পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ কল্পনা চাকমা অপহরণ নাটক!

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামে পান থেকে চুন খসলেই তার জন্য সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কমন ট্রেন্ড-এ পরিণত হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। জাতির অধিকারের দোহাই দিয়ে প্রতিনিয়ত পাহাড়ে অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণ খুন, গুমসহ রাষ্ট্র ভাগ করার গভীর ষড়যন্ত্র মেতে আছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এসব নিয়ে একটি বিশেষ সচেতন মহল বরাবরই রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ! অথচ ১৯৯৬ সালে নিখোঁজ হওয়া কল্পনা চাকমা নামে জনৈক উপজাতি নারীকে নিয়ে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে তাদের অপপ্রচারের কমতি নেই আজও। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে জানা দরকার, কে এই কল্পনা চাকমা?

কল্পনা চাকমা, পিতা- গুণরঞ্জন চাকমা, মাতা- বাঁধুনি চাকমা। গুণরঞ্জনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে কল্পনা চাকমা সবার ছোট। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার লাল্যাঘোনা এলাকায় তার জন্ম৷ সে ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা পিসিজেএসএস (তৎকালীন শান্তিবাহিনী) এর সহযোগী অঙ্গ সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন (HWF) বাঘাইছড়ি শাখা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা।

দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসীদের সহযোগী সংগঠনে কাজ করার সুবাদে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে বসবাসরত অরুণ বিকাশ চাকমার সঙ্গে। অরুণ বিকাশ পিসিজেএসএস এর ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (PCP)’র সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো বলেও একাধিক সূত্রের তথ্য থেকে জানা যায়। অরুনের সাথে প্রেমের বিষয়টি কল্পনা চাকমার পরিবার যেমন মানতে পারেননি ঠিক তেমনি দলীয় অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়া পিসিজেএসএস এর একটি অংশও সেটা মানতে পারেনি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রক্তপিপাসু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎকালীন শান্তিবাহিনীর নেতা সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সূদুরপ্রসারী নানা ধরণের ষড়যন্ত্রের ছক কষে আসছিলো। কল্পনা চাকমা অপহরনের সাজানো নাটক তেমনই একটা ষড়যন্ত্রের অংশ। তার উদ্দেশ্য ছিলো ভবিষ্যতেও যেন সে কল্পনা চাকমা ইস্যুকে পুঁজি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসবাদ কায়েম ও নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত রাখাসহ রাষ্ট্র এবং প্রশাসনকে বিপাকে ফেলতে পারে।

১৯৯৬ সালের ১১ জুন গভীর রাতে অতি সঙ্গোপনে পিসিপির কতিপয় সন্ত্রাসীরা রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা এলাকা থেকে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে স্বজাতির প্রেমিক অরুণ বিকাশ চাকমার কাছে ভারতের অরুণাচলে পাঠিয়ে দেয়। কারণ, তৎকালীন শান্তিবাহিনী ১৯৯৬ এর সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি জেলায় নিজস্ব প্রার্থী হিসেবে তাদের অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ী গণপরিষদের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য বিজয় কেতন চাকমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায়। তার পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), পাহাড়ী গণপরিষদ (পিজিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) কে নির্দেশনা প্রদান করে তারা।

কিন্তু কল্পনা চাকমা এইচডব্লিউএফ-এর নেত্রী হয়েও আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রচার কাজ চালাচ্ছিলেন। এতে করে শান্তিবাহিনীর সমর্থক পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ নির্বাচনে তাদের প্রার্থীর জয়লাভে শঙ্কিত হয়ে তাদের পথের কাঁটা কল্পনা চাকমাকে সরিয়ে ফেলার জন্য এই অপহরণ করে। এরপর সন্তু লারমার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তার অনুসারী সন্ত্রাসীরা কল্পনা চাকমা অপহরণের দায়ভার সেনাবাহিনীর উপর চাপিয়ে দেয়। সেই থেকে উপজাতি সন্ত্রাসীরা কল্পনা চাকমা ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে আসছে।

উল্লেখ্য, পার্বত্য চুক্তির আগেও শান্তিবাহিনী তথা পিসিজেএসএস এর অন্তর্কোন্দলের কারণে তাদের মধ্যে দুইটি গ্রুপ ছিলো। এমএন লারমা গ্রুপ ও প্রীতি গ্রুপ। ঐ দুই গ্রুপের অন্তর্কোন্দলের জের ধরে ১৯৮৩ সালে শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হত্যা করা হয়। উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও উপজাতিদের অনেকেই মনে করেন এমএন লারমা জুম্ম জাতির অভিভাবক বা পিতা।

অথচ তাদের সেই অভিভাবককে হত্যার ৩৭টি বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কোন মামলা কিংবা হত্যাকাণ্ড নিয়ে আন্দোলন করেননি কেউ! এমএন লারমা হত্যাকাণ্ড নিয়ে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের নীরবতা রহস্যজনক নয় কি? কেন অখ্যাত কল্পনা চাকমাকে নিয়ে তাদের চেতনা জেগে উঠলো? এর উত্তর অতি সহজ- কল্পনা চাকমা ইস্যুকে জিইয়ে রেখে রাষ্ট্র, প্রশাসন আর সেনাবাহিনীকে বেকায়দায় ফেলতেই তাদের এই অপকৌশল। কল্পনা চাকমাকে নিজেরাই অপহরণ করে সেনাবাহিনীর উপর কাল্পনিক মিথ্যাচার করেছে সন্ত্রাসীরা।

বহুদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার পাঁয়তারা করে আসছে উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তথা কথিত জুম্ম জাতির অভিভাবক এমএন লারমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনী গঠিত হয়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি সার্বভৌম দেশে স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে এমএন লারমার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়াটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত ছিলো তা বিচারের ভার আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম?

