শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম


অনেক সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষকে বলতে শুনেছি, পার্বত্য চট্টগ্রাম যে আজও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এর প্রধান অন্তর্নিহিত কারণ, সেখানে সেনাবাহিনীর বলিষ্ঠ ভূমিকা ও বাঙালির শক্ত অবস্থান। আর এই দুটি কাজই করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
আগরতলা থেকে প্রকাশিত প্রীতি কুমার চাকমার বই থেকে আমরা জানতে পারি, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ’র’-এর তত্ত্বাবধানে শান্তি বাহিনী সৃষ্টি ও প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলেও ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিব আমলে তাদের অপারেশন চালানোর অনুমতি দেননি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সামরিক শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমানের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শান্তি বাহিনীর নেতাদেরকে দিল্লিতে ডেকে নেয়া হয় এবং অপারেশন চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
জিয়াউর রহমানের স্বল্প মেয়াদী ক্ষমতার শুরুর দিকেই ১৯৭৬ সাল থেকে শান্তি বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে। এই ঘটনার পরপরই জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। কিন্তু শান্তি বাহিনী স্থানীয় ট্রাইবালদের উপর চাপ সৃষ্টি করে যেন তারা সেনাবাহিনীকে বয়কট করে।
তারা যেন সেনাবাহিনীর কাছে কোনো পণ্য বিক্রি না করে এবং অন্য কোনোভাবেও যেন সেনাবাহিনীকে সহায়তা না করা হয়। শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র হুমকির মুখে স্থানীয়রা সেনাবাহিনীকে বয়কট করতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি অক্সিলিয়ারি ফোর্স।
জিয়াউর রহমান কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেই থেমে থাকেননি, সেই পরিস্থিতিতে নেন সুচিন্তিত পদক্ষেপ। তিনি বুঝতে পারেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ইনসার্জেন্সির অন্যতম কারণ সেখানকার পশ্চাদপদতা ও অনগ্রসরতা। তিনি এটাও বুঝতে পারেন, পাহাড়ের পশ্চাদপদ মানুষকে যদি সুশিক্ষা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও উন্নত জীবনের সন্ধান দেয়া যায়, তাহলে বিপথগামীরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দিতে পারবে না।
সে কারণে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সৃষ্টি করে পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করেন। তিনি সড়ক ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক প্রকল্প গ্রহণ করেন। কিন্তু সেখানেও সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত পাহাড়ের জুম-কৃষি নির্ভর মানুষ নির্মাণ কাজে দক্ষ ছিল না। এদের মধ্যেও যারা কাজ করতে পারতো, তারা সেনাবাহিনীকে অসহযোগিতা করার জন্য শান্তি বাহিনীর হুমকির মুখে এগিয়ে আসতে পারেনি। ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেখা দেয় স্থবিরতা।
অন্যদিকে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জনসংখ্যা সুষমবণ্টনের পলিসি নির্ধারণে কাজ চলছিল সরকারের ভেতর। সে সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের উক্ত দুটি প্রেক্ষাপট সামনে এলে সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ভূমিহীন মানুষকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের।
এরই অংশ হিসেবে সারাদেশের অনগ্রসর অথচ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ভূমিহীন মানুষকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সরকারি খাস জমিতে পুনর্বাসন করা হয়। জিয়াউর রহমানের সময়ে এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হলেও স্বল্প মেয়াদের কারণে তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। এটি সমাপ্ত হয়েছে এরশাদ সরকারের শাসনামলের প্রথম দিকে।
তবে তিনি আবার নিরাপত্তার অজুহাতে পার্বত্য বাঙালিদের প্রত্যাবাসিত ভূমি থেকে প্রত্যাহার করে গুচ্ছগ্রামে আবদ্ধ করেন। যে গুচ্ছগ্রাম এখন পাহাড়ের প্রত্যাবাসী বাঙ্গালীদের জীবনে আজ এক অভিশাপ বয়ে এনেছে।
এদিকে পাহাড়ের প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থায় ফসল উৎপাদনের হার কম হওয়ার কারণে জিয়াউর রহমান জুম চাষের পাশাপাশি পাহাড়ের জমিতে ফসলের বৈচিত্র্য আনার জন্য বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের উদ্যোগ নেন।
এবং এসব ফসল যাতে বিনিময়ের পরিবর্তে কৃষকরা বাজারে বিক্রি করে সঠিক মূল্য পেতে পারে, সেই লক্ষ্যে সৃষ্টি করেন ব্যাপক বাজারব্যবস্থা। প্রত্যাবাসিত বাঙ্গালীদের দেখাদেখি সেখানে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে লাঙলের চাষ বৃদ্ধি পায়, উন্নত বীজের কারণে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, আধুনিক বাগান সৃষ্টির কৌশল পাহাড়িদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
বিষয়টি শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার পর সেখানে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর হামলার পর জিয়াউর রহমান বুঝতে পারেন, স্বল্প সৈন্য ও সামরিক শক্তি দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
ফলে তিনি সেখান থেকে কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে যান। রামগড় হয়ে সীমান্ত পথে ভারতে গমন করেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর ভুক্ত এলাকা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে।
জেড ফোর্স গঠনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেন। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেভাবেই মনে রেখেছিলেন।
তার বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি সেই সময়ে সরাসরি সাজেক ও বেতলিং ভ্রমণ ছিল এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি যে সময় সেখানে গিয়েছিলেন, সমতল তো দূরের কথা অনেক পার্বত্যবাসীও আমাকে জানিয়েছেন, তারা জানতেন না ওই সব এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাস দমনে সেনা তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক সমাধানের দিকে জোর দেন। তিনি পাহাড়ি বিভিন্ন প্রথাগত নেতৃত্বের সাথে আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পন্থা বের করতে উদ্যোগী হন।
এরই অংশ হিসেবে, রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা পরিচালনার অভিযোগে সরকারের কাছে আটক থাকা শান্তি বাহিনীর তৎকালীন প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র ব্যোধিপ্রিয় লারমার সাথে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনার একপর্যায়ে সন্তু লারমা তার অনুসারীদের বোঝানোর জন্য মুক্তি কামনা করেন।
তার অভিপ্রায় অনুযায়ী জিয়াউর রহমানের সরকার সন্তু লারমাকে মুক্তি দেয়। এবং সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণস্বরূপ তার স্ত্রীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পদে সরকারি চাকরি দেয়া হয়। সন্তু লারমা মুক্তি পেয়ে তার অনুসারীদের বোঝানোর জন্য ভারতের ত্রিপুরায় গমন করেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে রহস্যজনকভাবে তিনি আর ফিরে আসেননি।
বিভিন্ন গবেষকদের লেখায় দেখা যায়, সরকারের হাতে আটক থাকা সন্তু লারমার এভাবে মুক্তি পাওয়া, তার স্ত্রীকে সরকারি চাকরি দেয়া এবং এভাবে ভারতে যেতে পারার কারণে তার অনুসারীরা তাকে সরকারি এজেন্ট হিসেবে সন্দেহ করতে শুরু করেন।
ফলে জেএসএস ও শান্তি বাহিনীর ভেতরে অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এক কথায়, ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির বীজ বপন করেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মোট কথা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আজও যে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ড হিসাবে বিরাজমান, তার প্রধান কারণ জিয়াউর রহমানের নেয়া কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ।