parbattanews

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে: সন্তু লারমা

নিজস্ব প্রতিনিধি:

পার্বত্য চুক্তি পূর্নাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বাস্তব ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে হুঁশিযারী দিলেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা।

তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন সরকারকে করতেই হবে। চুক্তির পূর্বে আমরা দীর্ঘ দুই দশক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছি। চুক্তির পরেও ২০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে থামানোর জন্য শাসক শ্রেণি অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু জুম্ম জনগণ যেকোন মূল্যে শাসকদের সে উদ্দেশ্যকে সফল হতে দিবেনা।

সোমবার (৪ ডিসেম্বর) মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর এবং নতুন প্রজন্মের ভাবনা শীর্ষক এক আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এসব কথা বলেন।

এসময় সন্তু লারমা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য আজ থেকে ২০ বছর আগে যে চুক্তি হয়েছিল সেটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সেখানকার সমস্যা আজো মেটেনি। বিভিন্ন সরকারের আমলে চুক্তির বিপক্ষে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সেগুলোর কারণে আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে চরম অস্থিশীলতা কাজ করছে। পাহাড়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে পিছনে যাওয়ার আর জয়াগা নেই। আজকের নতুন প্রজন্ম পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছেন যা পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

পাবর্ত চুক্তি বাস্তবায়নে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ১০ দফার ভিত্তিতে যে অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছে সেটি অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি জানান। পাশাপাশি তিনি দেশের সুশীল সমাজসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

তিনি বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে আরো বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নেই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি করলেও তারাও এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক নয়।

আলোচনা সভায় প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা।

আলোচনায় নতুন প্রজন্মের সাথে সাথে যেসব প্রবীনরাও তাদের ভাবনাগুলো তুলে ধরেন তারা হলেন, সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল্লাহ আল ক্বাফি রতন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি; সাংবাদিক নজরুল কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুমন মারমা, সাংবাদিক শাকিল আহমেদ, সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা, বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরাম এর  সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রা ত্রিপুরা প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, “চুক্তি বাস্তবায়ন চেয়ে বড় ধরনের হতাশা হচ্ছে- চুক্তি বাস্তবায়ন না হলেও সেটা বাস্তবায়ন হয়েছে বলে প্রচার চালানো। সরকার প্রতিনিয়তই সেই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুমন মারমা বলেন, “সরকার প্রচার করছে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। যারা চুক্তি পড়েননি বা পড়ে পুরোপুরি বোঝেননি, তারা হয়ত ভাববেন চুক্তি বাস্তবায়ন হয়ে গেছে অনেকটা। কিন্তু চুক্তি পড়ে দেখলে সেটা উল্টোই মনে হবে।”

পাহাড়িদের রাজনৈতিক অধিকার হরণের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “চুক্তির মাধ্যমে আগে যে অধিকার ছিল না, সেগুলো ভোগ করার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় চুক্তি হলেও সেটার বাস্তবায়ন নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে। আজকেও রাঙামাটির পুরো জনগোষ্ঠীকে বাঙালি বলে অভিহিত করা হচ্ছে।”

কাপেং ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর এবং নতুন প্রজন্মের ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্যে সন্তু লারমা সরকারকে হুঁশিয়ারও করেন।

“সরকার, শাসক গোষ্ঠী, নীতি-নির্ধারকরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে চলে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও অস্থিতিশীল। পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, এখন পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। যদি কিছু করতে হয়, সামনের দিকেই এগিয়ে যেতে হবে।

“আমরা এমন পর্যায়ে এসেছি, হয়ত অন্য দেশে চলে যেতে হবে, না হয় এখানে থেকে অস্তিত্ব বিলীন হতে হবে। কিন্তু জুম্ম জনগণ সেটা হতে দেবে না। অন্ধকার, অনিশ্চিত ভবিষ্যত ও দমন-পীড়ন বন্ধের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে যাবে।” প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা।

“বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল, কেউ তো সরকারকে চাপ সৃষ্টি করার জন্য, পাহাড়িদের মুক্তির জন্য কোনো কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসেন না। যখন দেখা হয় অনেক কথাই বলি, আলোচনায় অংশ নেন। কিন্তু দলগতভাবে তো কেউ এগিয়ে আসেন না।”

আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংবাদিক নজরুল কবীর বলেন, “আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো দলই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের মুক্তি দিতে পারে না। কারণ তার শ্রেণি চরিত্র সেটা বলে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি শ্রেণিহীন সমাজের কথা বলেছিল। দীর্ঘ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় আসা চুক্তির বাস্তবায়নে এখন বড় রকমের রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসেছে।”

সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল্লাহ আল ক্বাফি রতন সরকারের উদ্দেশে বলেন, “এক উপনিবেশিকতার মধ্যে আছে পার্বত্য এলাকা। চারশ’র মতো ছোট-বড় সেনাক্যাম্প আছে। শান্তি যদি প্রতিষ্ঠা করতেই হয়, তাহলে আপনি সেনাক্যাম্প রাখছেন কেন?”

চুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে পাহাড়ি অধিকারকর্মীদের ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানান সিপিবি নেতা।

ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মানবেন্দ্র দেব বলেন, চুক্তির পরও পাহাড়ে নিপীড়ন কমেনি। উল্টো প্রতিবাদ কমে গেছে।

“চুক্তির আগে যখন পাহাড়িদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হত, নির্যাতন চালানো হত, ধর্ষণ করা হত, তখন আদিবাসীরা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতেন। আর এখন সেই রকম হলে প্রতিরোধ হচ্ছে না, একটা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হবে কি না, সেটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তার মানে চুক্তি বাস্তবায়ন না হলেও লড়াইয়ের শক্তিটা নষ্ট হয়েছে এর মাধ্যমে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, “সরকারের ‍উপর দায়িত্ব বর্তায়, সরকার তার দেশের কোনো জনগোষ্ঠীর উপর বৈষম্য করবে না। বৈষম্য যেহেতু চলছে, সেহেতু দ্রুততম সময়ে চুক্তির বাস্তবায়নের জন্য এখন উদ্যোগ নিতে হবে।”

জনসংহতি সমিতির হুঁশিয়ারির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কেবল সশস্ত্র সংগ্রামে যেতে হবে, এমন নয়। কোন কোন জায়গায় চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি, সেটা চিহ্নিত করে লিডারশিপ নেটওয়ার্ক তৈরি এবং বুদ্ধিভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়ে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।”

আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।

 

Exit mobile version