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের নিবিড় তত্ত্বাবধানে যখন রাষ্ট্র গোছানোর কাজ চলছিলো ঠিক তখনই অস্ত্র হাতে নিয়ে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর ন্যাক্কারজনক হামলা শুরু করে বসে! অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর হামলাই তো প্রমাণ করে দেয় যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তারা বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি।

বরং তারা স্বায়ত্তশাসনের দাবী তুলে সাম্প্রদায়িক বীজ বপন ও বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে জুম্মল্যান্ড নামক নতুন রাষ্ট্র গঠন করার পাঁয়তারা করতে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালি ও সেনাবাহিনীর উপর! অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন, গুম চালিয়ে পার্বত্য জনজীবন দূর্বিষহ করে তোলে তারা। কিন্তু সন্ত্রাসের রাজ্য কায়েম করতে উপজাতি ঐ সন্ত্রাসীদের পথের প্রধান বাঁধা ছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আর তাই সন্ত্রাসীদের স্লোগান ছিলো একটাই- ‘পাহাড় থেকে সেনা হটাও‘।

আর সেই লক্ষ্যে তারা পার্বত্য চূক্তির ঠিক আগ দিয়ে রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতার অংশ হিসেবে ১৯৯৬ সালের ১১ জুন কল্পনা চাকমা অপহরণের কাল্পনিক নাটক মঞ্চস্থ করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় ও দেশ-বিদেশে সেনাবাহিনীর দুর্নাম রটানো শুরু করে।

শান্তিবাহিনীর তৎকালীন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ কারোরই অজানা নয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারী আদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। জননিরাপত্তার স্বার্থে আর পাহাড়ে সন্ত্রাস মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর অপারেশনের মুখে টিকতে না পেরে সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ সন্ত্রাসীরা ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নীল নকশা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কল্পনা চাকমার কাল্পনিক অপহরণ নাটক রচনা করে। কল্পনা চাকমা অপহরণের নাটক যে সাজানো, মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ছিলো তা তৎকালীন সংবাদমাধ্যমগুলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বরাত দিয়ে প্রকাশ করেছিলো।

এমনকি কল্পনা চাকমার মা জানান, অপহরণের পর কল্পনা চাকমার সঙ্গে দুইবার যোগাযোগ হয়েছিলো তাঁর। সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, কল্পনা চাকমা সেনাবাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়নি। বরং সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে স্বজাতি অর্থাৎ নিজ দলীয় সংগঠন কর্তৃক কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছিল সেইদিন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কল্পনা চাকমা কেন এরপর দেশে ফিরে আসেনি? দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে ভারতের অরুণাচলে স্বামী অরুণ বিকাশ চাকমার সাথে বসবাসরত কল্পনা চাকমার কাছে চিঠি লিখেছিলেন একজন সরকারের সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি। কল্পনা চাকমা ফিরতি চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে তাকে জানান যে, তিনি দেশে ফিরতে আগ্রহী। কিন্তু দেশে ফিরলে তাকে পাহাড়ী সন্ত্রাসী কর্তৃক হত্যা করা হতে পারে। তাই তিনি স্বামী অরুণ বিকাশ চাকমার সাথে ভারতে আত্নগোপনে থাকতেই আগ্রহী।

কল্পনা চাকমার কন্টাক্ট ট্রেসিং করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার তার পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ টেস্ট করার জন্য অনুরোধ করা হলেও তার পরিবার বারবার ডিএনএ টেস্ট করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। মূলত কল্পনা চাকমার অবস্থান সনাক্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নির্দেশেই তার পরিবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, কল্পনা চাকমার অপহরণ একটি সাজানো নাটক।

পার্বত্য চুক্তির পরে সন্তু লারমার দল জেএসএস কল্পনা চাকমা অপহরণ ইস্যুর আন্দোলন থেকে নিজেদের অনেকটা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কারণ তারা অনেকেই নিজস্ব সংগঠন পিসিপি কর্তৃক কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণের  প্রকৃত সত্য জানে। তারা এইটাও জানে যে, সেনাবাহিনী কর্তৃক কল্পনাকে অপহরণ বা তুলে নিয়ে যাওয়া হয়নি।

নিজেদের অন্তঃকোন্দল এবং সংগঠনের লোক দ্বারাই প্রেমঘটিত কারণ ও ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কল্পনা চাকমাকে নিজেদের লোকেরাই অপহরণ করেছিলো। কিন্তু সন্তু লারমার জেএসএস ভেঙে আত্মপ্রকাশ করা ইউপিডিএফ প্রসিত বিকাশের সন্ত্রাসী গ্রুপ বিষয়টিকে ইচ্ছে করে এখনো জিইয়ে রেখেছে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কৌশল হিসেবে।

মিথ্যাচার করে রাষ্ট্র, প্রশাসন আর সেনাবাহিনীকে বেকায়দা ফেলতে তৎপর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একটি মিথ্যা সাজানো কল্পকাহিনী আর কতকাল এইভাবে চলতে থাকবে?

লেখক: রাঙামাটি থেকে

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কল্পনা চাকমা, কল্পনা চাকমা অপহরণ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন