাহাড়ি নেতা এম এন লারমা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে, যা জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে গৃহীত হয়নি। অতঃপর ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হলে, সাংবিধানিক উপায়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে। তাই ১৯৭৬ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ওই সময় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। তখন সরকার কিছু ভূমিহীন বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য এলাকায় বসবাসের সুযোগ করে দেয়। পুনর্বাসিত প্রতিটি বাঙালি পরিবারকে পাঁচ একর করে খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, যা উপজাতিরা আজো নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। যাই হোক, সশস্ত্র আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে বাঙালি পরিবারগুলোকে নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে এনে বসবাস করতে দেওয়া হয়। এই সুযোগে উপজাতি জনগণ বাঙালিদের ছেড়ে যাওয়া জায়গা-জমি দখল করে বসবাস শুরু করে। এভাবেই পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে।

“Hill District Council Act-1989” কার্যকর হওয়ার পর পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে ভূমি সংক্রান্ত যে কোনো ক্রয়, বিক্রয় পরিবর্তন বা অধিগ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ‘হিলট্রাক্টস ম্যানুয়েল-১৯০০’ কার্যকর থাকায় ভূমি সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করে। ২ ডিসেম্বর-১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে অত্র এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় এবং ভূমি সমস্যাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য সবাই নিজ জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে আগ্রহী হলে বিভিন্ন জায়গায় জাতিগত সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

ইতোমধ্যে সরকার শান্তিচুক্তির আওতায় বেশির ভাগ দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে লক্ষণীয় যে, শান্তিচুক্তির পর পৃথিবীর অনেক দেশেই যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ হয়নি। যেমন সুদান (১৯৭২), সোমালিয়া (১৯৯০), এঙ্গোলা ১ ও ২ ( ১৯৯১ ও ১৯৯৪) এবং রুয়ান্ডা (১৯৯৩)। এমনকি পার্বত্য চুক্তির বহু বছর আগে স্বাক্ষরিত অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তি বাস্তবায়নের দিক থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী সব ধরনের মামলা প্রত্যাহারসহ বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। সর্বমোট ১৯৮৯ জনকে আর্থিক অনুদান প্রদানসহ ৭০৫ জনকে পুলিশ বিভাগে চাকরি দেওয়া হয়েছে। ১২,২২২টি উপজাতি পরিবারকে ত্রিপুরা থেকে দেশে এনে পুনর্বাসিত করা হয়। ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমানে দীপঙ্কর তালুকদার এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সন্তু লারমার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলেও হাইকোর্টে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে একটি মামলা চলমান থাকায় পরিষদ কার্যত স্থবির। হাইকোর্টে পার্বত্য শান্তিচুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে মামলা হয়েছে এবং এ জন্য হাইকোর্ট সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা চেয়েছেন। অবশ্য হাইকোর্ট আঞ্চলিক পরিষদ এবং সার্কেল প্রধানদের কতিপয় ক্ষমতা অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সরকার হাইকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করলে আপীল বিভাগ হাইকোর্টে তা স্টে করেছেন। এই বিষয়টির স্থায়ী সুরাহা হলেই চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের নির্বাচনসহ সবার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যুর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৩২টি বিষয়ের মধ্যে ২২টি বিষয় পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় উপজাতি পুলিশদের বদলির বিষয়টি যখন প্রক্রিয়াধীন ছিল, ঠিক তখনই ঢাকায় কতিপয় উপজাতি পুলিশ সদস্যের গোলাবারুদ চুরির ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। যার ফলে বিষয়টি আর এগোয়নি। ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৯৯ সালে ভূমি কমিশন গঠন করা হয় এবং “CHT Land Dispute Settlement Act- 2001’ প্রণয়ন করা হয়। ইতোমধ্যে পার্বত্য এলাকা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ২৩৮টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় জেলা বিচারিক আদালত স্থাপিত হয়েছে। বেগম সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন এবং পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। সরকার ১৯৯৭-এর শান্তিচুক্তির মাধ্যমে উপজাতি সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণসহ সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

উপজাতি সম্প্রদায় বিশ্বাস করে জমি, বন এবং পাহাড় হচ্ছে যৌথ সম্পত্তি। তাই সরকারিভাবে প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি আর উপজাতিদের বংশানুক্রমিকভাবে প্রচলিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। চাকমারা মনে করে এ অঞ্চলের ভূমি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। তাদের আবাসভূমি ছাড়া বাকি সব জমির ওপর যৌথ মালিকানা বহাল। চাকমা সম্প্রদায় মনে করে, যে কেউ যে কোনো জমিতে আবাস করতে পারবে এবং এর জন্য কোনো চুক্তি বা কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। ভূমির মালিকানা এবং ব্যবহার সম্পর্কে বিভিন্ন উপজাতি বিভিন্ন ধারণা পোষণ করে থাকে। চাক উপজাতি মনে করে অন্য কেউ আগে ব্যবহার না করলে, যে কোনো জমি চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা যাবে। কিয়াং জনগোষ্ঠী মনে করে সন্তান ও জমি হচ্ছে প্রকৃতির দান এবং প্রত্যেকের জমির ওপর সমান অধিকার রয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির উন্মেষ ঘটলেও উপজাতি সম্প্রদায় এখনো জমির ব্যাপারে তাদের সনাতনী চিন্তাভাবনা আঁকড়ে ধরে আছে। এ ছাড়া CHT Regulation এর ৪২ ধারা অনুযায়ী জুম চাষের জন্য মালিকানার দরকার হয় না। ফলে উপজাতিরা নিবন্ধন ছাড়াই জমিতে বসবাস এবং চাষাবাদ করতে পারে এবং সার্কেল প্রধানকে খাজনা দিয়ে তারা নতুন জমির মালিকানা লাভ করে। বাস্তবতার নিরিখে উপজাতি সম্প্রদায়ের এই উপলব্ধি আধুনিক সময়োপযোগী মাত্রা পাবে এটাই কাম্য।

যেহেতু সাম্প্রতিককালে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ভূমি জরিপ হয়নি, তাই এ অঞ্চলের মোট ভূমির পরিমাণ নিরূপণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, পার্বত্য এলাকার মোট জমির পরিমাণ ৫০৯৩ বর্গমাইল, যার মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ৭৭৫.৬৩ বর্গমাইল, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ১৪২৩ বর্গমাইল এবং অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বন ২৮৯৪.৩৭ বর্গমাইল। উল্লেখ্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ কেন্দ্র, কর্ণফুলী পেপার মিল এবং সরকারি অধিভুক্ত জমি শান্তিচুক্তির আওতাধীন নয়। তিন জেলার ব্যক্তি মালিকানাধীন সর্বমোট জমির পরিমাণ হচ্ছে ১৪২৩ বর্গমাইল। বাকি ৩৬৭০ বর্গমাইল এলাকা সরকার নিয়ন্ত্রিত সম্পত্তি। শান্তিচুক্তির ৬৪ ধারা অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদকে ভূমি লিজ, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা মহামান্য হাইকোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কার্যবিধি চূড়ান্তকরণে বিলম্ব এবং চেয়ারম্যানের অনাগ্রহের কারণে এই অঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে একসঙ্গে জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং সার্কেলপ্রধান নিয়ন্ত্রিত প্রচলিত পদ্ধতি দ্বারা ভূমি ব্যবস্থাপনা চলছে। জেলা প্রশাসক সার্কেলপ্রধানের পরামর্শক্রমে হেডম্যান নিয়োগ দেন। সার্কেলপ্রধানের অধীনে থেকে হেডম্যান তার মৌজার ভূমি এবং জুমচাষ থেকে রাজস্ব আদায় করে। ভূমি প্রশাসন বিশেষত ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময়সাপেক্ষে ব্যাপার, যার ফলে দেখা যায় সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে অনেকে মৃত্যুবরণ করে বা ক্ষেত্রবিশেষে আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ফলে অনেকেই অবৈধভাবে ক্রয়, বিক্রয়সহ অননুমোদিতভাবে ভূমির মালিক হয়ে থাকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ও প্রতারক নিজ নামে ভূমি নিবন্ধন করে নিরীহ জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত দাঙ্গার জন্ম দিচ্ছে। অবৈধভাবে জমি দখল না করলে জমির মালিক হওয়া কঠিন- এমন বাস্তবতা পার্বত্যাঞ্চলে বিতর্ক এবং সংঘর্ষের জন্ম দিচ্ছে। এ ধরনের জটিল প্রক্রিয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জটিলতা দীর্ঘসূত্রতা লাভ করছে।

অত্র অঞ্চলে টেকসই শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে ভূমি সমস্যা সমাধান অতীব জরুরি। ভূমি কমিশনকে অবৈধভাবে দখলকৃত জমি এবং পাহাড়ের মালিকানা বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বাস্তবিক সমস্যার কারণে কমিশন আশানুরূপভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। ২৭ জানুয়ারি ২০১০ সালে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত প্রথম ভূমি কমিশনের সভায় ভূমি সমস্যা সমাধানের আগে ভূমি জরিপের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু কমিশনের উপজাতীয় সদস্যরা সর্ব প্রথমে “CHT Land Dispute Settlement Commission Act-2001” সংশোধনের দাবি জানান। সে মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ১৯টি ধারা সংশোধনের দাবি করেন। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রথমে ২৩টি ধারা সংশোধন করার কথা বললেও পরে ১৩টি ধারা সংশোধনের দাবি জানান। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন এবং পর্যালোচনা কমিটি ২২ জানুয়ারি ২০১২ তারিখ ১২টি সংশোধনী করার পরামর্শ প্রদান করে। ২৮ মার্চ ২০১২ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় উল্লিখিত আইন সংশোধনের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আহ্বান করে। ভূমি মন্ত্রণালয় ছয়টি সংশোধনের জন্য সর্বসম্মতভাবে একমত হয় এবং বাকি সাতটি সংবিধানের পরিপন্থী বলে অনুমোদন পায়নি।

এ সংশোধনসমূহের কিছু পদ্ধতিগতভাবে বেশ জটিল, কিছু অত্র অঞ্চলে অবস্থিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ, কিছু সংশোধন কমিশনের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথে অন্তরায় ও কয়েকটি নীতিগতভাবে কার্যপ্রণালীর পরিপন্থী। এটা ধরে নেওয়া যায় যে, শান্তিচুক্তির আগে উভয়পক্ষই স্ব-স্ব অবস্থানে অনড় না থেকে পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটি সর্বজনীন কর্মপন্থা নির্ধারণের ব্যাপারে একমত হয়েছে। আনীত সংশোধনীসমূহ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা সংগত ও শান্তিচুক্তির মূল্যবোধের সঙ্গে কতটা যুৎসই তা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

দীর্ঘ সময় ধরে কমিশনের স্থবিরতার জন্য মূলত কমিশনের উপজাতীয় সদস্যবর্গের কমিশনকে তার কাজকর্মে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের ব্যাপারে অনাগ্রহই দায়ী। এ ছাড়া কিছু গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের উপস্থাপনায় বস্তুনিষ্ঠতার অভাব মৌলিক বিষয়গুলোকে আড়াল করে রেখেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে শান্তিচুক্তির পর থেকে এপ্রিল ২০১২ পর্যন্ত সর্বমোট ৫১৭ জন নিহত, ৮৭৭ জন আহত আর ৯৫৯ জন অপহৃত হয়েছেন। অথচ আঞ্চলিক নেতারা বিরাজমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন ব্যতিরেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সব সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন। এমনকি সিএইচটি কমিশন, United Nations Permanent Forum For Indigenous Issues (UNPFII), ইউরোপীয় ইউনিয়ন উপজাতিদের প্রতি অযৌক্তিকভাবে সমর্থন ব্যক্ত করে বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলছে। বিভিন্ন বিদেশি ব্যক্তিবর্গ ও সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে উপজাতি ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা পার্বত্য অঞ্চলকে একটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরির বুনিয়াদ সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান Lord Eric Ava bury একজন অভিজ্ঞ ব্রিটিশ সংসদ সদস্য। বৈশ্বিক নানা বিষয়ে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে; যেমন জনগণের অধিকার আদায়ে ইতিপূর্বে তিনি পেরু, ক্যামেরুন এবং ইরানে কাজ করেছেন। তিনি সুদান এবং পূর্ব তিমুরে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বেশ পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক উপজাতিদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার তথ্য রয়েছে, যা অত্র এলাকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। কমিশনের অপর সদস্য সুইডেন নাগরিক Mr. Lars Anders Bear বিভিন্ন দেশের আদিবাসী ইস্যু নিয়ে কাজ করেন। তিনি UNFPII-এ স্পেশাল রেপোর্টিয়ার হিসেবে নিয়োজিত। UNFPII এর দশম অধিবেশনে Mr. Lars Anders Bear কর্তৃক উপস্থাপিত ‘Status of the  implementation of CHT Peace Accord of 1997’ যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক কমিশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন এবং তার সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত UNFPII এর স্বার্থে ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসামান্য অবদানের পরও তিনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায় যে, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তিবর্গ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ইস্যুটি বহির্বিশ্বে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে ব্যবহার করছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আদিবাসী জনগণের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ ১৯৫৭ সালে আইএলও ১০৭ প্রণয়ন করে। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এবং কোনো দেশের সার্বভৌমত্বকে খাটো করেনি, তাই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আইএলও ১০৭ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে প্রণীত উপজাতিদের নিরাপত্তাবিষয়ক আইএলও ১৬৯ সনদ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২২টি দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করলেও এশিয়ার নেপাল ছাড়া বাকি কোনো দেশ স্বাক্ষর করেনি। আইএলও ১৬৯ এর সনদ অনুযায়ী ঐতিহ্যগত, ব্যক্তিগত এবং সাম্প্রদায়িক মালিকানা ছাড়াও, রাষ্ট্র ভূমি রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে। আশ্চর্যজনকভাবে এই সনদে সরকারি খাসজমির ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই। অথচ এই খাসজমিতে বাঙালিদের অভিবাসনের মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের ভূমি সমস্যার জটিলতা বৃদ্ধিসহ নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সনদ মোতাবেক স্থানীয় আধিবাসীদের অনুমতিক্রমে সামরিক অভিযানসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যেন বহিরাগত কেউ জমির মালিক হতে না পারে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ ইস্যুটি আজ আর কোনো আলাদা বিষয় নয়। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ছাড়াও উপজাতি সম্প্রদায়গুলো ‘আদিবাসী’ শব্দটি ভূমি অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে ব্যবহার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মরহুম বোমাং সার্কেলপ্রধান অং সাং প্রু পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো আদিবাসীর অস্তিত্ব নেই। ২০০৮ সালে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় যখন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন তিনিও এমন দাবির সপক্ষে অবস্থান নেননি। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার নেই। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪১ এবং ৩৪২ নম্বর ধারা অনুযায়ী ভারতে scheduled cast I scheduled cast tribes রয়েছে। ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর শতকরা ২৪ ভাগ লোক বিভিন্ন গোত্রের হলেও তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে একসঙ্গে বসবাস করছেন। মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত ভূমিবিরোধ সংশোধন আইন এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হবে, তবে এতদসঙ্গে বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি বিবেচনা ব্যতিরেকে এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কতটা সহায়ক হবে তা সময়ই বলে দেবে। অন্তত পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন বাঙালি সংগঠনের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া থেকে এমনটিই লক্ষণীয়।

স্বাধীনতার ৪২ বছর পর জাতি সফলভাবে সামাজিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতিদিনই জমি এবং সম্পদ সংকুচিত হয়ে আসছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তাই পার্বত্যাঞ্চলে বিরাজমান পরিস্থিতির সমাধানে কালক্ষেপণ বৈশ্বিক বাস্তবতায় কাম্য নয়। উপজাতি বিষয়ে আমাদের সুষমভাবে তাদের অধিকার এবং উত্তরাধিকার নিশ্চিতকরণসহ বাঙালিদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা জরুরি। সরকার পুনর্বাসিত বাঙালিদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্বটি সরকারকেই পালন করতে হবে। পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যার মোটামুটি অর্ধেক বাঙালি। সময়ের পরিক্রমায় পার্বত্য এলাকায় বাঙালিদের আগমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যার সুষ্ঠু সমাধান- বাঙালিদের ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্যে নয়, বরং উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ নিশ্চিতকরণসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এখনই সময় যেন সরকার গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং সর্বস্তরের মানুষকে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করে চুক্তি বাস্তবায়নের বাকি কাজ সম্পন্নের জন্য এগিয়ে যায়। অত্র অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে এখানকার অধিবাসীদের দেশের মূল স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত করা জরুরি। জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রেখে সরকারের পাশাপাশি উপজাতীয় নেতাদের এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে এই অঞ্চলের শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একযোগে কাজ করতে পারলেই দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ সুগম হবে।

লেখক : কমান্ডার, ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড(ব্রিগেড কমান্ডার, রাঙামাটি) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশে আদিবাসী বিষয়ে আরো পড়ুন:

পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে

একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী

বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক

আদিবাসী বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ২

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ৩

চাকমা রাজপরিবারের গোপন ইতিহাস

পার্বত্য চট্টগ্রাম, খ্রিস্টান মিশনারি ও বৌদ্ধধর্মের ভবিষ্যৎ-১

পার্বত্য চট্টগ্রাম, খ্রিস্টান মিশনারি ও বৌদ্ধধর্মের ভবিষ্যৎ-২

পার্বত্য চট্টগ্রাম, খ্রিস্টান মিশনারি ও বৌদ্ধধর্মের ভবিষ্যৎ-৩

বাংলাদেশে তথাকথিত ‘আদিবাসী’ প্রচারণা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রশ্নসাপেক্ষ

উপজাতীয় নওমুসলিমদের ওপর খ্রিস্টান মিশনারিদের দৌরাত্ম্য

পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা-বাঙ্গালী প্রত্যাহার ও খ্রিস্টান অঞ্চল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন

 

Exit mobile version