parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রাম, খ্রিস্টান মিশনারি ও বৌদ্ধধর্মের ভবিষ্যৎ-১

Ferdous Ahmed Quarishi f

ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

মাত্র বছর খানেক আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি তরফ থেকে কিছু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছিল। খোদ তথ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিদেশীদের কোন এজেণ্ডা থাকতে পারে, তাদের ধর্ম ও কৃষ্টির সুরক্ষা দেয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য।’ অর্থমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীও এ ব্যাপারে মুখ খুলেছিলেন। আইনমন্ত্রী সেখানে কর্মরত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা যে কোন দেশপ্রেমিক মানুষকে চিন্তায় ফেলবে।

আমাদের দেশের এই অঞ্চলটির দিকে বিশেষ বিশেষ মহলের ‘নেক-নজর’ আছে শতাব্দীকাল আগ থেকেই। ইতিহাস ঘাঁটলেই তা বোঝা যায়। সত্তরের দশক থেকে এ ব্যাপারে অনেকবার লিখেছি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্ণধাররা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কথিত ‘সিভিল সোসাইটি’ বিষয়টি বরাবর পাশ কাটিয়ে চলেছেন। উল্টো অনেকের বিরূপ মন্তব্য শুনেছি। দেরিতে হলেও এদিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে, তা কিছুটা স্বস্তির বিষয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরী- এই তিন প্রধান জনগোষ্ঠী তাদের ধর্মবিশ্বাস বা সমাজবদ্ধ জীবনধারার বিচারে অতিশয় সুসভ্য মানব সম্প্রদায়। চাকমা ও মারমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী। ত্রিপুরীরা মূলত হিন্দু। তাদের সবারই পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সুন্দর ও সুশৃঙ্খল। রাজনৈতিক বিপর্যয়ে বারংবার স্থানচ্যুত হয়ে এতকাল অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকলেও এখন অতি দ্রুত সামনে এগিয়ে আসছে। বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা লক্ষ্য করার মতো। ইতিমধ্যেই এই সম্প্রদায়টি শিক্ষার হারের বিচারে দেশে শীর্ষস্থানে চলে এসেছে।

কিছু স্মৃতি, কিছু অনুভূতি

নানা কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা ও সহমর্মিতা রয়েছে। ১৯৬১-৬২ সালের দিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে প্রকল্প এলাকায় নদীর পানি জমে বিশাল জলাধার তৈরি হয়, এতে চাকমা সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ তাদের জোতজমি হরিয়ে সর্বশান্ত হয়। পাকিস্তান সরকার তাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করেছিল, সেটাও তাদের হাতে ঠিকভাবে পৌঁছেনি। এই ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে একটি প্রচারপত্র বিলি করেছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। লারমা তখন চট্টগ্রাম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এই প্রচারপত্র বিলির অভিযোগে ‘ডিফেন্স অফ পাকিস্তান রুলস’ (ডিপিআর)-এ তাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজেই চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। চাকমা ছাত্ররা লারমার মুক্তি দাবি করে একটি বিবৃতি দেয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরণা দেন। কিন্তু কেউ সে সময় এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চাননি।

তখনকার দিনে ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি ছিলেন অগ্রজ-প্রতিম মঈনুল আলম। এখন তিনি কানাডায় অবসর জীবনে আছেন। তার অনুপ্রেরণায় আমি চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে চাকমা সম্প্রদায়ের সমস্যা তুলে ধরে এবং লারমার মুক্তির দাবি করে একটি বিবৃতি দিয়েছিলাম। বিবৃতিটি বেশ ফলাও করে দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল। (বিষয়টি ভুলেই গিয়েছিলাম। মঈনুল আলম ভাই কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীতে তার স্মৃতিকথায় এই বিবৃতিটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তাই আবার মনে পড়ে গেল।)

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই তখন ১০-১৫ জন চাকমা ছাত্র আমাদের সতীর্থ ছিল। এর মধ্যে একজন ছিল আরএল খিসা, সম্পর্কে মানবেন্দ্র লারমার চাচা। খিসা খুব ভালো কবিতা লিখত। কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে আমরা ‘অংকুর’ নামে একটি সাহিত্যপত্র বের করেছিলাম। খিসা ছিল এতে আমার অন্যতম সহযোগী। এতে তার একটা কবিতাও ছাপা হয়েছিল। সেবার গরমের ছুটিতে রাঙ্গামাটিতে তাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য খিসা আমাদের কয়েকজনকে খুব পীড়াপীড়ি করেছিল। আমরা যাব বলে কথা দিয়েও শেষ মুহূর্তে যাওয়া হয়নি। সে জন্য খিসা খুব রাগ করেছিল। মন খারাপ করে একাই রাঙ্গামাটি গেল। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। খবর এলো কাপ্তাই লেকে গোসল করতে নেমে সে ডুবে গিয়েছে।

খিসার মৃত্যুতে আমরা তার সহপাঠীরা খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। সে ছাত্র-শিক্ষক সবারই প্রিয়পাত্র ছিল। কলেজ ছুটি দিয়ে শোকসভা হয়েছে। ওর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা এখনও চোখে ভাসে। বলাবাহুল্য, সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমি মানবেন্দ্রর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলাম অনেকটা খিসার কারণেই। আইয়ুবের সামরিক শাসনের ওই রুদ্ধশ্বাস দিনে এ ধরনের বিবৃতি দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বৈকি। কয়েক মাস পর মানবেন্দ্রকে মুক্তি দেয়া হয়।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধরত বাঙালিরা চাকমাদের ঢালাওভাবে ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই এই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে ঘটতে থাকে। এটা আমাকে ভীষণভাবে চিন্তিত করে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশবাংলায় ‘চাকমাদের কাছে টানো’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের জাতীয় রাজনীতির শীর্ষস্থানীয়রা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি, জনমিতি ও কৌশলগত গুরুত্বের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে মাথা ঘামানো কখনই প্রয়োজন মনে করেননি। ফলে ১৯৭২-৭৪ সময়কালে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই এই এলাকাটি নিয়ে সংকট দানা বেঁধে ওঠে।

১৯৭৩ সালের নির্বাচনে লারমা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আমরা তার এবং বান্দরবানের সংসদ সদস্য চাই চ রোয়াজাসহ বিরোধী দলের সদস্যদের সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলাম বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে, তখনকার সাপ্তাহিক দেশবাংলা কার্যালয়ে। সেখানে লারমা তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের ভাষাতেই কথা বলেছেন। বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।

’৭৩ সালের শেষ দিকে অথবা ’৭৪ সালের প্রথম দিকে একদিন আমার অফিসে এলেন লারমা ও রোয়াজা। আমার টেবিলের পাশে তাদের দুটি হাতব্যাগ রেখে বললেন, ‘এগুলো থাকল’। তারা প্রায়ই এরকম করতেন। বললাম, ‘এত তাড়া কীসের? চা খেয়ে যাও’। দু’জনই প্রায় সমস্বরে বললেন, ‘শেখ সাহেবের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। বিকালে আসব তখন চা খাব।’ দু’জনের চোখে উৎসাহ-উত্তেজনার ছাপ। বললাম, ‘গুড লাক’! বিকাল চারটা/পাঁচটার দিকে তারা ফিরে আসেন। দু’জনেরই মুখ ভার। বললেন, ‘শেখ সাহেব আমাদের কোন কথা শুনলেন না, বললেন বাঙালি হয়ে যাও’।

লারমার সঙ্গে সেই শেষ দেখা। কিছুদিন পর জানলাম সে শান্তিবাহিনী গঠন করে জঙ্গলে চলে গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় কিছুদিনের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার চাকমা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে অবস্থান নিয়েছে। সেখান থেকে প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত বিদ্রোহীরা বারংবার হানা দিয়েছে আমাদের সীমান্তে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী পড়ে গেল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও শান্তিবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থানের মাঝখানে উভয় সংকটে।

‘শান্তিচুক্তি’ প্রসঙ্গে

১৯৯৭ সালে কথিত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কয়েক মাস আগে আমরা ঢাকায় তিন পার্বত্য জেলার লোকজনের একটা সমাবেশ আয়োজন করেছিলাম। ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে আয়োজিত ওই সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা থেকে প্রায় দুই/তিন হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাকে এতে সভাপতিত্ব করতে হয়েছিল । সমাবেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে একটা সুপারিশনামা তৈরি হয়েছিল। সমাবেশ শেষে মিছিলসহযোগে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদকে সেই সুপারিশসংবলিত একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়। ওতে মূল প্রতিপাদ্য ছিল :

(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জাতি-উপজাতির স্বকীয়তার ‘সাংবিধানিক স্বীকৃতি’ দিতে হবে;

(খ) তিন পার্বত্য জেলাকে দেশের অন্যান্য জেলার সমপর্যায়ে এবং সমমর্যাদায় রাখতে হবে।

পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ি-অপাহাড়ি ভেদরেখা দূর করতে হলে উভয় পক্ষের সচেতন উপলব্ধি ও পরস্পর-নির্ভরশীলতার মনোভাব গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টিকে যেমন ওই এলাকার মানুষের আস্থা অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে, তেমনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকেও বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও কৌশলগত বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই সেদিন তিন পার্বত্য জেলার মানুষকে জড়ো করার চেষ্টা করেছিলাম।

আমার প্রত্যাশা ছিল পাহাড়ি-অপাহাড়ি উভয় পক্ষকে একত্রে বসানো। ওই সময় পাহাড়ি সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় অনেকের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম। কিন্তু তাদের অনেকে কথা দিয়েও সমাবেশের দিন উপস্থিত হননি। সমাবেশে অংশ না নিলেও তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি সমাবেশ দেখতে এসেছিলেন। রাতে যোগাযোগ করলে কয়েকজন আমাকে বলেছিলেন, আরেকবার এ রকম উদ্যোগ নিলে তারা আসবেন।

অপরদিকে এই সমাবেশ যাদের দিয়ে আয়োজন করেছিলাম, তারা যেন সচেতনভাবেই পাহাড়িদের এড়িয়ে কেবল বাঙালিদের নিয়ে সভাস্থলে হাজির হয়েছেন। মনে হল তারা যেন পাহাড়িদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতেই বেশি আগ্রহী, যা আমাকে খুবই মর্মাহত করে। এ জন্য ওই সমাবেশে আমাকে প্রধান করে একটা কমিটি করার প্রস্তাব উঠলে তাতে সম্মত হইনি। সিদ্ধান্ত হয়, পাহাড়ি-বাঙালি উভয় পক্ষের অংশগ্রহণে আরেকটি সমাবেশ করে সেই কমিটি গঠন করা হবে। কিন্তু সেই কাজটি আর হয়নি। আমিও এই উদ্যোগ থেকে সরে যাই। তার কিছুদিন পরেই স্বাক্ষরিত হয় তথাকথিত ‘শান্তিচুক্তি’।    

শান্তিচুক্তি, না চির-অশান্তির বিষবৃক্ষ?

এটা স্পষ্ট যে, সত্তরের দশকে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ হাজার উপজাতীয় জনগণের ভারত গমনের ঘটনাটি আমাদের প্রতিবেশী ভারতীয় পক্ষের প্রত্যক্ষ মদদ ও উৎসাহ ছাড়া ঘটেনি। কিন্তু শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহের মতো এক্ষেত্রেও ভারতীয় পক্ষের এই পদক্ষেপ ছিল আত্মঘাতী। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে যেমন অল্পদিনেই তামিল বিদ্রোহ বুমেরাং হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তেমনি ওই সময় ত্রিপুরা ও মিজোরামে বাংলাদেশের উপজাতীয় বিদ্রোহীদের অবস্থান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ‘সাত বোন’-এর নাজুক অবস্থা আরও নাজুক করে তুলছিল। কথিত ‘জুমল্যান্ড’-এর সমীকরণে বহু পুরাতন ‘অপারেশন ব্রহ্মপুত্র’ নবরূপে আবির্ভাবের রাস্তা তৈরি হচ্ছিল।

সে জন্যই শেষ পর্যন্ত ভারতের নীতিনির্ধারকদের টনক নড়ে এবং শ্রীলংকার মতো এক্ষেত্রেও তারা অ্যাবাউট টার্ন করলেন। নিজ প্রয়োজনেই তারা এটা করেছেন। তারই ফসল ‘শান্তিচুক্তি’।

৫০ হাজার চাকমা শরণার্থীকে ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে ফেরত পাঠিয়ে ভারত তার বালাই দূর করল বটে; কিন্তু বাংলাদেশকে গিলতে হল একটি অবাস্তবায়নযোগ্য চুক্তির আদলে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চির-অশান্তির বিষবৃক্ষ, যা এখন চুক্তি সম্পাদনকারী আওয়ামী লীগ, এমনকি ‘জনসংহতি সমিতি’র জন্যও, গলার কাঁটা; যার বিষময় ফল পাহাড়ি বা বাঙালি কারও জন্যই সুখকর হয়নি।

‘আদিবাসী’ প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা

এ বিষয়টি নিয়ে কয়েক সপ্তাহ আগে এই কাগজেই আমার কিছু মন্তব্য তুলে ধরেছি। বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। এই ভূখণ্ডে যদি কোন জনগোষ্ঠী আদিবাসী, অর্থাৎ সুদূর অতীত থেকে বসবাসের দাবিদার হয়, তাহলে বাঙালি কৃষকই সেই দাবি করতে পারে, আর কেউ নয়। কারণ বাঙালি কৃষক এই ভূখণ্ডের মাটি কামড়ে পড়ে আছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছর।

আসলে কে ‘আদিবাসী’ এটা ‘দাবি’ করার বিষয় নয়, ইতিহাস পর্যালোচনার বিষয়। যারা আদিবাসী তাদের অবশ্যই আদিবাসী বলতে হবে। কিন্তু যেসব জনগোষ্ঠী সাম্প্রতিক কয়েক শতকে এ অঞ্চলে বসবাস করতে এসেছে, তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করার কোন সুযোগ নেই। যদিও তাদের নাগরিক সম-অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য।

কিছু বিদেশী সংস্থা তাদের বৈশ্বিক এজেন্ডার অংশ হিসেবে এখন সারা বিশ্বে ‘আদিবাসী’ ও ‘দলিত’ খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু এনজিও বাংলাদেশেও ‘আদিবাসী’, এমনকি ‘দলিত’ খোঁজার জন্য দূরবিন ও অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে। কিছু পিছিয়ে থাকা মানবগোষ্ঠীকে প্রাগৈতিহাসিক জাদুঘরের বস্তু হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষণীয়। সম্প্রতি সন্তু লারমা তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন। চাকমা সম্প্রদায়ের মতো একটি সুসভ্য জনগোষ্ঠীকে ধনড়ৎরমরহধষ হিসেবে আখ্যায়িত করতে হবে কেন? মং রাজা অং শে প্রু চৌধুরী স্পষ্ট করেই বলেছেন, তার মারমা সম্প্রদায় আদিবাসী নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে কর্মচঞ্চল করে তুলতে হবে

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত সব ক্ষুদ্র জাতি-উপজাতি ও ক্ষুদ্রজাতির প্রধান দাবিই হচ্ছে তাদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের সাংবিধানিক স্বীকৃতি। সেই স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের জাতীয় জীবনের মূলধারায় সন্নিবিষ্ট করার বাস্তবসম্মত কার্যক্রম গ্রহণ করাই ছিল জরুরি। তা না করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের অনুসৃত বিভাজনের নীতির আদলে পার্বত্য জেলাগুলোকে অন্যান্য জেলা থেকে পৃথক সত্তা প্রদানের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, যার ফলে একদিকে ওই এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে অন্যান্য জেলার মানুষকে ওই অঞ্চলে বহিরাগত ও অবাঞ্ছিত বিবেচনা করার পথ করে দেয়া হয়েছে।

বিলম্বে হলেও সম্প্রতি বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ ইস্যুতেও সরকারের অবস্থান ইতিবাচক। তবে আরও আগে, বিশেষ করে ১৯৯৭ এর কথিত শান্তিচুক্তির আগে, উপরে উল্লিখিত সম্মেলনের সুপারিশ যদি কানে তোলা হতো তাহলে সম্ভবত তখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একটা সমাধান বের হয়ে আসত।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ভূ-রাজনৈতিক অখণ্ডতা এবং প্রতিরক্ষার কৌশলগত গুরুত্ব বিচারে এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের জন্য প্রাণ-ভোমরাসদৃশ। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে কোন ধরনের হেলাফেলা করার বা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য দায়িত্বহীন মন্তব্য করার অধিকার কারও নেই। এই অঞ্চলের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে যেমন মূল্য দিতে হবে, তেমনি এই অঞ্চলকে ঘিরে দেশী-বিদেশী কোন মহলকেই পানি ঘোলা করার সুযোগ দেয়া যাবে না। এমনকি এ অঞ্চলের কোন জনসমষ্টিকেও নয়।

সব রাষ্ট্রকেই তার সীমান্ত এবং প্রান্তিক এলাকাগুলোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হয়। ভারত তার অরুণাচল, তেরাই এবং চীন ও পাকিন্তান সীমান্ত বরাবর জনবিরল অঞ্চলগুলোতে জনবসতি বাড়িয়ে সুদৃঢ় সুরক্ষা বলয় তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সামনেও কোন বিকল্প নেই।

তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম সীমান্ত এলাকাগুলোকে পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মচঞ্চল করে তুলতে হবে অতি দ্রুত। সেই উন্নয়নের ধারায় পাহাড়ি জনগণকে, যারা অন্যদের চেয়ে আগে সেখানে বসবাস শুরু করেছে, অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেইসঙ্গে তিন পার্বত্য জেলাকে দেশের অন্যান্য জেলার সমমর্যাদায় রাখতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনবিরল হলেও আয়তনে দেশের এক-দশমাংশ। জাতীয় উন্নয়ন বাজেটে সেই বাস্তবতার প্রতিফলন থাকা আবশ্যক। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এ এলাকার সব সমস্যার নিষ্পত্তি হতে পারে। আর তা হওয়া উচিত কোন বিদেশী এনজিও বা আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়ন ছাড়া, নিজস্ব অর্থায়নে। সে সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত।

লেখক: খ্যাতিমান সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও চেয়ারম্যান, পিডিপি shapshin@gtlbd.com

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশে আদিবাসী বিষয়ে আরো পড়ুন:

পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে

একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী

বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক

আদিবাসী বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ২

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ৩

চাকমা রাজপরিবারের গোপন ইতিহাস

পার্বত্য চট্টগ্রাম, খ্রিস্টান মিশনারি ও বৌদ্ধধর্মের ভবিষ্যৎ-২

পার্বত্য চট্টগ্রাম, খ্রিস্টান মিশনারি ও বৌদ্ধধর্মের ভবিষ্যৎ-৩

বাংলাদেশে তথাকথিত ‘আদিবাসী’ প্রচারণা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রশ্নসাপেক্ষ

Exit mobile version