পার্বত্য বাঙালিরা কেন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিরোধিতা করছে?


অবশেষে রাঙামাটির সচেতন ছাত্র জনতা নামক সংগঠনের হরতালের হুমকির মুখে স্থগিত হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বৈঠক। আগামী ১৯ অক্টোবর ২০২৫ তারিখ রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ কার্যালয়ে ‘ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন’ এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন ধার্য করা হয়েছিল। এদিকে এই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বৈঠক বাতিল না করলে পালিত হবে হরতালসহ কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল রাঙামাটির সচেতন ছাত্র-জনতা নামের একটি সংগঠন। বৃহস্পতিবার (১৬অক্টোবর) সকালে একটিব্যক্তিগত মালিকানাধীন রেস্তোঁরায় সংবাদ সম্মেললন করে এমন তথ্য জানান রাঙামাটির সচেতন ছাত্র-জনতা। রাঙামাটির বৈঠক স্থান পরিবর্তন করে সুকৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলা এবং খাগড়াছড়ি জেলায়ও এ কমিশন বৈঠক করতে চাইলে সেইসব জেলাও একই কর্মসূচি প্রদান করা হবে। বৈঠক দিন রোববার (১৯ অক্টোবর) সারা দিনব্যাপি রাঙামাটি শহরের প্রতিটি মোড়ে দেশপ্রেমিক ছাত্র- জনতা অবস্থান নিবে বলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জানান। তবে তাদের আট দফা দাবি পূরণ করা হলে সকল প্রকার কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হবে।
উল্লেখ্য, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে রাঙ্গামাটি জেলায় সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে বান্দরবানে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ (পিসিএনপি) কর্তৃক প্রতিবাদ কর্মসূচী ও কোরাম সংকটের কারণে স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত কমিশনের কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। , –
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়। উক্ত কমিশনকে আইনী কাঠামো দেয়ার জন্য ১৭ জুলাই ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এই কমিশনকে কার্যক্রম চালাতে দেয়নি শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএস ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো। তারা কমিশনের সকল বৈঠক বয়কট ও কার্যক্রম প্রতিরোধের জন্য একেরপর এক কর্মসূচি দিতে থাকে। তাদের দাবী, শান্তিচুক্তির একটি অলিখিত রূপ ছিলো। অর্থাৎ শান্তিচুক্তির লিখিত রূপের পাশাপাশি শেখ হাসিনার কিছু মৌখিক অঙ্গীকার ছিলো। সেগুলো বাস্তবায়নসহ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আইন সংশোধন করে তাদের দাবী মেনে নতুন আইন না করা পর্যন্ত তারা এই কমিশন বয়কট করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন উপজাতি কুচক্রী মহলের ইন্ধনে ও পাহাড়ী সুশীল সমাজের আপত্তির কারণে উক্ত আইন সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬ সংসদে পাশ হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে উক্ত আইনের বিধিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়, যা অদ্যাবধি চূড়ান্ত করা হয়নি।
গত ১৭ জুলাই ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ পাস হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পিসিজেএসএস সভাপতি সন্ত্ত লারমা,চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়সহ অন্যান্য কুচক্রী মহল উক্ত আইন সংশোধনের জন্য বামপন্থী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে তদবির ও চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে। ফলশ্রুতিতে উক্ত আইনের সংশোধন প্রস্তাব ২০১৩ সালে মন্ত্রীসভায় পাস হয় এবং সংসদে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ঘটনার এ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট মহল কর্তৃক উক্ত আইন সংশোধনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ধ্বংসাত্বক পরিণতি সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করা হলে সরকার উক্ত আইনটি সংসদে পাস করা হতে বিরত থাকে এবং তা পুনঃমূল্যায়নের জন্য মন্ত্রীসভায় ফেরত পাঠায়। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক সংশোধনী প্রস্তাব প্রদান করা হয়।
পাহাড়ী সুশীল সমাজ ও বিশেষ কুচক্রী মহলের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬’’ গত ১ লা আগস্ট ২০১৬ তারিখে মন্ত্রীসভায় পাস হয়, পরবর্তীতে গত ৮ আগস্ট ২০১৬ তারিখে জাতীয় সংসদে আইন আকারে পাশ করা হয়। রহস্যজনকভাবে মাত্র ১২ ঘণ্টা পার হওয়ার পূর্বেই ০৯ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ অধ্যাদেশ আকারে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬ এ বিভিন্ন বিতর্কিত ধারা ও স্পর্শকাতর আইনসমূহ সন্নিবেশিত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
সংশোধিত আইনের ধারা ৫ এর (ক) অনুযায়ী, পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কমিশন প্রদত্ত আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের আইনের মাধ্যমে মূলত হেডম্যান, কার্বারী ও সার্কেল চীফদের ব্যক্তিগত মতামত এবং সিদ্ধান্তকে বোঝানো হয়। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে হেডম্যান ও কার্বারী, সার্কেল চীফ, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের মতামত ও সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে প্রতিষ্ঠিত হবে। তারা সবাই উপজাতি এবং একচেটিয়াভাবে উপজাতিদের স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে কাজ করবে বিধায় খুব সহজে বাঙালীদের বসত-ভিটা ও জায়গা-জমি হতে উচ্ছেদ করার সুযোগ পাবে।
আইনের ধারা ৫ এর (গ) অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে জলেভাসা ভূমিসহ (Fringe Land) কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা বেদখল করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং বন্দোবস্তজনিত বা বেদখলজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল; তবে, শর্ত থাকে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং বসতবাড়ীসহ জলেভাসা ভূমি, টিলা ও পাহাড় ব্যতীত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ও বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকার ক্ষেত্রে এই উপ-ধারা প্রযোজ্য হইবে না।’’ এর ফলে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি ব্যতীত অদ্যাবধি বরাদ্দকৃত সকল বন্দোবস্ত অবৈধ ঘোষণা করে জলেভাসা জমিসহ সকল অবৈধ বন্দোবস্তকৃত জমি পূর্বের মালিককে পুনর্দখল এর অধিকার প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, কমিশন ইতিপূর্বে সরকার প্রদত্ত যে কোন বন্দোবস্ত অবৈধ ঘোষণা করতে পারবে। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি বন্দোবস্ত ও পূর্ব থেকে বসবাসরত বাঙালীদের নিজেদের জমির উপর অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরী হবে। এই আইনের মাধ্যমে বাঙালীদের এবং সরকারী অধিগ্রহণকৃত ভূমির কর্তৃত্ব উপজাতীদের হাতে চলে যাবে। যার ফলশ্রুতিতে পাহাড়ী ও বাঙালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ/দাঙ্গা সৃষ্টির ক্ষেত্র উন্মোচন হবে।
২০০১ সালের প্রণীত আইনে উল্লিখিত ‘‘চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে’’ শব্দগুলির পরিবর্তে, ২০১৬ এর সংশোধনীতে ‘‘চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে’’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত করা হয়। এর ফলে চেয়ারম্যানের বিচারিক ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত’কে অবদমিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতি সদস্যের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হওয়ার মত অযৌক্তিক আইন সন্নিবেশিত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ৯ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জন উপজাতি এবং ২ জন সম্ভাব্য বাঙালী। পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালী হলেও কমিশনে পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালীদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। সংশোধনী অনুযায়ী চেয়ারম্যানসহ কমিশনের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত কমিশনের গৃহীত সিদ্ধান্ত হবে বিধায় উপজাতি সদস্যদের মতামতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। ফলশ্রুতিতে, বাঙালীদের ন্যায্য দাবীর পক্ষে সিদ্ধান্ত পাওয়া প্রায় অসম্ভব হবে এবং বাঙালীদের উচ্ছেদের হুমকিসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/স্থাপনা উচ্ছেদের সম্ভাবনা তৈরী হবে।
এছাড়াও, জমি সংক্রান্ত বেশিরভাগ বিরোধের সাথে বাঙালী জনগোষ্ঠী জড়িত থাকলেও কমিশনে কোন বাঙালী প্রতিনিধি নেই। শান্তিচুক্তির পূর্বে অনেক উপজাতি ভারতে যাওয়ার পূর্বে তাদের জায়গা জমি বাঙালীদের নিকট বিক্রি করে যায়। পরবর্তী শান্তি চুক্তির পর তারা প্রত্যাবর্তন করে এবং বিভিন্ন মহলের ইন্ধনে সরকারী খাস জমিসহ তাদের বিক্রিত জমিও অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের বলে দাবি করে। এমতাবস্থায় এ ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে এবং কমিশন কর্তৃক নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উক্ত কমিশনে বাঙালী প্রতিনিধির উপস্থিতি প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনার অন্যতম অংশীদার জেলা প্রশাসকগণকে উক্ত কমিশনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা
সংশোধনীর ধারা ৮ এর (৩) এ বলা হয়েছে, কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার প্রদানক্রমে স্থায়ী অধিবাসীদেরকে নিয়োগ করা হইবে। এ আইন প্রয়োগের ফলে কমিশনের সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য উপজাতীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হবে। ফলশ্রুতিতে বাঙালীরা কমিশনের দাপ্তরিক কার্যক্রমে হয়রানিসহ অন্যান্য নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৬ জারী হবার পর বিচারপতি (অব.) মো. আনোয়ারুল হক এর নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখ হতে ৪৫ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরোধপূর্ণ ভূমির ব্যাপারে দরখাস্ত আহবান করেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে সময়ের বাধ্যবাধকতা রহিত করা হয়। অদ্যাবধি কমিশন বরাবর মোট ২২৯৭০টি (খাগড়াছড়ি-৭,৯০৮, রাঙ্গামাটি-৯,৯২৪ ও বান্দরবান-৫,১৫৮) আবেদন জমা পড়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৫৭৪ জন বাঙালী এবং অবশিষ্ট ২২,৩৯৬ জন এর সবাই উপজাতি। উপজাতিদের অভিযোগ/আবেদন ৯৭.৫০% ও বাঙালীদের ২.৫০%। উল্লেখ্য, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ ও পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সহিংসতার কারণে প্রায় এক লক্ষ লোক ভোগ দখলকৃত জমি ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়, যাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক পরিবার উক্ত এলাকায় বসবাসরত বাঙালীদের নিকট তাদের বসতভিটা ও জমি বিক্রয় করে দিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পরে ভারত প্রত্যাগত উপজাতি শরণার্থীসহ অন্যান্য উপজাতিরা কুচক্রী মহল ও উপজাতি নেতৃবৃন্দের ইন্ধনে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে গণহারে অভিযোগ/আবেদন করায় এবং অন্যদিকে বিদ্যমান কমিশনের উপর বাঙালীদের আস্থা না থাকায় উপজাতিদের আবেদন/অভিযোগের পরিমাণ বাঙ্গালীদের চাইতে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বিগত সময়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও পাহাড়ী কুচক্রী মহলের ইন্ধনে জেএসএস (সন্তু গ্রুপ) এর সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক জরিপকারীদের অপহরণসহ বিভিন্ন বাঁধার মুখে জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেনি। অদ্যাবধি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের ক্ষেত্রে জেএসএস (সন্তু) সহ আঞ্চলিক দলগুলোর বিরোধিতা অব্যহত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শান্তিচুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ০২ নং ধারা অনুযায়ী উপজাতীয় শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসন এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির পূর্বে ভূমি জরিপ করার বিষয়ে উপজাতি নেতৃবৃন্দ সম্মত নয়। এছাড়াও পাহাড়ী সুশীল সমাজ ও আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের দাবী উক্ত ভূমি জরিপ কার্যক্রম ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয় বরং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণত তিন শ্রেণীর জমি রয়েছে যেমন, ব্যক্তি মালিকানা, সরকারী খাস জমি ও বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন/নেতৃবৃন্দ সরকারী খাস জমি ও বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভূমিসহ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিজেদের ভূমি বলে মনে করে এবং এ লক্ষ্যে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি (Customary Laws) অনুযায়ী ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি প্রত্যাশা করে; যা বাংলাদেশের প্রচলিত ভূমি আইন ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩ জন সার্কেল চীফ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯০০ অনুযায়ী সরকারের ভূমি রাজস্ব আদায় করার জন্য নিযুক্ত হলেও সময়ের পরিক্রমায় তারা নিজেদের কথিত ‘রাজা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভূমি সমস্যার সমাধান হলে সার্কেল চীফদের এ ধরনের প্রভাব- প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার আশংকা থেকে তারাও ভূমি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে আগ্রহী নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে (Cadastral Survey) না হওয়ায় ভূমির পর্যাপ্ত তথ্য যেমন, মোট জমির পরিমান, খাস জমির পরিমাণ, আবাদী জমির পরিমাণ, জমির শ্রেণীকরণ, দাগ নম্বর, নকশা অনুযায়ী জমি চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি তথ্য নেই। ফলে ভূমি সমস্যা দিন দিন জটিল হচ্ছে ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের (পাহাড়ি-বাঙালী উভয়) নিজস্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রতীয়মান। ফলে কমিশন এর কার্যক্রম শুরুর পূর্বে কমিশনের তত্ত্বাবধানে ভূমি জরিপ প্রয়োজন।
বিদ্যমান আইন ও কমিশনের গঠন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন এবং ভূমি কমিশনের কার্যক্রম শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির উপর উপজাতীয়দের একক আধিপত্য স্থাপিত হবে বলে প্রতীয়মান। পাহাড়ী কুচক্রী মহল ও শীর্ষস্থানীয় উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ভূমি সমস্যাকে ইস্যু করে আঞ্চলিক রাজনীতি করে থাকে। ভূমি সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে তাদের ফায়দা গ্রহণ করার সুযোগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভূমি জরিপ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬ পুণঃসংশোধনের উদ্যোগ নেয়া এবং শুধুমাত্র পুনঃসংশোধনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন ও কমিশনের কার্যক্রম শুরু করা সমীচিন হবে। এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনার অন্যতম অংশীদার জেলা প্রশাসকগণকে উক্ত কমিশনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এর গঠন সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালীসহ সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি অন্তর্ভূক্তকরণের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রয়োগের পূর্বে ভূমি জরিপ (Cadastral Survey) সম্পন্ন করতঃ পার্বত্য এলাকায় কতটুকু জমি রয়েছে, সরকারী খাস জমির পরিমাণ কত, অবৈধ দখলকৃত জমির পরিমাণ কত তা চিহি্কত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রচলিত ভূমি আইনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি করা। অপরদিকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য উপজাতিদের অগ্রাধিকার দিলে বাঙালীদের বঞ্চিত হওয়া এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্টের সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায় কমিশনে কর্মকর্তা/কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা অর্থাৎ পাহাড়ী ও বাঙালী উভয় সম্প্রদায়’কে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
আহমেদ বুলবুল: পার্বত্য গবেষক।

















