parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে নানা মত: বন্ধ হয়নি খুন-গুম,অপহরণ ও চাঁদাবজি

এইচ এম প্রফুল্ল, ব্যুরো প্রধান, খাগড়াছড়ি:
আগামী ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০তম বর্ষপূর্তি।প্রায় দুই দশকের সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের এই দিনে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর পর কেটে গেছে ২০ বছর। কিন্তু এখনো এ চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের শেষ হয়নি। তবে এবার ঈদুল মিল্লাদুন্নবীর কারণে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে দিনটি পালন করা হচ্ছে।

চুক্তির ২০তম বর্ষপূর্তিকে স্বরণীয় করে রাখতে বর্ষপূতি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‌্যালী,সেমিনার,আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ তিন দিনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।

কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, ২৯ নভেম্বর পৌর শাপলা চত্বরে প্রমাণ্য চিত্র প্রদর্শনী, ৩০ নভেম্বর বিকালে সেমিনার ও ১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৮টায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চত্বরে কেক কাটা ও শান্তির পায়রা উড়িয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় খাগড়াছড়িতে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীরা নিজস্ব পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করবে। শোভাযাত্রাটি জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ খেকে শুরু হয়ে চেঙ্গী স্কোয়ার, শাপলা চত্বর হয়ে টাউন হল প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হবে।

বিকালে চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী অস্ত্র সমর্পনস্থল খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আয়োজন রয়েছে ঐতিহাসিক খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। এতে বাংলাদেশের অন্যতম জীবনমুখী শিল্পী হায়দার হোসেন ও দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল মাইলস’র সাফিন দর্শকদের মাতাবেন।

চুক্তির ২০তম ২০বর্ষপূর্তিতে এসে সরকার পক্ষ বলছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকী ধারা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। জেএসএস’র অভিযোগ,সরকার বাস্তবায়নের পরিবর্তে চুক্তি লংঘন করছে।

অপরদিকে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পাহাড়িদের সশস্ত্র সংগঠনের লড়াইয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড়। চুক্তির পর গত ২০বছরে তিন পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপের অন্তঃদ্বন্দ্বে ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘাতে অন্তত সাড়ে ৬ শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়াও এদের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।

অন্তঃদ্বন্দ্ব ও সংঘাতে অসংখ্য মানুষের হতাহতের ঘটনা পাহাড়ে বাড়িয়ে দিয়েছে উদ্বেগ¦ -উৎকন্ঠা। সংঘাত সহিংসতা মাঝে-মধ্যে পাহাড়ের সম্প্রতির উপরও আঘাত হানছে।

চুক্তির স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফ্রেরুয়ারী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পনের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির সদস্যদেও একাংশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলেও এখনো পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি ফিরে আসেনি।

বরং চুক্তির পর পাহাড়িদের কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস(সন্তু),জেএসএস(এমএন লারমা), ইউপিডিএফ’র আধিপত্য, অতি সম্প্রতি গঠিত ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের লড়াই এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত উভয়ের অন্তত সাড়ে ৬শ শতাধিক নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছে।

সাধারণ উপজাতীয়দের মধ্যেও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। তাদের মতে, চুক্তিতে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং হানাহানি বেড়েছে। মানুষের জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে সাধারন মানুষের মাঝেও রয়েছে ভিন্নমত।

খাগড়াছড়ি স্বনির্ভর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দীপায়ন চাকমা বলেন, চুক্তি নিয়ে মানুষের বহু প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন হতাশ।

খাগড়াছড়ি জেলা কার্বারী এসোসিয়েশনের সভাপতি রণিক ত্রিপুরা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভ্রাতিঘাতি সংঘাত হচ্ছে।

আদিবাসী বাঙালি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি এ অঞ্চলে বসবাসকারী পাহাড়ি-বাঙালি সকল জনগোষ্ঠীর জন্য করা হয়েছে। কাজে দ্রুত চুক্তি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার, পাহাড়ি ও বাঙালি নেতৃবৃন্দের মধ্যে রয়েছে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। সরকার পক্ষ চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেও পাহাড়িরা নেতারা বলছে, সবই মিথ্যা ও বানোয়াট। অপরদিকে বাঙালি সংগঠনগুলো শুরু থেকে এ চুক্তিকে অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করে বাতিলের দাবী জানিয়ে আসছে।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ধারা-উপ-ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন গঠিত হয়েছে। জেলা পরিষদে বিভাগগুলো হস্তান্তরিত হচ্ছে। পুলিশ বিভাগ হস্তান্তর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আসলে চুক্তি বাস্তবায়ন শুধু আক্ষরিক অর্থে দেখলে হবে না, অনুভব করতে হেেব।
তিনি বলেন,

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান,সাবেক সংসদ সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে বিএনপির অবস্থান আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনি আছে।এই চুক্তি জাতিতে-জাতিতে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিভেদ ও বৈষ্যম সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অনেকটা হুমকির মুখে ফেলেছে। এ কারণে কোন সম্প্রদায়ের কাছে এ চুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।তবে সবারই দাবী,হানাহানি বন্ধ হবে ও ফিরে আসবে শান্তি এই প্রত্যাশা পাহাড়ের মানুষের।

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একাংশের(এম এন লারমা) গ্রুপের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিকক পরিষদের অন্যতম সদস্য সাবেক গেরিলা নেতা সুধাসিন্দু খীসা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচারের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করেছেন। বাস্তবায়নের জন্য নয়। বিশ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুম্ম জনগণের বিশ্বাস অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরিণতি কি হবে জানা নেই।

পার্বত্য সমঅধিকার আন্দোলনের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি এডভোকেট আব্দুল মালেক মিন্টু বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পাহাড়ে বৈষম্য ও অশান্তি-হানাহানি বাড়িয়েছে। মানুষের নিরাপত্তা নেই। সর্বত্র চলছে চাঁদাবাজি,খুন,গুম ও অপহরণ পাহাড়ে এখন নিত্য দিনের ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে পাহাড়ের মানুষ শান্তিবাহিনী নামক একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে চাঁদা দিয়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব ছিল। কিন্তু চিত্র পাল্টে গেছে। চুক্তির একে একে চার চারটি পাহাড়ি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।

Exit mobile version