ফ্যাক্টচেক

‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিচরণ’ দাবিতে ভিডিও ভাইরাল, যা জানা গেল

পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র বাহিনী বিচরণের দাবিতে ফেসবুক পোস্ট। ছবি: স্ক্রিনশট
fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামে দুর্গম পাহাড়ে একটি সশস্ত্র গ্রুপ ঘুরে বেড়াচ্ছে-এমন দাবিতে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়েছে। ভিডিওটি একই ক্যাপশনে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেজ এবং এক্স অ্যাকাউটেও পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিওটি ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করা। এতে পাহাড়ি এলাকার একটি সরু রাস্তায় সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মের মতো পোশাকে আট জন সশস্ত্র ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে। শারীরিক গঠন বিবেচনায় অন্তত দুজনকে নারী বলে মনে হচ্ছে।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক গণকণ্ঠের ফেসবুক পেজে শুক্রবার (২ মে) রাত ৯টায় প্রকাশিত ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এরা কারা; কিভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।’ (বানান অপরিবর্তিত)

গতকাল শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত ১ মিনিট ১৯ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের ভিডিওটি ৩ লাখ ৮৩ হাজার বার দেখা হয়েছে এবং রিঅ্যাকশন পড়েছে ৪ হাজার ৪০০। পোস্টে ২৭০টি কমেন্ট পড়েছে এবং শেয়ার হয়েছে ৮ হাজার ৩০০। এসব কমেন্টে ভিডিওটি অন্য দেশের উল্লেখ করে কেউ কেউ কমেন্ট করেছেন। আবার এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ভিডিও বলে অনেকে কমেন্ট করেছেন।

Ahmed Jakariya নামে অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড যেমন বাংলাদেশ ভারতের বিভিন্ন সিমান্ত পাহারা দিচ্ছে তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অঞ্চল গুলোতেও বর্ডার গার্ডের পাহারা আরো জোরদার করা জরুরি।’ (বানান অপরিবর্তিত)

Moahmmed Jashim Uddin লিখেছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীগুষ্টি গুলি সক্রিয় হচ্ছে মনে হয় আমাদের সাবধান হওয়া খুবই দরকার।’ (বানান অপরিবর্তিত)

Al-Amin Rahman ও Sheikh Abdullah নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং Shahalam Sajeeb নামে এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে একই ক্যাপশনে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে।

ভিডিওটির কিছু কি–ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হলে Eshita Angom নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বরে প্রকাশিত ভিডিওতে একই দৃশ্য দেখা যায়। তবে এই ভিডিওটির দৈর্ঘ্য ৩ মিনিট ৪১ সেকেন্ড। এর ৩২ সেকেন্ড থেকে ৫০ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যের সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওটির মিল রয়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘ সংস্করণের এই ভিডিওর ৫০ সেকেন্ডের পরের দৃশ্যে আরও একজনকে যুক্ত হয়ে ৯ জন দেখা যায়। এর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে থাকা সশস্ত্র ব্যক্তি, তাঁদের পোশাক, পাহাড়ি এলাকার সাদৃশ্য রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিচরণ দাবিতে ছড়ানো ভিডিওর সঙ্গে Eshita Angom নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ভিডিওর সাদৃশ্য। ছবি: স্ক্রিনশট

এই ভিডিওর শেষের অংশে পাহাড়ের চূড়ায় ১২–১৩ জনের একটি গ্রুপের অরবিটিং প্যারালেক্স ড্রোন শটের (কোনো সাবজেক্টকে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরে দৃশ্য ধারণ) দৃশ্য দেখা যায়। এতে একটি ক্রুশের মতো একটি কাঠামো মাঝখানে রেখে সবাইকে অস্ত্র হাতে পোজ দিতে দেখা যায়। এর মধ্যে একজনের ড্রোন কন্ট্রোলার দেখা যায়। দুইজন ছাড়া বাকিরা সবাই একই ধরনের পোশাক পরা। তাদের কেউ কেউ ড্রোনের দিকে অস্ত্র তাক করে পোজ দিচ্ছিলেন। এই দৃশ্যে উপস্থিত প্রায় সবার অস্ত্রের ওপরের দিকে লাল কাপড়ের ফিতা বাঁধা। ভিডিওর শেষে ইংরেজিতে ‘DIRECTED BY, Input Title’ লেখা দেখতে পাওয়া যায়।

ভিডিওর ক্যাপশনটি রোমান হরফে বিদেশি ভাষায় লেখা। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘Kuki Minai singsina taoribase meitei Eikhoina touramladi Action nanghouroi.’। ক্যাপশনটির ভাষা সম্পর্কে জানতে গুগল ট্রান্সলেটেরের ভাষা শনাক্তকারী টুলের সহায়তা নেওয়া হয়। এটি ককবরক ভাষায় লেখা বলে জানায় গুগল। এটিকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করে বোধগম্য কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। ককবরক হলো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের জাতীয় ভাষা।

গুগল ট্রান্সলেটরের সহায়তা নিয়েও ভাষা বোঝা না গেলেও এতে কিছু পরিচিত শব্দ পাওয়া যায়। যেমন, ‘Kuki’, ‘meitei’, ‘Action’।

এসব শব্দগুচ্ছ গুগলে সার্চ করে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ২০ জুলাই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মেইতেই ও কুকি ভারতের মণিপুর রাজ্যে দুটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী। মণিপুরের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মেইতেই জনগোষ্ঠীর। অন্যদিকে ৪৩ শতাংশ লোক কুকি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বাস। মেইতেই গোষ্ঠীর অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং কুকিদের অধিকাংশ খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী। ভূমির অধিকার ও স্থানীয় প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। ২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই জনগোষ্ঠীর কিছু লোক কুকি জনগোষ্ঠীর একটি গ্রাম ধ্বংস করার পর সেখানকার দুই নারীকে নগ্ন করে কুচকাওয়াজ করায়। এই ঘটনার পর মণিপুরের সংঘাতময় পরিস্থিতি নতুন মাত্রা পায়। ভারতের রাজ্যটিতে এখনো অশান্তি বিরাজ করছে।

মনিপুরে সর্বশেষ সংঘাতের কারণ ছিল মেইতেই গোষ্ঠীর লোকদের তফসিলী জাতির ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্ত। এর প্রতিবাদে কুকি জনগোষ্ঠী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২০২৩ ৩ মে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যটিতে জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত সহিংসতায় ২৫৮ জন নিহত এবং ৬০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ৪ হাজার ৭৮৬টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং মন্দির ও গির্জাসহ ৩৮৬টি ধর্মীয় কাঠামো ভাঙচুর করা হয়েছে। তবে বেসরকারি সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংখ্যা আরও বেশি।

Eshita Angom নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া দীর্ঘ ভিডিওর শেষ দিকের কিছু দৃশ্যের কি–ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হলে Ashwini Shrivastava নামে একটি এক্স অ্যাকাউন্টে ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। এই ভিডিও ক্লিপটি Eshita Angom নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট হওয়া ভিডিওর ৩ মিনিট ১১ সেকেন্ড থেকে ৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড পর্যন্ত রয়েছে।

 

ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, ‘মণিপুরে কুকি সন্ত্রাসীরা মেইতেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা মেইতেই গ্রামগুলোর কাছে খ্রিস্টান ক্রুশ চিহ্নসহ ক্যাম্প স্থাপন করছে। এটি কোনো জাতিগত সংঘাত নয়, বরং গত ১৮ মাস ধরে কুকি সন্ত্রাসীরা মেইতেইগ্রামগুলোতে ধারাবাহিকভাবে পরিকল্পিত হামলা চালাচ্ছে।’ (ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত)

একই তথ্যে ভিডিওটি ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ভারতের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন অরগানাইজারের এক্স অ্যাকাউন্টে, একই বছরের ২২ ডিসেম্বর TheBlueHills নামে এক্স অ্যাকাউন্টে এবং Front Fact News নামে একটি লিংকড ইন অ্যাকাউন্টে পাওয়া যায়।

ভারতের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন অরগানাইজার ও TheBlueHills নামে এক্স অ্যাকাউন্ট এবং Front Fact News নামে লিংকড ইন অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশট। ছবি: স্ক্রিনশট
ভারতের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন অরগানাইজার ও TheBlueHills নামে এক্স অ্যাকাউন্ট এবং Front Fact News নামে লিংকড ইন অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশট। ছবি: স্ক্রিনশট

এই দৃশ্যে অস্ত্রে লাল ফিতা বাঁধার বিষয়টি জানার চেষ্টা করে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ।

কুকি ও মেইতেই জনগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ রেখে প্রাসঙ্গিক কি–ওয়ার্ড সার্চ করলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির ওয়েবসাইটে গত ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিতে সশস্ত্র ব্যক্তিদের হাতে থাকা অস্ত্রে লাল ফিতা বাঁধা দেখা যায়। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা, মণিপুরের বিজেপি মুখপাত্র মাইকেল লামজাথাং হাওকিপকে হুমকি দিচ্ছে কুকি জঙ্গি। ছবিটি ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট।

Eshita Angom নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ভিডিওর সঙ্গে এনডিটিভির প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবির সাদৃশ্য। ছবি: স্ক্রিনশট

একই তথ্য ও ভিডিওসহ ভারতের মণিপুর রাজ্যের বেসরকারি ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম এলিট টিভির ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও পাওয়া যায়।

সুতরাং, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিচরণ’ দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ভিডিওটি বাংলাদেশের নয়। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, ভিডিওটি ভারতের মণিপুর রাজ্যের কুকি বিদ্রোহীদের।

সুত্র: আজকের পত্রিকা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: চীন, ভারত
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন