parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রাম- চাঁদাবাজির অভয়ারণ্য: নিরুপায় জনগণ: অসহায় সরকার

চাঁদাবাজী

আল আমিন ইমরান, গাজী সালাহউদ্দীন

পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেক নাম উপজাতীয় চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। বর্তমানে সশস্ত্র তিন সংগঠনের চাঁদাবাজির প্রতিযোগিতার তাণ্ডবে পাহাড়ের নিরীহ জনগণ চরম দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছে।  যে কারণে আজ পাহাড় অশান্ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা ও জনগণের নিরাপত্তা হুমকির মুখে।  পাহাড় ইতোমধ্যে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।  অথচ, এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে নেই স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের কার্যকর কোন পদক্ষেপ।  বলতে গেলে বর্তমানে পাহাড় সম্পূর্ণ অরক্ষিত।  সরকার ও প্রশাসন সেখানে সম্পূর্ণ অসহায়।

এই অসহায়ত্ব যে কতোটা প্রবল তা বোঝা যায় সরকারী কমকর্তাদের চাঁদা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরী করতে হয়।  তাদের গায়ে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা হাত তুললে বাংলাদেশ সরকার একটি মামলা করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে সক্ষম হয়না।  এর সাম্প্রতিক উদাহরণ নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের লাঞ্ছিত করা।  বাংলাদেশের মানুষের চাঁদার টাকায় চলছে স্বাধীন জুম্মল্যাণ্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।  বিপুল পরিমাণ চাঁদা আয়ের কারণে তারা এতাটা বেপরোয়া হতে পেরেছে।  চাঁদা না দিলে হুমকি, অপহরণ ও খুনের মতো ঘটনা ঘটাতে পাহাড়ী সংগঠনগুলো এতোটুকু দ্বিধা করে না।  একবার অপহরণ করা হলে দাবী করা হয় বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণের টাকা।  পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের সকল ধরণের নিরাপত্তা সংস্থা বিপুল পরিমাণে মোতায়েন থাকলেও এখানে পাহাড়ী সন্ত্রাসী কর্তৃক অপহরণের ঘটনা মুক্তিপণ ছাড়া তাদের মুক্ত করার ঘটনা বিরল।

পার্বত্য রাঙ্গামাটির অনলাইন যোদ্ধাদের সংগৃহীত তথ্যের আলোকে তিন পার্বত্য চাঁদাবাজির একটি তথ্যচিত্র তুলে ধরা হলো:

 গাছ ব্যাবসায়ীদের ওপর দার্যকৃত চাঁদার হার

কোন লোককে গাছের ব্যাবসা করতে হলে তাকে প্রথম রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের ৫,০০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে।  ব্যবসায়ীর নিরাপত্তার জন্য দিতে হবে ২৫,০০০ টাকা।  ব্যবসায়ীর জন্য একজন মিডিয়া থাকবে, তার জন্য চাঁদা দিতে হবে ১৫,০০০ টাকা।  পারমিটের গাছ যখন বাগান থেকে কাটা হবে তখন সেগুন গাছ প্রতি ঘনফুট ৩৫ টাকা ও অন্যান্য গাছের জন্য প্রতি ঘনফুট ২৫ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়।  কাটার পর গাছগুলি যখন সদরে আসে তখন গাছ বহির্গমনের জন্য ট্রাক প্রতি দিতে হবে ১০,০০০ টাকা।

 ফরেস্ট অফিসারদের ওপর ধার্যকৃত চাঁদা  

সরকারী অফিসার হলেও ফরেস্ট অফিসারদের ওপরও চাঁদা ধার্য করেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা।  পারমিটের গাছ চেক করার জন্য কোন অফিসার বাগানে যেতে হলে ফি বাবদ ৪,০০০ টাকা জমা দিতে হবে।  তাছাড়া কোন অফিসার পারমিটের কী পরিমাণ গাছ চেক করবেন, তার জন্য চাঁদা কালেক্টরের লিখিত অনুমতি নিতে হবে।  অনুমতির বাইরে একটি পারমিটও তদন্ত করার ক্ষমতা সরকারি বন বিভাগের কর্মকর্তারা রাখেন না।  অর্থাৎ বন বিভাগের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।  যার প্রমাণ, সম্প্রতি রাঙ্গামাটির তিনজন বন কর্মকর্তাকে চাঁদা বকেয়া পড়ার অপরাধে অপহরণের ঘটনা।

নদীপথে জলযানের ওপর ধার্যকৃত চাঁদার হার

পাহাড়ের নদীপথে চলাচলকৃত যানবাহনের ওপর নির্দিষ্ট হারে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা চাঁদা ধার্য করেছে।  এই ক্ষেত্রে জলযানের ধারণ ক্ষমতা ও ইঞ্জিনের শক্তির ওপর ভিত্তি করে চাঁদার হার ধার্য করা হয়।  প্রতি ঘোড়া ইঞ্জিনের জন্য ১৫০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়।  লঞ্চের ইঞ্জিনগুলো সাধারণত ৫৫ ঘোড়া হয়ে থাকে।  তাই প্রতি লঞ্চকে বাৎসরিক চাঁদা দিতে হয় ৮,২৫০ টাকা।  ইঞ্জিন চালিত বোটগুলি সাধারণত ১০, ১৫, ২২, ২৫ ঘোড়া হয়ে থাকে এবং বাৎসরিক চাঁদা দিতে হয় ৩,০০০ টাকা।

 সড়ক পথে যানবাহনের ওপর ধার্যকৃত চাঁদার হার

পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোন বাস চলাচল করতে হলে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয় ৫,০০০ টাকা।  মালামাল ভর্তি ট্রাক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বহির্গমনের জন্য প্রতি ট্রিপে চাঁদা দিতে হয় ২,০০০ টাকা।  ট্যাক্সি প্রতি ৭০০ টাকা, মোটর সাইকেল প্রতি ২০০ টাকা, চাঁদের গাড়ি প্রতি ৩,০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

 মৎস্য ব্যাবসায়ীদের ওপর ধার্যকৃত চাঁদা

 মাছের ব্যাবসা করতে হলে ব্যবসায়ীদের উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের নিকট সর্বপ্রথম নিজ নামে রেজিস্ট্রেশান নিতে হয়। এই রেজিস্ট্রেশন করতে ব্যবসায়ীকে নিজ নামে এককালীন ১৫,০০০ টাকা জমা দিতে হয়।  বেড় জালের খোপ ও প্রতি বেড়ে মাছ ধরার জন্য বাৎসরিক চাঁদা দিতে হয় ৪৫,০০০ টাকা।  সাধারণ জেলেদের মাছ ধরা নৌকা প্রতি চাঁদার হার বাৎসরিক ১,০০০ টাকা।  মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র হতে মাছ বহির্গমনের জন্য ট্রাক প্রতি চাঁদার হার ২,০০০ টাকা।  এছাড়াও মাছ যারা বর্শিতে ধরে থাকেন তাদের বর্শি প্রতি দেয় চাঁদার হার ১,০০০ টাকা।

 হাট-বাজার ও বাজারজাতকৃত পণ্যে ওপর ধার্যকৃত চাঁদার হার

 পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন হাট-বাজার হতে বাৎসরিক নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করে থাকে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা।  দোকানপিছু মূলধনের ওপর ভিত্তি করে বাৎসরিক ৩০০ থেকে ৫,০০০ টাকা আদায় করা হয়।  এক্ষেত্রে চাঁদা পরিশোধে বাদ যায় না ছোট্ট পানের দোকান মালিকও।  গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস-মুরগীসহ বিভিন্ন শাকসবজি আলু, কলা, বেগুন, কচু; পাহাড়ে উৎপাদিত ফল আনারস, তরমুজ ইত্যাদি পণ্য বিক্রেতাদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা।  বিক্রয়ের জন্য বাজারে আনতে হলে গরু প্রতি ৫০০ টাকা, ছাগল প্রতি ১০০, শুকর প্রতি ২০০ টাকা, মুরগী প্রতি ১০ টাকা, কলার ছড়ি প্রতি ৫ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী, বড় বড় দেশীয় কোম্পানী পার্বত্য এলাকার রাজারে শোরুম করতে হলে তাদের চাঁদা দিতে হবে।  এমনকি মোবাইল কোম্পানীগুলোও এর থেকে মুক্তি পায় না। এসব কোম্পানীর নির্বাহী কর্মকর্তাদের চাঁদা দিয়েই সেখানে চাকরী করতে হয়।

উল্লেখ্য, উপজাতিরা বাঙালি অধ্যুষিত কোন বাজারে গেলে অবশ্যই তার বিনিময়ে অতিরিক্ত চাঁদা দোকান মালিককে পরিশোধ করতে হবে।  কোন কারণে যদি বাঙালি দোকানদার চাঁদা পরিশোধ না করে তবে উপজাতিদের বাজার বয়কট করতে বাধ্য করা হয়।  সম্প্রতি লংগদু উপজেলার ঘনমোড় বাজার ও চাইল্যাতলী বাজারে এমন ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় উপজাতীয়দের বাজার বয়কট করিয়ে জেএসএসপন্থী (সন্তু গ্রুপ) চাঁদা কালেক্টর দুই বাজার কমিটির সভাপতিকে ফোনে জানায় যে, বাজারের দোকান প্রতি যদি ২,০০০ টাকা করে চাঁদা না পরিশোধ করে তবে বাজারে কোন উপজাতি প্রবেশ করবে না।  স্থানীয় বাজার প্রতিনিধিরা বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করেও কোন সুফল পাননি।  পরে বাজার কমিটির লোকেরা স্থানীয় জেএসএস নেতাদের সাথে সমঝোতা করে চাঁদার হার কমিয়ে দোকান প্রতি ১,০০০ টাকা দিয়ে বাজার রক্ষা করে।

 ঠিকাদারদের ওপর ধার্যকৃত চাঁদার হার

পার্বত্য উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র হলো পাহাড়ের ঠিকাদারদের নিকট হতে চাঁদা আদায়।  ঠিকাদারদের কাজের ক্ষেত্র যদি হয় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় তবে ঠিকাদারদেরকে তাদের কাজের মোট বাজেটের ওপর কমপক্ষে ৫% হারে চাঁদা দিতে হবে।  আর কাজের ক্ষেত্র যদি হয় উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকায়, তবে বাধ্যতামূলক কমপক্ষে ১০% হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হবে।  যারা মিস্ত্রি এবং দিনমজুর হিসেবে কাজ করবে তাদেরকেও উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করতে হবে।  টোকেন ব্যতিত কোন ব্যক্তি কাজের জায়গায় প্রবেশ করতে পারবে না।  মিস্ত্রি ও শ্রমিকদের কাজের টোকেন বাবদ ৫০০ থেকে ১,০০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়।

 বাঁশ ও বেত জাতীয় সম্পদের ওপর ধার্যকৃত চাঁদার হার

বাঁশের ব্যবসা করতে হলে ব্যবসায়ীকে সর্বপ্রথম উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের নিকট হতে নিবন্ধন নিতে হবে।  এই নিবন্ধন করতে ব্যবসায়ীকে নিজ নামে অবশ্যই ১৫,০০০ টাকা জমা দিতে হবে।  অন্যথায় সে বাঁশের ব্যবসা করতে পারবে না।  বাঁশের চালি যখন নৌপথে পরিবহন করা হয়, তখন প্রতি হাজার বাঁশের জন্য ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।  ব্যক্তি নিবন্ধিত থাকলেও যদি এই চাঁদা পরিশোধ না করে তবে সন্ত্রাসীরা চালি আটকে রাখে।  বেত জাতীয় সম্পদ পরিবহন করতে গেলে বেত বোঝাই ট্রাক প্রতি ২০,০০০ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়।

 কৃষি জমি এবং বাগানের ওপর ধার্যকৃত চাঁদা

পাহাড়ে কৃষি জমি এবং বিভিন্ন ফলদ ও কাঠ বাগান মালিকদেরকেও বাগানের ওপর নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হয়।  ঢালু কৃষি জমি তথা ধান, তামাক, আলু, বেগুন ইত্যাদি চাষীদের প্রতি বিঘা জমিতে সর্বনিন্ম ৫০০ এবং ফলন ভালো হলে ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। তামাক যখন চুল্লিতে আনা হয় তখন চুল্লি প্রতি ২,০০০ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়।

 যাদের ফলদ ও বিভিন্ন গাছের বাগান রয়েছে তাদেরকেও বড় অংকের চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত এই বাগানগুলো বড় আয়তনের হয়ে থাকে, তথা ৫ একর থেকে শুরু করে ১০০ থেকে ১৫০ একরের হয়ে থাকে। ৫ একর বাগানের জন্য কমপক্ষে ৫০,০০০ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। ৫ একরের চেয়ে বড় বাগান মালিকদের ১,০০,০০০ টাকা হতে ৫,০০,০০০ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়।

 এছাড়াও কোন শ্রমিক (দিন মজুর) পাহাড়ে কাঠ কাটতে গেলে অবশ্যই তাকে বাৎসরিক হিসেবে চাঁদা পরিশোধ করে টোকেন(অনুমতি পত্র) সংগ্রহ করতে হয়।  টোকেন নিতে জন প্রতি ৮০০ টাকা চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। এই অনুমতি পত্র ছাড়া কোন ব্যক্তি পাহাড়ে একটি গাছও ক্রয় এবং কাটতে পারবে না।

 এসকল নির্ধারিত চাঁদার বাইরেও পাহাড়ীদের বিভিন্ন উৎসব ও পার্বত্য আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে আলাদা চাঁদা দিতে হয়ে।

 এক হিসাবে জানা গেছে বার্ষক প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির মাধ্যমে আয় করে থাকে পার্বত্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো।  নেতাদের পকেট ভারী, অস্ত্র কেনা ও সংগঠনের ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি এই চাঁদার একটি বড় অংশ ব্যয় হয় পাহাড়ী সংগঠনগুলোর পক্ষের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম পরিপালনে।  যেকোনো ইস্যুতে পাহাড়ীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের পাহাড়ে নিয়ে আসতে এই টাকা ব্যয় করে থাকে।  ঢাকায় নানা সেমিনার, কর্মসূচীতেও দেয়া হয় এই চাঁদার টাকা।  শুধু বাঙালী নয়, পাহাড়ীরাও এই চাঁদাবাজীর কবল থেকে মুক্ত নয়।  চাঁদা দিয়ে পাহাড়ে বসবাস যেন এখানকার নিয়তি, আইন।  সরকারী ট্যাক্স না দিয়ে পার পাওয়া গেলেও চাঁদা না দিয়ে পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই।  তাই জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে চাঁদাবাজী মুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।

♦ লেখকদ্বয় অললাইন এক্টিভিস্টি ফোরাম ফর চিটাগাং হিল ট্রাক্টস’র নেতৃবৃন্দ।

Exit mobile version