পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে মায়ানমার করিডোর: অর্থনৈতিক সম্ভাবনা না নিরাপত্তার ঝুঁকি?


বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভৌগোলিক, কৌশলগত ও জাতিগত বৈচিত্র্যে ভরপুর এক সংবেদনশীল এলাকা। সাম্প্রতিক সময়ে একটি প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে, যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে মায়ানমারের সঙ্গে সংযোগকারী একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় করিডোর নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। এই করিডোর চীন-মায়ানমার-বাংলাদেশকে সংযুক্ত করে একটি আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্যপথ তৈরি করতে পারে।
তবে প্রশ্ন উঠেছে—এই করিডোর বাংলাদেশের জন্য এক নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে, নাকি জাতীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে?
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক ট্রানজিট হাব হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চাচ্ছে। চীন ও মায়ানমারের সঙ্গে যুক্ত কোনো করিডোর বাস্তবায়িত হলে, তা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বিশেষত বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করতে পারে।
এই করিডোর চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)’-এর একটি অংশ হিসেবে কাজ করতে পারে। চীনের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের দিকে পণ্য পরিবহনের একটি বিকল্প পথ পাবে, যেখানে বাংলাদেশ ট্রানজিট ফি, কাস্টমস রাজস্ব এবং সংশ্লিষ্ট সেবা খাত থেকে আয় করতে পারবে। তাছাড়া এই করিডোরের জন্য নির্মিত অবকাঠামো—যেমন রাস্তা, রেল, ব্রিজ, বিদ্যুৎ লাইন—স্থানীয় জনগণের জীবনমানেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই করিডোর বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজারকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র, যা পর্যটন, হসপিটালিটি ও ট্রান্সপোর্ট খাতেও বিনিয়োগ আনবে। এমনকি পাহাড়ি অঞ্চলের কৃষিপণ্যও সহজে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কিংবা রপ্তানির জন্য বন্দরগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
নিরাপত্তার শঙ্কা
অর্থনৈতিক লাভ যতই সম্ভাবনাময় হোক, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। এই অঞ্চল বহু বছর ধরে বিদ্রোহ, অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর তৎপরতা এবং জাতিগত উত্তেজনার ইতিহাস বহন করে। এখনও কিছু এলাকায় শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এবং বৈধ-অবৈধ অস্ত্রের উপস্থিতি রয়েছে।
এমন একটি এলাকায় আন্তর্জাতিক করিডোর নির্মাণ মানেই সেখানে বিদেশি স্বার্থের অনুপ্রবেশ, গোয়েন্দা কার্যক্রম ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যাওয়া। মায়ানমার ও চীন উভয়ই সামরিক শাসন ও গোয়েন্দা নজরদারিতে কুখ্যাত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এমন রাষ্ট্রগুলোর সরাসরি উপস্থিতি ভবিষ্যতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষ করে মায়ানমার বর্তমানে রোহিঙ্গা সংকট, সশস্ত্র সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে রয়েছে। সে দেশের সঙ্গে স্থল করিডোর খোলার মানে কেবল বৈধ বাণিজ্যই নয়, বরং অবৈধ অস্ত্র, মানবপাচার ও মাদক প্রবাহের ঝুঁকিও বাড়ানো। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ইয়াবা সমস্যায় ভুগছে; এই করিডোর সেই প্রবণতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারে।
স্থানীয় জনগণ ও সাংস্কৃতিক সংকট
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর দাবি যে তারা এই অঞ্চলের বাস্তব মালিক। তাদের আরো দাবি যে, তাঁদের সংস্কৃতি, জীবনধারা ও ভূমির অধিকার বহু বছর ধরে সংকটের মুখে। একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় করিডোর নির্মাণের ফলে জমি অধিগ্রহণ, জবরদখল, জনসংখ্যা পরিবর্তন ও স্থানীয় জীবনে সংস্কৃতিগত আগ্রাসনের আশঙ্কা প্রকট হয়ে ওঠে। উন্নয়নের নামে যদি স্থানীয় জনগণের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, তবে সেটা টেকসই উন্নয়ন নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের সূচনা।
এই প্রকল্পে স্থানীয়দের মতামত, অংশগ্রহণ ও আস্থা অর্জন ছাড়া সামনে এগোনো হবে একরকম রাষ্ট্রীয় ভুল সিদ্ধান্তের প্রয়োগ। এর ফলে সরকার ও পাহাড়ি জনগণের সম্পর্ক আরও ভঙ্গুর হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভারসাম্য
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো মানেই ভারতের সন্দেহ বৃদ্ধি। ভারত বরাবরই চীনের দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে উদ্বিগ্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশেই ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর ও আসাম রাজ্য রয়েছে—যেখানে নিজস্ব বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যাও কম নয়।
করিডোর নির্মাণে চীন ও মায়ানমার জড়িত থাকলে ভারত তা ভালোভাবে নেবে না, ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেও টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ চাইছে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তুলতে। কিন্তু একপাক্ষিক প্রকল্প এই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।
শেষ কথা
মায়ানমার করিডোর একটি বহুমাত্রিক প্রকল্প— যার একদিকে রয়েছে উন্নয়নের হাতছানি, আরেকদিকে নিরাপত্তার ঘনঘটা। করিডোর যদি কেবল কাগজে উন্নয়ন দেখায়, কিন্তু বাস্তবে নিরাপত্তাহীনতা, সংস্কৃতিগত বিপর্যয় ও কূটনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে— তাহলে তার মূল্য বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি হয়ে দাঁড়াবে।
সরকারের উচিত এই প্রস্তাবকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা, স্থানীয় জনগণের পরামর্শ, নিরাপত্তা বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি সুপরিকল্পিত নীতি তৈরি করা। উন্নয়ন হোক, তবে সেটা যেন হয় শান্তি, অংশগ্রহণ ও স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়— আমরা কী অর্থনৈতিক গতি খুঁজে পেতে গিয়ে পাহাড়ি আগ্নেয়গিরিতে পা ফেলছি না তো? নাকি বিচক্ষণতা দিয়ে আমরা গড়তে পারি এক নতুন আশার করিডোর— যেখানে অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও সম্মান তিনটিই পাশাপাশি পথ চলবে।