পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্র: বাংলাদেশকে বিভক্ত করার চেষ্টা চলছে

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগণ আদিবাসী না উপজাতি—এটি বর্তমানে একটি বহুল চর্চিত বিষয় এবং ষড়যন্ত্রের অংশ। আধিপত্যবাদী শক্তি দেশের কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে ব্যবহার করে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজনের মাধ্যমে পাহাড়িদের আদিবাসী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করলে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ কারণে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের মধ্যে প্রথমে উত্তেজনা এবং পরে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরিস্থিতির অবনতি হলে সেনাবাহিনীকে নামানো হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম এমনিতেই একটি স্পর্শকাতর এলাকা। তাই এ অঞ্চলে অশান্তি সৃষ্টি হলে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

স্বাধীনতার পর, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে পৃথক করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এ ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে বিপথগামী পাহাড়িদের অস্ত্র ও বিস্ফোরকের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র দলের নাম ছিল ‘শান্তিবাহিনী’।

শান্তিবাহিনী পাহাড়ি নেতা মানবেন্দ্র লারমার প্রতিষ্ঠিত জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র ফ্রন্ট। যা দুই দশক ধরে পাহাড়ে রক্তপাত ঘটিয়েছে। ভারতের সরাসরি সহযোগিতায় শান্তিবাহিনীর তৎপরতা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ভারত দীর্ঘ দুই দশক ধরে জেএসএসের সঙ্গে যোগাযোগ করে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অযোগ্য করেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জেএসএসের সঙ্গে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হয়।

হাসিনা সরকারের পতনের আগে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ভারতীয় সুরে বলেন, বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী অস্ত্রধারী সদস্যরা সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। অথচ তারা ভারত যে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করার কাজে শান্তিবাহিনীকে ব্যবহার করেছে, সে বিষয়ে কোনো মুখ খোলেননি। যারা ভারতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র দল সক্রিয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সশস্ত্র দলের অস্ত্রের জোগান কোথা থেকে আসে?

পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসরত জনগণের আদিবাসী না উপজাতি—এটি এখন এক বিতর্কিত বিষয়। আধিপত্যবাদী শক্তি এদেশের কিছু বুদ্ধিজীবীকে ব্যবহার করে পাহাড়িদের আদিবাসী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। বিশ্বজুড়ে আদিবাসী পরিচয় নিয়ে আলোচনা চলছে। যা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী জনগণ নেই।

২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে জাতিসংঘের একটি ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এতে আদিবাসী জনগণের জন্য বিভিন্ন অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ভূমির অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার এবং জাতীয়তা লাভের অধিকার উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বিশেষ করে পাহাড়ি জনগণ এ ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি তুলে আসছে। কিন্তু এ দাবি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা সঠিক নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের তিনটি প্রধান সমাজে বিভক্ত করা যায়: বাঙালি, মঙ্গোলীয় এবং উপজাতি। উপজাতি জনগণের মধ্যে চাকমা জনগোষ্ঠী শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে উন্নত। ইতিহাস অনুযায়ী, ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বার্মার উত্তর আরাকানের চিন পার্বত্যাঞ্চলে সংঘর্ষের কারণে চাকমা জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে ১৯০০ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অ্যাক্ট’ জারি হলে তারা নিজেদের উপজাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

বর্তমানে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পর ভারতীয় গণমাধ্যম ও সংগঠনগুলো সক্রিয় হতে দেখা যায়। আনন্দবাজার পত্রিকা ২১ সেপ্টেম্বর, “বাংলাদেশে গণহত্যা থেকে চাকমাদের রক্ষা করুন—মোদিকে বার্তা উত্তর-পূর্বের জনজাতিদের” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রচার করে। এ সংবাদে চাকমাদের উদ্ধৃত করে বলা হয়, হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের “আদিবাসী” পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।

ভারতের ত্রিপুরার চাকমা নেতারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ দাবি করেছেন। তারা উল্লেখ করেন, ১৯৪৭ সালে স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফ পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেন। যদিও সেখানে ৯৮.৫ শতাংশ বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায় রয়েছে। বিজেপি নেতা প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মণ সম্প্রতি ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের জনগণ যদি মনে করে তারা আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে, তাহলে পাকিস্তানকে ভাগ করে ভারত বাংলাদেশ তৈরি করেছে এবং এখন আবার বাংলাদেশকে ভাগ করে নতুন দেশ তৈরির ক্ষমতা ভারতের রয়েছে।

এসব ঘটনায় বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেশী দেশের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা হালকা করে দেখার বিষয় নয়। অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাংলাদেশকে আরও সতর্ক হতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোকে পার্বত্য অঞ্চলে জনসংযোগ বাড়াতে হবে, যাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি না ঘটে। সরকারকে সঠিক তথ্য তুলে ধরে প্রকৃত বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায় করতে হবে। দেশের জনগণ যদি সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে বাংলাদেশ বিভাজনে কারও নীলনকশা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন