“পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈষম্যের আগাগোড়া”

fec-image

দেশে পার্বত্য জেলা পরিষদ তথা খাগড়াছড়ি/রাঙ্গামাটি/বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে না প্রায় ৩৫ বছর। জেলা পরিষদ আইনে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী আলাদা ভোটার তালিকায় নির্বাচন করার বিধান থাকায় জেলা পরিষদে নির্বাচন করা যাচ্ছে না। এ অজুহাতে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদটি উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং সদস্যদের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার অনুপাতে বাঙ্গালীদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি।

তাই, পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ সকল সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে জেলার জনসংখ্যা অনুপাতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণের লক্ষ্যে আইন সংশোধন দরকার।
অথবা প্রচলিত ভোটার তালিকায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার। এতে করে কেউ আর কথা বলার সুযোগ পাবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যে-কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে, জনগণের ভোটে যিনি বিজয়ী হবেন তিনিই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

অন্যথা যে সরকার দেশ পরিচালনায় আসবে, তিনি তাঁর অনুসারিদের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পুরো জেলা নিয়ন্ত্রণ করবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে, শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান, –
পদে আইনের আলোকে উপজাতীয়দের মধ্য হতে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। ওই সকল প্রতিষ্ঠানে বাঙ্গালীসহ সংখ্যাগরিষ্ট উপজাতীয়দের মধ্য হতে মনোনয়ন দেয়া প্রয়োজন। তাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদ, টাস্কফোর্স এর চেয়ারম্যান পদে বাঙ্গালীসহ সংখ্যাগরিষ্ট উপজাতীয়দের মধ্য হতে মনোনয়ন দেয়ার লক্ষ্যে আইন সংশোধন দরকার।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে উপজাতীয় প্রতিনিধিদের (১। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা তাহাঁর প্রতিনিধি ২। সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ৩। সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ) ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার বা তাঁর মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নিয়ে গঠিত।

এখানে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙ্গালীদের কোন প্রতিনিধি নেই। তাই, এ কমিশনে বাঙ্গালীদের ভূমির ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য তিন পার্বত্য জেলা হতে অন্ততঃ তিনজন বাঙ্গালী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার বিধান প্রণয়ন প্রয়োজন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী ও উপজাতী জনসংখ্যার অনুপাত দেখা যাক। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী-

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীর অনুপাত ৫১% যেখানে খাগড়াছড়িতে ৫১.০৮%, রাংগামাটিতে ৪২.৪২% ও বান্দরবানে ৫৮.৮৫% অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীদের অনুপাত ৪৯% যেখানে খাগড়াছড়িতে ৪৮.৯২%, রাংগামাটিতে ৫৭.৫৮% ও বান্দরবানে ৪১.১৫% বাঙ্গালী ও উপজাতির জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান হলেও জেলা পরিষদের অধীনস্থ সকল বিভাগে ও অন্যান্য প্রায় সকল নিয়োগে বাঙ্গালীদের মাত্র ৩০% নিয়োগ করা হচ্ছে, বিপরীতে ৭০% নিয়োগ করা হচ্ছে উপজাতীদের মধ্য থেকে।

উপজাতি ৭০% এর বিভাজন কোন অনুপাতে হয় তা জানেন?

চাকমা ৩০%, মারমা ২০%, ত্রিপুরা ২০%। এখানেও কি বৈষম্য নেই?

আপনি জেনে অবাক হবেন, বিএনপির সময়কাল থেকে শুরু করে অর্থাৎ ২০০২ থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বাঙ্গালীদের ৪৮% এবং উপজাতিদের ৫২% অনুপাতে নিয়োগ দেওয়া হতো যেটা আওয়ামী সরকার এসে বন্ধ করে দেয়। তাই, সকল প্রকার নিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধায় জনসংখ্যা অনুপাতে প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রয়োজন।

আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, জেলায় নিয়োগ আর কয়টি হয়? বা জেলা পরিষদের অধীনে কতগুলো ডিপার্টমেন্ট রয়েছে? যেটা হয়তো জেলার অনেকেরই অজানা।

জেলা পরিষদের অধীনস্থ বিভাগগুলোর তালিকা –

১. স্বাস্থ্য বিভাগ
২. যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর
৩. প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ
৪. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
৫. পর্যটন কর্পোরেশন
৬. মৎস্য অধিদপ্তর
৭. পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
৮. সমাজ সেবা অধিদপ্তর
৯. প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর
১০. তুলা উন্নয়ন বোর্ড
১১. সমবায় অধিদপ্তর
১২. বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন
১৩. জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
১৪. বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন
১৫. হর্টিকালচার বিভাগ
১৬. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, খাগড়াছড়ি
১৭. বাজারফান্ড প্রশাসন
১৮. শিল্পকলা একাডেমী
১৯. স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
২০. সরকারী শিশু সদন
২১. জেলা ক্রীড়া অফিস
২২. মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর
২৩. রামগড় মৎস্য হ্যাচারী
২৪. জেলা গণগ্রন্থাগার

আপনি কি জানেন?

পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী/ঠিকাদারদের মধ্যে উপজাতীয়দের কোন আয়কর দিতে হয়না।

এক্ষেত্রে একটি দারুণ বৈষম্য লক্ষণীয় যেখানে সরকার বড় অংকের রাজস্ব হারিয়ে ফেলছে। সুতরাং উপজাতীয়দের আয়করের আওতায় আনা দরকার অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের জন্য একই সুবিধা প্রদানের বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। নয়তো বাঙ্গালী জাতি বরাবরের মতই পিছিয়ে পড়ছে, পাশাপাশি একটি বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে এখানকার মানুষের মধ্যে একটি কঠিন সমস্যাকে সাদরে লালন-পালন করা হচ্ছে।

সহজ উদাহরণে বুঝিয়ে দিই-

যারা সুপার ট্যাক্স দেয়, তাঁদের থেকে ৭% পর্যন্ত আয়কর কেটে রাখা হয়। অর্থাৎ আপনি যদি ১ কোটি টাকার কাজ করেন তা থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত সরকারকে দিয়ে দিতে হবে। যেটা আমার উপজাতি ভাইদের দিতে হয় না। এবং এই একমাত্র ট্যাক্স এর কারণে এখানকার বাঙ্গালীরা অনেকগুণ পিছিয়ে পড়ছে। এবং একটা দারুণ বৈষম্য এখানে পরিলক্ষিত।

আপনি জানেন কি? পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া এখানে অর্থাৎ ৩ পার্বত্য জেলায় অন্য জেলার কোন ব্যক্তি জায়গা-জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে না। যেখানে উপজাতিরা সমগ্র বাংলাদেশে জমি ক্রয় থেকে শুরু করে চাকরি-ব্যবসা করতে পারে। স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র নিতে উপজাতীয় হেডম্যান, উপজাতীয় ইউপি/পৌর চেয়ারম্যান এবং উপজাতীয় সার্কেল চীফ (রাজা) গণ বাঙ্গালীদের সনদ না দিলে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া যায়না। এ বৈষম্য ঠেকাতে পার্বত্য চট্টগ্রামেও সমতলের ন্যায় এনআইডির মাধ্যমে জায়গা ক্রয়/বিক্রয় করার ব্যবস্থার সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

জেলায় আগে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম ছিলো এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা যাওয়ার মাঝপথে। এখন সেসব ছাড়িয়ে বর্তমানে বাজারের অফিস, দোকানদার তথা ব্যবসায়ীরাও এ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের উচিৎ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অপরিহার্যতা না বললেই নয়। এখানকার বিচ্ছিন্নবাদী অবৈধ সশস্ত্র সংগঠনের সংঘাত, অপহরণ, চাঁদাবাজী এসব বন্ধ করতে এবং উক্ত সংগঠনসমূহের সদস্যদের আলোর পথ দেখাতে সেনাবাহিনীর বিকল্প কিছু নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে আপামর জনসাধারণের মাথার উপরের ছায়া হিসেবে যুগ যুগ ধরে কাজ করে আসছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আবহমানকাল থেকে আমাদের বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালী ও উপজাতি ভাইবোনদের সহাবস্থান ও ভাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখতে সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করতে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হওয়া উচিৎ আমাদের সকলের।

ব্রিটিশ শাসকরা “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতির মাধ্যমে এ দেশে বৈষম্য তৈরি করে যেটা সম্মিলিতভাবে পরবর্তীতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এসব বৈষম্য দূরীভূত হয়, এবং দেশে সৃষ্টি হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির।

সম্প্রতি আমরা আমাদের খাগড়াছড়ি জেলার কমলছড়ি গ্রামের সন্তানকে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে পেলাম যেটা আমাদের জেলাবাসির জন্যে অনেক বড় প্রাপ্তি বলা চলে। বলছি দুটি দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জনাব সুপ্রদীপ চাকমা স্যারের কথা। স্যার দীর্ঘ সময় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন শেষে অর্জিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবার আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মানুষগুলোর প্রতি কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ডে দায়িত্ব পালনকালে অনেক বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন অতটা নেই, এখন অনেক কিছুই চাইলেই সম্ভব। তাই স্যারের প্রতি অনুরোধ থাকবে, উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সদয় বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

পরিশেষে বলি, আমি কোনোভাবেই উপজাতী ভাই-বোনদের নিয়ে কিছু লিখছি না। আমার জীবদ্দশায় আমি অসংখ্য উপজাতি ভাই-বোনের ভালোবাসা পেয়েছি, আমার অসংখ্য উপজাতি ভালো বন্ধু রয়েছে, অসংখ্য সিনিয়র-জুনিয়র আছে যাদের সাথে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, আমি আমার সামাজিক কার্যক্রমে অসংখ্য উপজাতি ভাইদের পাশে দাঁড়িয়েছি, নিজের রক্ত দিয়েছি, ব্যবস্থা করে দিয়েছি, বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি।

আমি শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈষম্য ও বাঙ্গালীদের অধিকার রক্ষার কথা লিখেছি। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কেউই খুব একটা লিখে না, অনেকে হয়তো জানেও না। বিষয়গুলো সবার জানা জরুরী, তাই ভাবলাম নিজের পরিধি থেকে যতটুকু পারা যায় জানানোর চেষ্টা করি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী দেশের যত বৈষম্য তা যেন আরও বহু গুণে আলোকিত হয়ে সকলের সম্মুখে ধরা দিচ্ছে। তাই সকলের সাথে আমিও বলতে চাই, এ স্বাধীন বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই। একইসাথে আরও বলি, এক দেশে দুই নীতি থাকতে পারে না।

আমরা পাহাড়বাসী সকলে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যেতে চাই। কাউকে পেছনে ফেলে রেখে কেউ এগিয়ে যাবে এ ধরণের বৈষম্য যেন পাহাড়ে না থাকে সে উদ্দেশ্যেই এ লিখা।
২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যা সর্বমোট ১৮,৪২,৮১৫ জন।

এরমধ্যে বাঙ্গালী জনসংখ্যা ৯,২২,৫৯৮ জন যেখানে খাগড়াছড়িতে ৩,৬৪,৭৪১ জন, রাঙ্গামাটিতে ২,৭৪,৭২৩ জন, বান্দরবানে ২,৮৩,১৩৪ জন।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতির সংখ্যা ৯,২০,২১৭ জন যেখানে খাগড়াছড়িতে ৩,৪৯,৩৭৮ জন, রাঙ্গামাটিতে ৩,৭২,৮৬৪ জন, বান্দরবানে ১,৯৭,৯৭৫ জন।

এ লিখাটি ১৮,৪২,৮১৫ জনের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণের লিখা। তাই এ বিষয়গুলো তথা নিজেদের অধিকারগুলো সবার জানা জরুরী। এতলক্ষ মানুষের নিকট পৌঁছাতে না পারলেও হাজার হাজার মানুষের নিকট পৌঁছানো সম্ভব।

বিভিন্ন ক্যাটাগরির উপর ভিত্তি করে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ বা পৃথকীকরণকে আমরা ‘বৈষম্য’ বলতে পারি। সম্প্রতি আমরা সকলেই দেখেছি এ বৈষম্য দূর করতে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর মাধ্যমে সমগ্র দেশের নাগরিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। একইভাবে আমরাও চাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বৈষম্য দূর হোক যাতে করে এখানে বসবাসরত প্রায় ১৮,৪২,৮১৫ জন (বর্তমানে আরও বেশি) মানুষ সকলে সম্মিলিতভাবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, তিন পার্বত্য জেলা অর্থাৎ খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান এর আয়তন দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-দশমাংশ অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ এবং আয়তন অনুযায়ী বাংলাদেশের বৃহত্তম জেলা রাঙ্গামাটি।

গতপর্বে আমরা জেনেছি পার্বত্য চট্টগ্রামের- পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, উপজাতীয় শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বিষয়ক টাস্কফোর্স, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, খাগড়াছড়ি সার্কেল চিফ (মং সার্কেল), রাঙ্গামাটি সার্কেল চিফ (চাকমা সার্কেল), বান্দরবান সার্কেল চিফ (বোমাং সার্কেল), পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বিষয়ক সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য।

সার্কেল চীফ:

পার্বত্য তিন জেলার মূল ধারার যেকোনো অফিসে সদস্য পদ প্রাপ্তির জন্যে আপনাকে শুরুতে বাঙ্গালী না-কি উপজাতি তা নির্ধারণ করতে হবে। আর তা নির্ধারণ করার জন্যে একটি সার্টিফিকেট প্রয়োজন হবে যেটি প্রদান করতে পারেন শুধুমাত্র তিন পার্বত্য জেলার সার্কেল চীফ।

উদাহরণ: পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৪ নং ধারার উপধারা ৫-এ স্পষ্ট উল্লেখ আছে, “কোন ব্যক্তি উপজাতীয় কি না এবং হইলে তিনি কোন উপজাতির সদস্য তাহা জেলার সার্কেল চীফ স্থির করিবেন এবং এতদসম্পর্কে সার্কেল চীফের নিকট হইতে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট ব্যতীত কোন ব্যক্তি উপজাতীয় হিসাবে চেয়ারম্যান বা কোন উপজাতীয় সদস্য পদের জন্য প্রার্থী হইতে পারিবেন না৷

একই ধারার ৬ নং উপধারায় লিখা আছে- “কোন ব্যক্তি অ-উপজাতীয় কিনা এবং হইলে তিনি কোন সম্প্রদায়ের সদস্য তাহা সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা, ক্ষেত্রমত, পৌরসভার চেয়ারম্যান কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে প্রদত্ত সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে সার্কেল চীফ স্থির করিবেন এবং এতদসম্পর্কে সার্কেল চীফের নিকট হইতে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট ব্যতীত কোন ব্যক্তি কোন অ-উপজাতীয় সদস্য পদের জন্য প্রার্থী হইতে পারিবেন না৷

এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, ‘সার্কেল চীফ’ প্রদত্ত সার্টিফিকেট ব্যতীত আপনি উল্লিখিত কোনো অফিসের সদস্যপদ গ্রহণ করিতে পারিবেন না। প্রসঙ্গত আইন অনুযায়ী খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান তথা পার্বত্য যেকোনো জেলার ‘সার্কেল চীফ’ শুধুমাত্র উপজাতিগণ হতে পারবে, বাঙ্গালীদের ‘সার্কেল চীফ’ হওয়ার সুযোগ নেই।
জেলা পরিষদে বৈষম্য:

সার্কেল চীফ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে হবেন জেলা পরিষদের সদস্য। আসুন জেলা পরিষদের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করি। জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ হওয়ার কথা নির্বাচনের মাধ্যমে যেখানে ১ জন চেয়ারম্যান, ২১ জন উপজাতী সদস্য, ৯ জন বাঙ্গালী সদস্য, ২ জন উপজাতী মহিলা সদস্য এবং ১ জন বাঙ্গালী মহিলা সদস্য থাকার কথা। এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে পদ সংখ্যা ৭০.৫% বরাদ্দ থাকে উপজাতিদের জন্যে, বাকি ২৯.৫% বরাদ্দ থাকে বাঙ্গালীদের জন্যে। অথচ পরিষদ গঠনের পর থেকে অর্থাৎ বিগত ৩৫ বছরেও এই পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে না পারায় জেলা পরিষদ আইনের ১৬(ক) ধারা সংযোজন করে অন্তর্বর্তীকালীন জেলা পরিষদ গঠনের পদ্ধতি শুরু করা হয়। ইতোপূর্বে তা উল্লেখ করা হয়েছে। জেলা পরিষদ নির্বাচন সংবিধান বিরোধী স্থায়ী বাসিন্দাদের আলাদা ভোটার তালিকা প্রণয়নের বিধান করা হয়েছিল। আইনের সংজ্ঞায় স্থায়ী বাসিন্দা সম্পর্কে বলা হয়েছে, “অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা” অর্থ যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যাহার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা-জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলায় সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণতঃ বসবাস করেন। অন্যদিকে উপজাতি হিসেবে আইনে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা-কে বুঝাবে বলা হলেও অন্যান্য (যেমনঃ সাঁওতাল) উপজাতীয়কে কোথাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

বর্তমান এই অন্তর্বর্তীকালীন জেলা পরিষদ চলছে সরকার কর্তৃক পছন্দসই মানুষের দ্বারা। যখন যে সরকার আসে তখন সে সরকার নিজেদের লোকেদের বসিয়ে দেন পরিষদের সদস্য হিসেবে, করেন নিজেদের স্বার্থ হাসিল। এই পরিষদের বর্তমান কাঠামোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, পার্বত্য ৩ জেলার প্রত্যেক জেলার জেলা পরিষদে ১৫ জন করে সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে-

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে উপজাতি সদস্য ১১ জন, বাঙ্গালী ৪ জন। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে উপজাতি সদস্য ১০ জন, বাঙ্গালী ৫ জন। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে উপজাতি সদস্য ১১ জন, বাঙ্গালী ৪ জন।

অর্থাৎ খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ৭৩.৩% উপজাতি এগিয়ে গেলে বাঙ্গালী এগুবে ২৬.৭%, রাঙ্গামাটিতে উপজাতি ৬৬.৭% এগিয়ে গেলে বাঙ্গালী এগুবে ৩৩.৩%
প্রচলিত ভোটার তালিকা অনুযায়ী নির্বাচন না হয়ে সরকার কর্তৃক সিলেক্টিভ পদ্ধতিতে নির্বাচনে সাধারণ জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করা হয় যেটা একটি অগণতান্ত্রীক চর্চা বলে ধরে নেওয়া যায়। যার ফলশ্রুতিতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে সদ্য বাতিল হওয়া কমিটিতে বাঙ্গালী ৪ জন সদস্যের মধ্যে ৩ জনই মানিকছড়ি উপজেলার।
যাহোক, চলুন উদাহরণ হিসেবে দৃষ্টি দেওয়া যাক খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রণাধীন খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের চিত্র- হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৬৩ জন নার্স কর্মরত রয়েছে। এই ৬৩ জন নার্সের মধ্যে ৫৩ জনই উপজাতি নার্স, বাকি ১০ জন বাঙ্গালী নার্স। অর্থাৎ ৮৪.১% নার্সই উপজাতি, অন্যদিকে মাত্র ১৫.৯% নার্স বাঙ্গালী। অথচ এ নার্স স্থানীয় পর্যায়ে (জেলা পরিষদ) নিয়োগ হতো, পরবর্তীতে ১০ম গ্রেডভুক্ত হওয়ায় পর হতে পিএসসি’র মাধ্যমে নিয়োগ হচ্ছে। অতঃপর জেলা পরিষদের অনুমতি সাপেক্ষে পোষ্টিং পায় খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে; যেখানে বাঙ্গালী নার্স এর পদায়নের পর যোগদানপত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে অনীহার অভিযোগ পাওয়া যায়।

শুধু কি তাই?

সদর হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) হিসেবে রয়েছে ৫ জন উপজাতি। সদর হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট হিসেবে রয়েছে ৩ জন উপজাতি। সদর হাসপাতালের মেডিকেল টেকলোজিস্ট (এক্স-রে) হিসেবে রয়েছে ২ জন উপজাতি। সদর হাসপাতালের মেডিকেল টেকলোজিস্ট(ডেন্টাল) হিসেবে রয়েছে ২ জন উপজাতি। সদর হাসপাতালের মেডিকেল টেকলোজিস্ট(ইপিআই) হিসেবে রয়েছে ১ জন উপজাতি। এসবের একটিতেও বাঙ্গালী নেই।

অন্যদিকে সদর হাসপাতালে অফিসিয়াল কর্মচারী হিসেবে রয়েছে ৩ জন বাঙ্গালী। এরমাঝে কি আপনার চোখে কোনো বৈষম্য ধরা পড়ে? এখন এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপনি কোথায় গিয়ে কথা বলবেন?

রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায়ও একই চিত্র রয়েছে বলে জানতে পেরেছি।

ফিরে যাওয়া যাক, জেলা পরিষদে। সম্প্রতি ২৮ জুলাই খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও ইউএনডিপি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন একটি নিয়োগের চিত্র দেখে নেওয়া যাক। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটিতে ২৯ জুলাই walk in interview ভিত্তিতে (WaGEIE-CHT) Phase II প্রজেক্টে সর্বমোট ৮ জন, CoRLIA প্রজেক্টে সর্বমোট ৮ জন নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। যথারীতি ২৯ তারিখ ওয়াকইন ইন্টারভিউ শেষে ওই দিনই ফলাফল প্রস্তুত করা হয় এবং দুই প্রজেক্টে ৮ জন করে মোট ১৬ জনের ফলাফল প্রকাশিত হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ নিয়োগ আদেশ সরকারের পট পরিবর্তনের পরেই করা হয়েছে এবং আগষ্ট ১ তারিখ হতে নিয়োগ দেখিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক নিয়োগের যোগদানপত্র গৃহীত হয়েছে মর্মে বলা হচ্ছে। তাছাড়া, নিয়োগের যোগদানপত্র গ্রহণ বিষয়ক পত্র জারী করা কর্মকর্তা উক্ত তারিখে স্টেশনে ছিলেন না।

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে CoRLIA প্রজেক্টে ৮ জন নিয়োগের কথা থাকলেও এ প্রজেক্টে ৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একই পত্রে HCWM নামে একটি প্রজেক্টে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যেটার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এত স্বল্প সময়ে নিয়োগ সম্পন্ন হতে খা.পা.জে.প. এর ইতিহাসে ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। এই নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, সাম্প্রদায়িকতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

যাহোক, বৈষম্য প্রসঙ্গে ফেরা যাক। (WaGEIE-CHT) Phase II, CoRLIA ও HCWM প্রজেক্টে যথাক্রমে ৮ জন, ৯ জন ও ১ জন সর্বমোট ১৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ১৮ জন কর্মীর মধ্যে ১৫ জন উপজাতি সদস্য এবং ৩ জন বাঙ্গালী সদস্য। অর্থাৎ ৮৩.৩% আসনই উপজাতির জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে এই নিয়োগে, বাকি ১৬.৭% বরাদ্দ দিয়েছে বাঙ্গালীর জন্যে।

এসবের পরে কি আপনার মনে হয়, মেধার মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় চাকরি হয়?

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কাঠামোগত বৈষম্য:

চলুন দেখা যাক, যে জেলা পরিষদ নিয়ে জেলায় এতো কথা সে জেলা পরিষদের চিত্র। শুভঙ্করের ফাঁকির গল্প যেটা তা এখানেই।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ৭৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারির একটি টিম তথা সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পরিচালিত হয়ে থাকে। এই অর্গানোগ্রামের আলোকে সদ্য বিলুপ্ত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক।

চাকুরির পদবিকে আমরা যদি অফিসার (১ম ও ২য় শ্রেণি), ক্লারিকাল (৩য় শ্রেণি) ও সাপোর্টিং স্টাফ (৪র্থ শ্রেণি) এ ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত করি সেক্ষেত্রে আপনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন জেলা পরিষদের অধিকাংশ অফিসিয়াল কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকেন ‘ক্লারিকাল’ স্টাফগণ। অফিসারগণ যেহেতু ডেপুটেশনে আসেন, তাঁদের হিসেব করে লাভ নেই।

চলুন দেখে নেই সদস্যদের সংখ্যানুপাত। ক্লারিকাল (৩য় শ্রেণি) পোস্টে ২৭ টি পোস্টের মধ্যে উপজাতির সংখ্যা ১৩ জন এবং বাঙ্গালীর সংখ্যা ৩ জন। ক্লারিকাল পোস্টে সর্বমোট ২৭ টি পোস্টের মধ্যে বাকি ১১ টি পোস্টে দায়িত্বরত কেউ নেই অর্থাৎ পদশূন্য।

অন্যদিকে সাপোর্টিং স্টাফ (৪র্থ শ্রেণি) পোস্টে ২৪ টি পোস্টের মধ্যে উপজাতির সংখ্যা ১১ জন এবং বাঙ্গালীর সংখ্যা ১৩ জন। সাপোর্টিং স্টাফ পোস্টে সর্বমোট ৩৪ টি পোস্টের মধ্যে বাকি ১০ টি পোস্টে দায়িত্বরত কেউ নেই অর্থাৎ পদশূন্য।

এ থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, উপজাতিদের ভাইটাল পোস্টে নিয়োগ প্রদান শেষে বাঙ্গালীদের ৪র্থ শ্রেণির পোস্টে নিয়োগ দিয়ে উপজাতি ও বাঙ্গলীর জন্যে তথাকথিত ৯ঃ৯ঃ৬ঃ৬ (বাঙ্গালিঃচাকমাঃমারমাঃত্রিপুরা) পদ্ধতিতে নির্ধারিত অনুপাত তথা কোটা পূরণ করা হয়!

শুভঙ্করের ফাঁকিটা ধরতে পেরেছেন?

আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের ওয়েবসাইটে কর্মকর্তাদের নামের তালিকায় গেলে দেখতে পাবেন ‘আইটি অফিসার’ নামে একটি পদ হোল্ড করছেন একজন উপজাতীয় ব্যক্তি। মাসিক ৬০ হাজার টাকা বেতনে প্রায় ১৪-১৫ বছর কর্মরত এ কর্মকর্তার বাড়ি নাকি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায়। অন্যদিকে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অনুমোদিত অর্গানোগ্রামে ‘আইটি অফিসার’ হিসেবে কোনো পদ নেই।

তবে, সহকারী প্রোগ্রামার (৯ম গ্রেড) নামীয় একটি পদ থাকলেও অদৃশ্য কারণে এ পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। এতে কি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে? খাগড়াছড়ি জেলায় আইটি এক্সপার্ট লোকের কি তবে এতই অভাব? তাছাড়া, খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা ছাড়া জেলা পরিষদ কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ করে না!
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড-এ বৈষম্য:

উন্নত সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিশন নিয়ে পরিচালিত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড তাঁদের অন্যান্য কার্যক্রমের পাশপাশি প্রতিবছর শিক্ষাবৃত্তির আয়োজন করে থাকে। চলুন দেখে নেই শিক্ষাবৃত্তির আনুপাতিক হার-

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর পক্ষ থেকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ৭৭০ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয় যার মধ্যে কলেজ পর্যায়ে ৩৫০ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪২০ জন। কলেজ পর্যায়ের ৩৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপজাতির সংখ্যা ২৫০ জন এবং বাঙ্গালীর সংখ্যা ১০০ জন। অর্থাৎ কলেজ পর্যায়ে ৭১.৪% উপজাতির বিপরীতে বাঙ্গালীকে ২৮.৬% সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪২০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৭০ জন উপজাতি ও বাকি ১৫০ জন বাঙ্গালীকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৬৪.৩% উপজাতির বিপরীতে বাঙ্গালীকে ৩৫.৭% সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

একই অর্থবছরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর পক্ষ থেকে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার ৭৩৬ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয় যার মধ্যে কলেজ পর্যায়ে ৩৩৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪০০ জন। কলেজ পর্যায়ের ৩৩৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপজাতির সংখ্যা ২১৫ জন এবং বাঙ্গালীর সংখ্যা ১২১ জন। অর্থাৎ কলেজ পর্যায়ে ৬৩.৯% উপজাতির বিপরীতে বাঙ্গালীকে ৩৬.১% সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২১৬ জন উপজাতি ও বাকি ১৮৪ জন বাঙ্গালীকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৫৪% উপজাতির বিপরীতে বাঙ্গালীকে ৪৬% সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

একই অর্থবছরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর পক্ষ থেকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার ৭১০ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয় যার মধ্যে কলেজ পর্যায়ে ৩১৮ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৩৯২ জন। কলেজ পর্যায়ের ৩১৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপজাতির সংখ্যা ২৫২ জন এবং বাঙ্গালীর সংখ্যা ৬৬ জন। অর্থাৎ কলেজ পর্যায়ে ৭৯.২% উপজাতির বিপরীতে বাঙ্গালীকে ২০.৮% সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৩৯২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৪৮ জন উপজাতি ও বাকি ১৪৪ জন বাঙ্গালীকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৬৩.২% উপজাতির বিপরীতে বাঙ্গালীকে ৩৬.৮% সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষাবৃত্তির বিষয় যেহেতু চলে এসেছে, চলুন দেখে নেই খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে বৈষম্য:

গত ৩০.০৪.২০২৪ ইং তারিখে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ জনাব মো. সরাফত হোসেন স্যারের সাক্ষরিত একটি নোটিশে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয় যেখানে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে ৩১৩ জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়। এই ৩১৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপজাতি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৪৪ জন এবং বাঙ্গালী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৯ জন। অর্থাৎ এই শিক্ষা বৃত্তিতে ৭৮% উপজাতি শিক্ষার্থীর বিপরীতে ২২% বাঙ্গালী শিক্ষার্থীকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

এ জায়গায় বাঙ্গালী শিক্ষার্থীদের সাথে কি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে না?

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে দীর্ঘদিন ধরে উপজাতীয় চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হলেও ভাইস-চেয়ারম্যান পদটি বাঙ্গালী সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি চলমান ছিল। যেহেতু, সরকার ইতোমধ্যে ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে উপজাতীয় সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করেছেন এবং চেয়ারম্যান পদে বাঙ্গালী নিয়োগে কোনো বাঁধা নেই, তাই বৈষম্য দূরীকরণে চেয়ারম্যান পদটি বাঙ্গালীদের মধ্যে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ করা সময়ের দাবী।

ইনকাম ট্যাক্সের ক্ষেত্রে বৈষম্য:

একটি জেলায় প্রথম সারির কোনো ব্যবসার কথা কেউ চিন্তা করলে সেটা হবে ঠিকাদারী ব্যবসা যেটি টেন্ডার সম্পর্কিত। এই ঠিকাদারী ব্যবসার মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম তথা রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দিরসহ যাবতীয় সকল সরকারি নির্মাণ ও সাপ্লাই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

এবার আসুন মূল পয়েন্টে। দেশে বসবাসরত আমাদের প্রত্যেকের আয় এর একটা নির্দিষ্ট এমাউন্ট অতিক্রম করলেই আমাদেরকে সে আয় এর উপর আয়কর দিতে হয়। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন, তিন পার্বত্য জেলায় উপজাতিদের আয়ের উপর কোনো ধরণের ট্যাক্স দিতে হয় না, যেটা ৩ পার্বত্য জেলার বাঙ্গালীদের দিতে হয়। আপনি চাকরি করেন কিংবা ব্যবসা করেন, আপনি উপজাতি হলে ইনকাম ট্যাক্স এর আওতামুক্ত।

এতে করে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ঠিকাদারি পেশায় এই আয়কর মুক্ত হওয়ার দরুণ প্রবলেমটা কোথায় গিয়ে ঠেকছে চলুন দেখে নেই-

আয়করমুক্তভাবে একটা কাজ করে ৫-৭% টাকা বাড়তি পাওয়ার লোভে বাঙ্গালী ঠিকাদারগুলো উপজাতি লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ করে থাকে। বছরের পর বছর তিন পার্বত্য জেলায় বাঙ্গালী ও পাহাড়ি উভয়ে উপজাতীয় লাইসেন্সে কাজ করতে থাকায় তাঁদের লাইসেন্স এখন অনেক ভারী।

এক্ষেত্রে সমস্যাটা কোথায় জানেন? যেকোনো টেন্ডারে আপনি যখন এটেন্ড করতে যাবেন, সেখানে অভিজ্ঞতা (Work done) চাওয়া হয়। অভিজ্ঞতা যার যত বেশি, ইভালুয়েশনে তাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজটি দেওয়া হয়। এখন আপনি যদি একজন নতুন ঠিকাদার হয়ে থাকেন, কীভাবে ঐ ভারী লাইসেন্স বাহকদের সাথে গিয়ে ফাইট করবেন? এক কথায় যদি বলতে যাই, নতুন করে নিজ পরিচয়ে কারও ঠিকাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ এখানে নেই বললেই চলে সে আপনি বাঙ্গালী হোন বা উপজাতি হোন। অর্থাৎ যুগের পর যুগ ঐ লাইসেন্সগুলো ক্রমেই ভারী হয়েই চলেছে। যার কারণে উক্ত লাইসেন্সগুলো এখন নিজ জেলা ছাড়িয়েও দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যবহার হয়ে থাকে।

জমি ক্রয়ে বৈষম্য:

আপনি ৩ পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা না হলে পার্বত্য জেলা সমূহের কোথাও স্থানীয় আইন অনুযায়ী জায়গা ক্রয় করতে পারবেন না। উপজাতীয়রা সারা বাংলাদেশের জায়গা ক্রয় করে স্যাটেল হতে পারবেন কিন্তু বাঙ্গালীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে জায়গা ক্রয় করতে রয়েছে বাঁধা। বাঙ্গালীরা পাহাড়ে স্যাটেল হলে বলা হচ্ছে সেটেলার/অপজাতীয়/অপাহাড়ী। কিন্তু, সারা বাংলাদেশে উপজাতীয়রা স্যাটেল হলে তাদেরকে একইভাবে সেটেলার বলা যাবে?

গেল বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে বান্দরবানের রোয়াংছড়ির খামতাং পাড়ায় দু’টি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলিতে আটজন নিহতের পর ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে অন্তত ৩০০ পাড়াবাসী ভিটেমাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে গিয়েছিল; যাদের অধিকাংশই বম সম্প্রদায়ের মানুষ। আড়াইশর বেশি খিয়াং সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের পাড়া ছেড়ে রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং রুমা উপজেলা সদরের বম কমিউনিটি সেন্টারে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তো এ ধরণের সম্প্রদায়ের যারা আছে তাঁদেরকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। এরা যাতে সেখানে শান্তিতে বসবাস করতে পারে সরকারের উচিৎ উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। যাদের ঘর-বাড়ি নেই তাঁদেরকে সরকারি সহায়তায় ঘর-বাড়ি দিয়ে সেটেল করা। তবে তাদেরকে সেটেলার বলার প্রয়োজন নেই।

জায়গা ক্রয় বিষয়ে পার্বত্য এলাকায় চলমান রীতি দেশের সংবিধান বিরোধী একটি কার্যক্রম যেটি সংবিধানের ১৩ নং (মালিকানার নীতি) এবং ৪২ নং (সম্পত্তির অধিকার) অনুচ্ছেদ পড়লেই পরিষ্কার হওয়া যাবে।

অন্যদিকে পার্বত্য জেলার আইনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের উপজাতীয় বলা হলেও তারা বর্তমানে বিশেষ উদ্দেশ্যে ‘আদিবাসী’ নামকরণে অতি উৎসাহী। অথচ, সরকারি আদেশ দিয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

পড়াশোনা ও চাকরিতে বৈষম্য:

ক্যাডেট কলেজ, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় উপজাতি কোটা দিয়ে থাকে। একইভাবে
দেশের প্রায় সকল সরকারি চাকরি, বিসিএস, ব্যাংক, স্থানীয় জেলা প্রশাসন কর্তৃক নিয়োগ ইত্যাদিতে উপজাতীয় কোটা প্রদান করা হয়।

অথচ একই পরিবেশে, একই ক্যাম্পাসে ছোট থেকে বড় হওয়া বাঙ্গালীদের জন্যে দেশের উল্লেখযোগ্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কিংবা চাকরির নিয়োগে কোথাও এ ধরণের কোনো কোটা ব্যবস্থা নেই।

ফলশ্রুতিতে উদাহরণস্বরূপ যদি বলি-

একটি জেলার কেন্দ্রিয় ব্যাংকের ভূমিকা রেখে থাকে অত্র জেলার সোনালী ব্যাংক। খাগড়াছড়ির সোনালী ব্যাংকের চিত্র যদি বলতে যাই, এখানে কর্মরত কর্মকর্তাদের সংখ্যা সর্বমোট ২২ জন। এর মধ্যে উপজাতির সংখ্যা ১৪ জন, বাঙ্গালীর সংখ্যা ৮ জন। অর্থাৎ প্রায় ৬৪% কর্মকর্তা উপজাতি এবং ৩৬% কর্মকর্তা বাঙ্গালী। এই ৬৪% উপজাতিগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার হলেও ৩৬% বাঙ্গালীর মধ্যে তেমন কেউ পার্বত্য চট্টগ্রামের নেই। অথচ এ সোনালী ব্যাংকের নিয়োগ কোনো স্থানীয় পর্যায়ের নিয়োগ নয়, এটা হয়ে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে। একইচিত্র তিন পার্বত্য জেলার প্রায় সকল সরকারি ব্যাংকে।

কোটা সিস্টেম বা বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় কোনো জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়লে তাকে এগিয়ে আনার জন্যে বা অগ্রসরমান জনগোষ্ঠীর সমান করার জন্যে। উল্লিখিত রেশিউ দেখার পর কারা এগিয়ে আছে বা কারা পিছিয়ে আছে বলে মনে হয়?

কোটা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বললেই, এখন প্রশ্ন আসতে পারে দুর্গম এলাকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে। যেখানে সহজ যাতায়ত ব্যবস্থা নেই। এ সম্পর্কিত কথায় মাঝে মাঝে আরও দেখা যায় চিকিৎসার জন্যে রাস্তা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার না করে কাঁধে করে পেশেন্টকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আপনি কি জানেন পার্বত্য এলাকায় জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নতুন রাস্তা করতে গেলে কত ধরণের বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় সরকারকে বা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে? আদও সব জায়গায় রাস্তা করতে পারে কি-না? বা কারা বাঁধা দেয়? যদি না-ই পারে, তো কীভাবে জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করবে? কীভাবে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া পেশেন্টকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাবে? একই সাথে দুইরকম রোল প্লে করা কি আদও সম্ভব- যে রাস্তাও লাগবে না, আবার অ্যাম্বুলেন্সে করে পেশেন্টও নিয়ে যাওয়া লাগবে!

প্রসঙ্গত, পার্বত্য এলাকায় সিনিয়র ডাক্তাররা আসতে চাননা এয়ার ব্যবস্থা নেই বলে, সুতরাং ৩ পার্বত্য জেলায় বিমান বন্দর স্থাপন করা অতীব জরুরী।

যাহোক, আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- উপজাতিদের জন্যে যে কোটা প্রচলিত আছে দেশে তাঁর কত অংশ ঐসকল প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলে মেয়েরা ভোগ করতে পারে? খোঁজ নিলে দেখতে পারবেন তার অধিকাংশই জেলা/উপজেলা সদরের ছেলে-মেয়েরা ভোগ করছে। কোটা যদি দিতেই হয়, যারা প্রকৃত এই কোটার দাবীদার তাদেরকে দিন, ঐসকল অঞ্চল এলাকা অনুযায়ী মার্ক করুন। নয়তো বলাই যায়, এখানে বড় ধরণের একটি বৈষম্য করা হচ্ছে উপজাতি ও বাঙ্গালীদের মধ্যে।

রাস্তাঘাট সম্পর্কিত কথা যেহেতু চলে এসেছে চাঁদাবাজি নিয়ে কিছু কথা:

পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈষম্যের আগাগোড়া এর ১ম পর্বে চাঁদাবাজি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে ধারণা দেয়া হয়েছে। এ চাঁদাবাজিটি শুধুমাত্র বাঙ্গালীদের উপর করা হচ্ছে এমনটি নয়। চাঁদাবাজিটি করছে উপজাতীয় বিশেষ গোষ্ঠী বা সংগঠন। এখানে বদনামিটি হচ্ছে উপজাতীয়দের, কিন্তু বাঙ্গালীদের চেয়ে সাধারণ উপজাতীয়রা চাঁদাবাজির ভুক্তভোগী বেশি। সরকারি চাকুরে থেকে শুরু করে সাধারণ উপজাতীয় এবং বাঙ্গালীদের ব্যবসা, ঠিকাদারী, ব্রিকফিল্ড, বাসা-বাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে চাঁদা না দিয়ে কোনো কাজ করা যায় না। এ সকল চাঁদা মাসিক/বাৎসরিক কিংবা এককালীন হয়ে থাকে। ৪/৫টি গ্রুপ বা সংগঠনকে চাঁদা না দিলে আপনি কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন না।

এনজিও-তে বৈষম্য:

তিন পার্বত্য জেলায় দেশি ও বিদেশী এনজিও খুবই সক্রিয়। এনজিও-দের মাধম্যে তিন পার্বত্য জেলায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এনজিওগুলোর প্রকল্পে জেলা/উপজেলা ভিত্তিক যে সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেগুলোর সিংহভাগই উপজাতীয় এলাকায় কিংবা উপজাতীয়দের জন্যে। এনজিওগুলোর বৈষম্যের কারণে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী নায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এনজিওগুলোর নেতৃত্ব এবং কর্মকর্তা/কর্মচারী প্রায় সকলেই উপজাতীয়। ইউএনডিপিসহ স্থানীয় এনজিও প্রধানদের স্বজনপ্রীতি এবং সাম্প্রদায়িক কার্যাবলি আজ সকলের কাছে উন্মোচিত। বাঙ্গালী নেতৃত্বের কিংবা বাঙ্গালীদের জন্য বিশেষ কোনো প্রকল্প বা উন্নয়ন কার্যক্রম সাধিত হয়েছে কিনা বিগত দুই দশকে কোনো এনজিও প্রমাণ করতে পারবে না। এ সকল এনজিওগুলি অনেকক্ষেত্রে সরকারের অগোচরে উদ্দেশ্যমূলক বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক কার্যক্রম পরিচালনারও অভিযোগ রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার লক্ষ্যে এ সকল এনজিও কার্যক্রম তদন্ত করে উপকারভোগীদের চিহ্নিত করা এখন সময়ের দাবী। বৈষম্য নির্মূল করে এনজিওগুলিকে সকল সম্প্রদায়ের সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান নিশ্চিতের ব্যবস্থা আদৌ কি হবে?

যাহোক, এমন আরও অসংখ্য বৈষম্যের চিত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান যেগুলো একটু আন্তরিক দৃষ্টিতে তাকালে যে কেউ দেখতে পাবে। এ ধরণের বৈষম্যগুলো যুগের পর যুগ জিইয়ে রাখার কারণে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়গুলো বিক্ষিপ্তভাবে হয়তো সকলেরই জানা, আমি চেষ্টা করলাম এক জায়গায় সব তুলে ধরতে। এতেকরে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের যে বৈষম্য বিদ্যমান তা সকলের সামনে আসবে এবং একটি সমাধানের পথ খুঁজে নেওয়া যাবে।

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনয়ের সাথে বলছি- দেশের এক-দশমাংশের প্রতি আপনারা সদয় দৃষ্টি দিয়ে বাঙ্গালী এবং উপজাতি উভয় সম্প্রদায় এর ৩ জেলা থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক দেশের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সচেতন, দায়িত্ববান, নেতৃত্বের অধিকারী শিক্ষিত লোক নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ সকল বৈষম্য নিরসন করুন।

পরিশেষে আমি বলতে চাই, এক দেশে দুই নীতি থাকতে পারে না। আমরা পাহাড়ে বসবাসকারি, একই পরিবেশে বেড়ে উঠা, একই বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করা উপজাতি, বাঙ্গালী সকল সম্প্রদায়ের মানুষ সম্মিলিতভাবে কাঁধে কাঁধ রেখে এগিয়ে যেতে চাই। প্রয়োজনে ৩ পার্বত্য জেলায় এ ধরণের তথাকথিত ৯ঃ৯ঃ৬ঃ৬ (বাঙ্গালিঃচাকমাঃমারমাঃত্রিপুরা) প্রথা তুলে দিয়ে জনসংখ্যার ভিত্তিতে মেধাকে মূল্যায়ন করুন। যারা মেধায় টিকে আসতে পারে তারাই নিয়োগ পাবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক পরিবেশ তৈরি করুন।

পাহাড়ে সংঘঠিত উল্লিখিত সকল বৈষম্য নিরসন করে আমাদের ডিভাইড এন্ড রুল থেকে মুক্তি দিন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন