পার্বত্য বাঙালিদের বঞ্চনা: একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা

fec-image

দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় ভ্রমণ নিয়ে লিখব লিখব বলে ভাবছিলাম। অবশেষে আজকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসলাম। আমার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে। আমার এলাকাতে রাঙ্গামাটির একজন চাকমা বন্ধু আছে। তার নাম নিশান চাকমা। চাকরির সুবাদে সে রাঙ্গামাটি থেকে ময়মনসিংহ এসেছে। কথা বলতে বলতে কিছুদিনের মধ্যেই তার সাথে ভালো একটা বন্দুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরপর দুজন দুজনের মধ্যে কত কথা, কত কিছু শেয়ার। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমন এবং পাহাড় সম্পর্কে জানার ইচ্ছা আমার আগে থেকেই একটা আগ্রহ ছিল। তাকে কাছে পেয়ে তার থেকে অনেক জানলাম। তার কথা শুনে মনে হলো পাহাড়ে বসবাসরত  উপজাতিরা আসলেই সেখানে বাঙ্গালীদের দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়িত। বাঙ্গালীরা তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের ভূমি দখল করছে। তার কথা শুনে আমার  করুণা হলো সেইখানকার উপজাতিদের জন্য। কারণ কিছুদিন পরপর বিভিন্ন মিডিয়াতেও দেখতাম সেখানকার বাঙ্গালীরা তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তা দেখে আমিও সত্য মনে করতাম। মনে মনে সেখানকার বাঙ্গালীদের ওপর আমার ঘৃনা জন্ম হলো।

যাই হোক বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়েরর জন্য আমার চাকমা বন্ধুর সাথে পাহাড় ভ্রমনের উদ্যেশ্যে ময়মনসিংহ থেকে রাংগামাটি পার্বত্য জেলার পথে রওয়ানা হলাম। কিন্তু পাহাড়ের মাটিতে পা রেখে বাস্তবে যা দেখলাম তা সব উল্টো। যেটা লিখে আপনাদেরকে বুঝানো যাবেনা। সেখানে গিয়ে বুঝলাম যে, কারা বৈষম্য এবং নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। সেখানে প্রত্যক্ষভাবে দেখলাম যে পাহাড়ের উপজাতিরা বাংলাদেশের অন্যসব জেলার মানুষের চেয়ে অনেক উন্নতভাবে জীবন যাপন করছে। শিক্ষা, চাকুরী, ব্যবসায়-বানিজ্যে সর্বক্ষেত্রে তারা বাঙ্গালীর চেয়ে বহুগুনে প্রতিষ্ঠিত এবং অগ্রগামী।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের মধ্যে হাজার হাজার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সেনা অফিসার, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত রয়েছে। বিপরীত দিকে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙ্গালীরা শতগুনে পিছিয়ে আছে। লক্ষ করে দেখলাম যে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৮ম শ্রেণী পাস বেকার একজন উপজাতীয় যুবকও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ, বিপরীত দিকে একই অঞ্চলে বসবাসরত হাজার হাজার বাঙ্গালী যুবক বেকার হয়ে দেশ ও অর্থনীতির বোঝা হয়ে রয়েছে। অগ্রাধিকারের নামে একচেটিয়া উপজাতীয় অদক্ষ যুবক নিয়োগের ফলে বঞ্চিত হচ্ছে বাঙ্গালী শিক্ষিত যুবকেরা। শুধু তাই নয়, যত দূর যাই ততই দেখি অত্র অঞ্চলে উপজাতিরা সংঘাত, সংঘর্ষ, বাঙ্গালী নিধন ও চাঁদাবাজির মহোৎসব চালাচ্ছে।

আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কি রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এখানে উপজাতি সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন দলের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে প্রায় প্রতিদিনই নিরীহ লোকজন খুন হচ্ছে। মূলত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এ মরণ খেলায় মেতে উঠেছে। বাঙ্গালী নিধন প্রশ্নে আবার তারা এক হয়ে কাজ করে।

গত বছরের শীত মৌসুমে হানিফ পরিবহনে চড়ে রাজশাহী হতে পাহাড়ে ভ্রমণ করতে আসা একদল পর্যটকের উপর উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউপিডিএফ চাঁদার জন্য খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কের নানিয়ারচর এলাকায় গুলিবর্ষণ করে। গাড়ির চালক দক্ষ হওয়ার কারণে প্রাণে বেঁচে যায় পর্যটকবাহী ৩টি গাড়ি। তবে পাহাড়ে ভ্রমণে এসে একটা বিষয় বুঝতে পারলাম যে দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারছে না। আর কেন পারছেনা তাও বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর কাছে বিরাট এক প্রশ্ন??

পাহাড়ে প্রতিনিয়ত উপজাতি সন্ত্রাসী কর্তৃক খুন, গুম, অপহরণের কারনে ঐ অঞ্চলের নিরীহ উপজাতি এবং বাঙ্গালীরাকে সারাক্ষন আতংকের মধ্যে থাকতে হয়। এইতো গত কিছুদিন আগেও খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা থেকে চাঁদার জন্য তিন জন বাঙ্গালীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা, সেই অপহৃত  ব্যক্তিদের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। বিগত কয়েক বছর আগেও খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে সাদিকুল ইসলাম নামে এক বাঙ্গালী যুবক ও রাঙ্গামাটি জেলার লংগদুতে নয়ন নামে আরেক বাঙ্গালী যুবককে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা।

এই ঘটনায় যখন শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে মাঠে নামে এলাকাবাসী ঠিক তখনই ঐ ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে উপজাতি সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ঘরবাড়ি আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। দুঃখজনক হচ্ছে কিছু মিডিয়া খবর প্রচার করে বাঙ্গালীরাই হামলা করেছে। অথচ সঠিক চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। উপজাতীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিজেরাই তাদের ঘরে আগুন দিয়েছে। তথাকথিত শান্তিবাহিনীর নামে এ যাবত প্রায় ৩০ হাজার নিরীহ বাঙ্গালীকে হত্যা করেছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। কয়েক হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। বছরে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে প্রতিনিয়ত সেখানকার জনগনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে।

এই অঞ্চলের পাহাড়ি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো চাপ প্রয়োগ করার মাধ্যমে যে কোন প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া পাহাড়ি যুবকদের নিয়োগ দিতে বাধ্য করছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠন জন সংহতি সমিতি (জেএসএস), (ইউপিডিএফ) ও তার অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে চাকুরীরত পার্বত্য বাঙ্গালী কর্মকর্তা কর্মচারী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একদিকে সরকারের তরফ থেকে দেয়া উপজাতি অগ্রাধিকার কোঠা, অন্যদিকে আঞ্চলিক পরিষদের চাপ, প্রয়োজনে তাদের অস্ত্রের ব্যবহারে চলছে প্রতিনিয়ত সুবিধা আদায়ের কৌশল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণ করে আমার যে বাস্তব অভিজ্ঞতাটা হলো সেটা হলো আমরা সমতলের অন্যসব জেলার মানুষ মিডিয়া এবং এখানে চাকরি করতে আসা উপজাতিদের থেকে যা জানছি আসলে পাহাড়ে তার উল্টোটাই ঘটছে। একমাত্র তাদের মিথ্যা প্রচার প্রচারন কারনে সমতলের অন্য মানুষের মনে সেখানের বাঙ্গালীর প্রতি আমার মত ঘৃনা জন্ম নিচ্ছে।


পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গাইড লাইন


যখনই পাহাড়ে ঘুরতে বেরিয়েছি তখনই মনের মধ্যে একটা চাপা আতংক ছিল না জানি কখন অপহরণ হতে হয়। তার কারন পাহাড়ে খুন, গুম অপহরণ এইগুলি নিত্যদিনের ঘটনা। এর আগেও পাহাড়ে বেড়াতে এসে অনেক পর্যটক পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের নিকট অপহরণের শিকার হয়েছিল। আমি একজন সমতলের বাসিন্দা হয়ে পাহাড়ের উপজাতি ভাইদের নিকট জানতে চাই– আপনারা স্বাধীন ভাবে যেভাবে বাংলাদেশের অন্যসব জেলাতে ঘুরে বেড়ান সেভাবে আমরা কেন অপরুপ  সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে গিয়ে বেড়াতে পারবনা??  কেন আমাদেরকে জেএসএস-ইউপিডিএফ নামের পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অপহরণ আর চাঁদাবাজির শিকার হতে হবে?? পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশের বাহিরে নাকি যে সেখানে জেএসএস-ইউপিডিএফ এর অনুমতি নিয়ে আর চাঁদা দিয়ে বেড়াতে যেতে হবে?

আমি সমতলের একজন বাসিন্দা হয়ে পাহাড়ের উপজাতি ভাইদের উদ্যেশ্যে একটা কথা বলতে চাই যে- আপনারা এক হয়ে জেএসএস-ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান। সমতল থেকে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া কোন পর্যটকের ওপর আর যদি পাহাড়ি সন্ত্রাসী দল কর্তৃক ছিনতাই, অপহরণ এসব করা হয় তাহলে সমতলে বসবাসরত উপজাতিদেরকেও তার ফল ভোগ করতে হবে। সেই দিন আর বেশি দেরি নেয়। মনে রাখবেন, আমরা সমতলের মানুষেরা যদি স্বাধীনভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘুরতে যেতে না পারি তাহলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরাও ঢাকাসহ সারাদেশের সমতল জেলাগুলোতে থাকতে পারবে না। আর যদি পাহাড়ে কোন পর্যটকের উপর হামলা হয় তাহলে দেশের সমতলের যে কোন জেলাতেও পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা শান্তিতে থাকতে পারবে না। তাই সময় থাকতে ‘সাধু সাবধান’।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন