পার্বত্য চট্টগ্রাম কি পূর্ব তিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদান এর মত স্বাধীন জুম্মল্যান্ড হবে?
তিমির মজুমদার
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ভারতের অংশ হতে চেয়েছিল। তদানীন্তন চাকমা নেতা কামিনীমোহন দেওয়ান এবং স্নেহকুমার চাকমা রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা এবং বোমাং রাজা বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। একই ভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় (বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়ের বাবা) এবং বোমাং সার্কেল চিফ মংশৈ প্রু চৌধুরী পাকিস্তানীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনতিবিলম্ব পর হতেই তারা অস্ত্র সমর্পণ না করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হবার জন্য সাংগঠনিক ও সামরিক শক্তি অর্জন করতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা সংক্ষেপে ‘পিসিজেএসএস’ অথবা ‘জেএসএস’ নামে আঞ্চলিক দল গঠন করে এবং এই দলের সামরিক শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ নাম দিয়ে অদ্যাবধি পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করে রাখার চেষ্টায় লিপ্ত আছে।
গত ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ তারিখে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত প্রচেষ্টায় জেএসএস শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির সর্বমোট ৭২টি ধারার মধ্যে ইতোমধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ, ১৫টি ধারার সিংহভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৯টি ধারার বাস্তবায়ন আংশিকভাবে সম্পন্ন হলেও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা হচ্ছেনা; এই অজুহাতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করার পাঁয়তারা করে চলছে স্থানীয় একটি গোষ্ঠী। ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ‘জুম্মল্যান্ড’ নামে একটি নতুন দেশ গঠন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে তারা।
একই প্রেক্ষাপটে যদি ‘পূর্ব তিমুর’ কিংবা ‘দক্ষিণ সুদান’ এর দিকে দৃষ্টিপাত করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে মাত্র ২০ বছরের প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের নেতৃত্বে ইস্ট তিমুরকে ইন্দোনেশিয়া থেকে আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরী করা হয়েছে। মাত্র ৬০–৭০ বছরের প্রচেষ্টায় দক্ষিণ সুদানকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে সুদান থেকে আলাদা করে স্বাধীন দেশ হিসেবে নতুন দেশ তৈরী করা হয়েছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একই ধরণের ষড়যন্ত্র চলছে না তো ?
কাকতালীয়ভাবে দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার এবং পূর্ব তিমুরের আয়তন ১৪,৫০০ বর্গ কিলোমিটার যা প্রায় কাছাকাছি। ১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুরে ক্যাথলিক খ্রিস্টান এর জনসংখ্যার হার ছিল ৩০–৪০% যা ৯০ দশকে ৯০% পৌঁছায়। তথ্যসূত্রে জানা গেছে, যে তিন পার্বত্য জেলায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৫২,৬৯৯ জন ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু শুধুমাত্র ২০১৪–১৫ সালে সর্বমোট ৫০৬টি পরিবারের ২,২২২ জন ধর্মান্তরিত হয় এবং ২০১৫–১৬ সালে এ সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে সর্বমোট ১,৬৮৯টি পরিবারের ৫,৬৮৯ জন ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে জানা যায়। একই সাথে ২০১০ সালে তিন পার্বত্য জেলায় চার্চ এর সংখ্যা ছিল সর্বমোট ২০৯টি যা ২০১৫ সালে বেড়ে ২৫৭টিতে গিয়ে পৌঁছেছে। কিছু এনজিও এবং মিশনারী অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ধর্মান্তকারীদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে সাহায্য করছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বলা হচ্ছে যে, খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে অজীবন তারা যাবতীয় সুবিধা পেতে থাকবে এবং কেউ তাদের জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে না। দরিদ্রতার সুযোগ এবং জমির স্থায়ী মালিকানার লোভ দেখিয়ে সহজ সরল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ব্যাপকহারে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরকরণ করা হচ্ছে। কাজেই প্রতি বছরে এই সংখ্যা তিনগুণ হিসেবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে সেদিন আর বেশী দূরে নয় যখন পার্বত্য এলাকার একটি বৃহৎ জনসংখ্যা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভূক্ত হয়ে যাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এমন ভাবনার কারণ কি? প্রথমতঃ মুক্তিযুদ্ধের পর হতে অদ্যাবধি চলমান সশস্ত্র সংগ্রাম; দ্বিতীয়তঃ অনলাইন ও বিভিন্ন মিডিয়ার প্রচার প্রচারণা; তৃতীয়তঃ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের দাবীর পক্ষে ক্রমশঃ কতিপয় দেশী ও বিদেশী বুদ্ধিজীবীদের জোরালো সমর্থন এবং চতুর্থতঃ কিছু সংখ্যক বিদেশী এনজিও এবং দাতাগোষ্ঠীর একপেশে ও একনিষ্ঠ সমর্থন।
একইভাবে এর বিপক্ষে কোনরকম প্রচার প্রচারণা না করা এবং মিডিয়া ও সুশীল সমাজের চুপচাপ থাকা প্রকারান্তরে এসকল আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী দলসমূহের দাবীর পক্ষে সমর্থন দেবারই নামান্তর। এখানে উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা তাদের দেশের নাম, পতাকা, মুদ্রা ইত্যাদি কি এবং কেমন হবে তা তৈরী করে ফেলেছে এবং অনলাইন ও মিডিয়ার কল্যাণে সেগুলো ব্যাপক পরিচিতি করাতে সক্ষম হয়েছে।
অনলাইন প্রচার প্রচারণা এবং বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে উচ্চশিক্ষা ও চাকুরীর জন্য বিদেশে গমন করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সামনে ব্যানার ফ্যাস্টুনসহ র্যালি, মানববন্ধন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি নানারকম কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং তাদের দাবীর স্বপক্ষে নিরন্তর জনমত সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সমর্থন চেয়ে ইমেইল করা হয়েছে বলে জানা যায়। যিনি ইমেইলটি করেছেন তিনি নিজেকে ‘মাইনরিটি কংগ্রেস পার্টি’র আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, ক্যাপ্টেন ‘শচীন কর্মকার’ বলে দাবী করেছেন। ভারতের পূর্ব সীমানা সংলগ্ন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সহায়তা চেয়েছে।
একইভাবে বাংলাদেশে কর্মরত কিছু এনজিও, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং ‘Peace Campaign Group’ ইত্যাদি বাংলাদেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কর্মতৎপরতায় লিপ্ত বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নবাদী তথা জেএসএস, ইউপিডিএফ, জেএসএস (সংস্কার) ইত্যাদি দলসমূহ চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে যার পরিমাণ বাৎসরিক প্রায় সাড়ে চারশত কোটি টাকার মত। সেই অর্থের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই তারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে। আদায়কৃত অর্থের আর একটি বড় অংশ তাদের দাবী দাওয়ার পক্ষে প্রচার প্রচারণা এবং জনমত সৃষ্টির জন্য ব্যয় করছে বলে জানা যায়। ‘Peace Campaign Group’ নামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সাংগঠনটি বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা গোষ্ঠীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে দাবী করেছে যে, বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনী মিলে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে ‘ইসলামিকরণ’ চালাচ্ছে এবং বাংলাদেশ একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেছে।
এদিকে ইউএনডিপি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালীদের মাথা পিছু পাঁচ লক্ষ টাকা করে প্রদান করে বাংলাদেশের অন্য কোন স্থানে স্থানান্তরের জন্য একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেবার খবর পাওয়া গেছে। এই কৌশলে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বাঙ্গালীদের বিতাড়িত করতে পারলে সেখানে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন অনেক সহজতর হবে বলে অনুমেয়।
অতএব সাধু সাবধান । এখনই তৎপর না হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আঞ্চলিক অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হতে পারে। প্রাণপ্রিয় এই মাতৃভূমির প্রতিটি ইঞ্চির সাথে মিশে রয়েছে অনেক রক্ত ও ত্যাগ। আমরা সবাই বড় ভালোবাসি আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে। কাজেই এদেশের ভূখণ্ডে যারা স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ডের পতাকা উড়াবার স্বপ্ন দেখছেন, এদেশের স্বাধীনচেতা দামাল ছেলেরা তা বাস্তবায়ন হতে দেবে বলে মনে হয় না।
(লেখক: শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন কর্মী)