পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন নিয়ে বাঙালিরা শঙ্কিত কেন?

fec-image

গত ২৭ নভেম্বর রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউজে এক বৈঠক শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক জানান, আগামী ২৩ ডিসেম্বর থেকে কমিশনের শুনানি করা হবে। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি বাঙালিরা উপজাতীয় প্রাধান্য বিশিষ্ট ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এবং কমিশন আইনের উপর আস্থা রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ভূমি কমিশনে পার্বত্য বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধি নেই। চেয়ারম্যান সুপ্রিমকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি; এছাড়া সদস্য হিসেবে আছেন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান (উপজাতীয় এবং অনির্বাচিত), সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান (উপজাতীয় এবং অনির্বাচিত), সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফ (উপজাতীয় এবং অনির্বাচিত) এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বা তার প্রতিনিধি (সরকারের প্রতিনিধি, যিনি বাঙালি বা উপজাতীয় যে কেউ হতে পারেন)। কমিশনের সচিব এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই উপজাতীয়দের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ পাবেন।

কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করা বাঙালিদের ভূমির অধিকারে বিশ্বাস করেন না, বরং সমতলের অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে তাদের পুনর্বাসনের দাবিতে জোরালো আন্দোলন করে যাচ্ছেন তিনি। ভূমি কমিশনে তার কাছ থেকে নিরেপক্ষ ভূমিকা আশা করা যায় না। অপরদিকে সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সার্কেল চিফ আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেন বা করবেন তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। প্রথাগত আইন, রীতি ও পদ্ধতির দোহাই দিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সার্কেল চিফ যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা কোনোভাবেই খণ্ডানোর সুযোগ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সরকারের প্রতিনিধির থাকবে এমন নিশ্চয়তা নেই। এত কিছুর পরও আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের দাবি মেনে ২০০১ সালের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধন করে বাঙালিদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার পথকে আরো সঙ্কীর্ণ করে ফেলা হয়েছে। তাই নিজেদের ভূমির অধিকার হারানোর ভয় পার্বত্য বাঙালিদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরা নতুন করে তাদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলনে নেমেছে। নানা বিষয়ে ভিন্ন মত থাকলেও বাঙালিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে আন্দোলন শুরু করেছে। ফলে যেকোন সময় পার্বত্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হচ্ছে ভূমি বিরোধ। আর এ সমস্যাটি বাঙালিদের  জন্য জটিলতর হয়ে উঠেছে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা সন্তু লারমার চাহিদা মতো ‘পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ সংশোধনের কারণে। ২০১৬ সালেল ১ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের ১৪টি সংশোধনী অনুমোদন করার এক সপ্তাহ পর ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাক্ষরিত হয়েছে; আশঙ্কা করা হচ্ছে, সংশোধিত আইনে ভূমি কমিশনের নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের হাতে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের ভূমিহীন করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে যাবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা। আর কমিশনকে ব্যবহার করে সন্তু লারমা কোনো বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করলেও কোনো আইন-আদালতে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। কেননা, ভূমি কমিশন আইনের ১৬ নং অনুচ্ছেদেই বলা আছে যে, ‘ধারা ৬(১)-এ বর্ণিত কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী বলিয়া গণ্য হইবে, তবে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা বা যথার্থতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’

গত ১ আগস্ট ২০১৬ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬’ চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে। বৈঠক শেষে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের সংবাদ ব্রিফিং এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে পরদিন ২ আগস্ট জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ১৪টি সংশোধনীর অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। আর সংসদ যেহেতু দুই মাস পরে বসবে, তাই জরুরি বিবেচনায় এটাকে অধ্যাদেশ আকারে জারির সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের ফলে পার্বত্য বাঙালিদের উদ্বেগের মূল কারণটি স্পষ্ট হয়েছে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে দেওয়া মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘১৯৮৭ সালে পার্বত্যাঞ্চলের এসব দেশদ্রোহীরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলো পুরো বাংলাদেশ দু’টি ভাগে ভাগ করার। এক ভাগের নাম বাংলাদেশ, যার রাজধানী ঢাকা। আর এক ভাগের নাম হবে জুম্মল্যান্ড, যার রাজধানী রাঙাগামাটি। এই দু’টি অংশ মিলে একটি ফেডারেল সরকার হবে। তখন আমরা রাজি হইনি। কিন্তু বর্তমান এই ভূমি আইন বাস্তবায়নের ফলে দেশদ্রোহীদের সেই সপ্ন বাস্তবায়ন হবে।’

ভূমি কমিশন: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ভূমিবিরোধ সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য একটি ল্যান্ড কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ৪, ৫ ও ৬ ধারা মতে, ৩ জুন ১৯৯৯ ল্যান্ড কমিশন গঠন করে। এরপর সরকার ২০০১ সালের ৫৩ নং আইন তথা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ পাস করে। এই আইনটিতেই পার্বত্য বাঙালিদের ভূমির অধিকার খর্ব করার যাবতীয় ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু এতে সন্তু লারমার একক কর্তৃত্ব করার সুযোগ কিছুটা কম থাকায় তিনি নাখোশ হন। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর ব্যাপারে আপত্তি তোলে সংশোধনের দাবি জানায়। তারা সরকারের পাসকৃত আইনের ২০টি ধারার বিপরীতে আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে প্রথমে ১৯ দফা সুপারিশ প্রেরণ করেন। পরবর্তী সময়ে সুপারিশ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩-এ। আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশ সমূহকে উদ্দেশ্য অনুসারে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত করতে পারি। প্রথমত, এমন কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে এগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূমির উপর পার্বত্য বাঙালিদের অধিকারকে খর্ব করে উপজাতীয়দের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। দ্বিতীয়ত, অবশিষ্ট সুপারিশগুলো করা হয়েছে, যাতে ভূমি কমিশনের ওপর থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে আঞ্চলিক পরিষদ তথা জেএসএসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে যে ১৪টি সংশোধনী গ্রহণ করেছে তাতে জেএসএসের উভয়বিদ সিদ্ধান্তই হাসিল হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সভায় বারবার ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী: ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ পাসের পর থেকে সরকারের নানা পর্যায়ে এ আইন সংশোধন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। একাধিকবার মন্ত্রিপরিষদ সভাতেও আইনটির সংশোধনী উত্থাপিত হয়েছে, এমনকি উত্থাপিত সংশোধনী পাসের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। গত ৩০ জুলাই ২০১২ মন্ত্রিপরিষদ সভা ভূমি কমিশন আইনের ১৩টি সংশোধনী পাসের জন্য অনুমোদন দিয়েছিল, কিন্তু তা কার্যকর করা যায়নি। এরপর ২০১৩ সালের ২৭ মে মন্ত্রিপরিষদ সভা ভূমি কমিশন আইনে আগের গৃহীত ১৩টি থেকে কমিয়ে ৬টি সংশোধনী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, যা সংসদের মাধ্যমে পাস করার কথা ছিল। কিন্তু সেটিও শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি। এরপর বেশকিছু দিন নীরব থেকে হঠাৎ করেই ২০১৬ সালে ১৪টি সংশোধনী অনুমোদন করেছে মন্ত্রিপরিষদ। আর সংসদ বসতে দুই মাস বিলম্ব থাকায় তখন তড়িগড়ি করে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস, সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের বিবেচনা: গত ৮ মে ২০১৬ রাজধানীর বেইলী রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ সংশোধনের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘২০০১ সালে আমরা যে আইনটা করেছিলাম, সেখানে তারা (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা সন্তু লারমা) কিছু সংশোধন চেয়েছেন। সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে যতটুকু করা সম্ভব, সেটা আমরা করে দেব।’ প্রধানমন্ত্রীর সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে আইন সংশোধনের সেই আশ্বাস ১ আগস্ট ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভায় কতটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়া অমূলক হবে না। কারণ এর আগে মন্ত্রিপরিষদ সভায় প্রথম দফায় ১৩টি এবং পরে ৬টি সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পরেও সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নেই তা কার্যকর করা যায়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, আগে যেসব সংশোধনী দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে কার্যকর করা যায়নি, কোন বিবেচনায় সেসব সংশোধনী সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে মান উতীর্ণ হয়ে গেল? তাছাড়া, সংসদ বসতে দুই মাসের বিলম্বের কারণে তড়িগড়ি করে এটিকে অধ্যাদেশ আকারে জারির সিদ্ধান্তটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। ধারণা করা যায়, কোনো একটি পক্ষের এ ব্যাপারে অতিউৎসাহী মনোভাবের কারণেই সংসদকে পাশকাটানো হয়েছে।

তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেও যার বা যাদের পরামর্শে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ সংশোধন করা হয়েছে, তারা সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের প্রতি কতটা অনুগত তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের পর ১৯৯৯ সালের ১২ মে সন্তু লারমা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি একই পদে তিনি বহাল আছেন। রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছেন। অথচ আজ পর্যন্ত তিনি কোনো দিন এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনারে গিয়েছেন বলে শোনা যায় না। তাছাড়া, সন্তু লারমার দল পার্বত্য জনসংহতি সমিতি সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিয়মিতই অংশ নেয় এবং তাতে জয় লাভও করে। অথচ দলটির প্রধান সন্তু লারমা আজ পর্যন্ত এদেশের নাগরিকত্বের প্রতীক জাতীয় পরিচয়পত্রটি পর্যন্ত গ্রহণ করতে সম্মত হননি। রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেও এতটা ধৃষ্টতা যিনি দেখাতে পারেন, সেই তারই পরামর্শে ‘পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ সংশোধন করার পরিণতি কী হতে পারে তা অনুমান করে দেশবাসীর মনে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়াটা কি অমূলক?

ভূমিকমিশন আইনের কিছু সংশোধনীর পর্যালোচনা: পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ-এর অনুচ্ছেদ ২ অনুযায়ী, আইনের (২০০১ সালের ৫৩ নম্বর আইন) তৃতীয় অনুচ্ছেদে ‘পার্বত্য জেলাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য জনসংহতি সমিতির’-এর স্থলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। জেএসএস আন্দোলন শুরু করেছিল স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। তাদের সেই আকাক্সক্ষা তারা কখনই পরিত্যাগ করেনি। যা বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্য, আচার-আচরণ থেকে প্রমাণিত। সরকারের সাথে চুক্তি করার সময় যেহেতু স্বাধীন দেশের দাবি তোলা অপ্রাসঙ্গিক ছিল, তাই তারা প্রথমে ফেডারেল রাষ্ট্র এবং পরে স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিল। কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতায় সরকার এ দাবি মেনে না নেয়ায় তারা সংবিধানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেই চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে। তাই বলে তাদের মনের সুপ্ত আকাক্সক্ষার কথা ভুলে যায়নি। সে কারণে পার্বত্য চুক্তির শুরুতেই পার্বত্যাঞ্চলের পরিচয়কে তারা ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো থেকে পার্বত্যাঞ্চলকে পৃথক করে ফেলা। যাতে ধীরে ধীরে এই স্বতন্ত্র পরিচয়টাকেই বড় করে তাদের পুরনো উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ই এই বিষয়টির ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলোকপাত করেছিলেন। কিন্তু সরকার তখন এর প্রতি দৃষ্টিপাত করেনি। বোঝা যায়, সরকার এর ভয়াবহতা সম্পর্কে এখনো পুরোপুরি সচেতন নয়। যা ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনীর দুই নং প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমেও প্রমাণিত। সরকার উদাসীন থাকলেও জেএসএস তাদের লক্ষ্যে যে অবিচল এখানে সেটাই স্পষ্ট। যার ফলে তারা ‘পার্বত্য জেলাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র স্থলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপনের দাবি আদায় করেছে। ‘জেলা’ বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ তাই এই শব্দটি জেএসএস মানতে পারেনি। তাদের প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে এই অঞ্চলের নতুন একটি পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা, তারা সেটি করতে পেরেছে। আর আমাদের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বোঝেই হোক কিংবা না বোঝেই হোক এই প্রস্তাব গ্রহণ করায় জেএসএসের উদ্দেশ্যপূরণে সহায়ক হয়েছে। এই একটি সংশোধনীর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেই অপর প্রস্তাবগুলোর উদ্দেশ্যও বোঝা সম্ভব। কেননা প্রতিটি প্রস্তাবই এসেছে জেএসএসের কাছ থেকে। আর তারা যে, এসব প্রস্তাব তাদের মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখেই দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সংশোধনীর ৫নং অনুচ্ছেদ (ক) দফায় বলা হয়েছে, ২০০১ সালের ৫৩নং আইনের ধারা ৬ এর দফা (ক) ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা;’ এর স্থলে ‘পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা;’ প্রতিস্থাপিত হবে।
সংশোধনীর ৫নং অনুচ্ছেদ (খ) দফায় বলা হয়েছে, ২০০১ সালের ৫৩নং আইনের ধারা ৬ এর দফা (খ) ‘আবেদনে উল্লিখিত ভূমিতে আবেদনকারী বা ক্ষেত্রমত সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং প্রয়োজনবোধে দখল পুনর্বহাল;’ এর ‘আইন ও রীতি’র স্থলে ‘আইন, রীতি ও পদ্ধতি’ প্রতিস্থাপিত হবে।

২০০১ সালের আইনের ৬ অনুচ্ছেদের (ক) এবং (খ) দফা সংশোধন করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী’ শব্দাবলির স্থলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী’ বিরোধ মীমাংসা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি’ বলতে আসলে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা কি কারো কাছে আছে? আমরা আসলে জানি না, তা ছাড়া সরকারের কাছে এর ব্যাখ্যা থাকার কথাও না। কারণ সংশোধনীর ৫নং অনুচ্ছেদের (ক) দফাতেই অবৈধ বন্দোবস্ত জমির প্রসঙ্গ এসেছে। এর অর্থ হলো সরকার অবৈধভাবে কাউকে না কাউকে জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে! বিষয়টি কি আসলে তাই? রাষ্ট্রের আইনেই বৈধ কিংবা অবৈধতা নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখছি ভিন্ন বিষয়। সরকারের কর্মকাণ্ডকে অবৈধ বলে ঘোষণা করারও বিধান আছে! কিন্তু সেই বিধানটি আসলে কী, এর প্রয়োগকারীই বা কারা? সেটা এখানে বোঝার কোনো উপায় নেই।

সংশোধনীর ৫নং অনুচ্ছেদ (গ) দফায় বলা হয়েছে, ২০০১ সালের ৫৩নং আইনের ধারা ৬ এর দফা (গ) ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন বহির্ভূতভাবে কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল:
তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীনে অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং রক্ষিত (Reserved) বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন শিল্প কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এই উপ-ধারা প্রযোজ্য হইবে না।’ এর পরিবর্তে
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে জলেভাসা ভূমিসহ(ঋৎরহমব খধহফ) কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা বেদখল করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং বন্দোবস্তজনিত বা বেদখলজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল:
তবে শর্ত থাকে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং বসতবাড়ীসহ জলেভাসা ভূমি, টিলা ও পাহাড় ব্যতীত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ও বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকার ক্ষেত্রে এই উপ-ধারা প্রযোজ্য হইবে না।’ প্রতিস্থাপিত হবে।
মূল আইনের ধারা ৬(১)(গ) এর শেষের শর্তাংশে রক্ষিত বনাঞ্চল এই আইনের আওতামুক্ত ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের সংশোধীনতে সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর অংশ (রিজার্ভ ফরেস্ট বা রক্ষিত বনাঞ্চল) আঞ্চলিক পরিষদের খবরদারির আওতায় চলে গেল। অথচ, এই রিজার্ভ ফরেস্ট বা রক্ষিত বনাঞ্চল, যা ব্রিটিশ আমল থেকেই সরকারের সম্পত্তি ছিল। শান্তি চুক্তিতেও রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর সরকারের কর্তৃত্ব বহাল রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখানে তা বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। কারণটা কী? রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক শুধু সরকার নয়, মূল মালিক এই দেশের ১৮ কোটি জনগণ। অতএব, তাদের সম্পদ অন্যকারো হাতে ছেড়ে দেয়ার ব্যাখ্যা জানার অধিকার দেশের জনগণের আছে।

সংশোধনীর ৬ (গ) দফাতে বলা হয়েছে- ৭(৫) ধারায় ‘চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে ৬(১) বর্ণিত বিষয়াদিসহ এর এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে’-এর স্থলে ‘চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ৬(১)-এ বর্ণিত বিষয়াদিসহ এর এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।’ এ প্রস্তাবে কমিশনের চেয়ারম্যানের ক্ষমতাকে খর্ব করে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের স্বেচ্ছাচারিতার নিকট ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কারণ চেয়ারম্যানসহ পাঁচজনকে নিয়ে কমিশন। এর মধ্যে তিনজনই উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ। অপরজন সরকারি কর্মকর্তা। এই অবস্থায় অধিকাংশের মতামত কোন দিকে যাবে সেটা নিশ্চিত হয়েই আছে।

সংশোধনীর ৭ (খ) দফা অনুযায়ী, ২০০১ সালের আইনের ৯ অনুচ্ছেদ আংশিক সংশোধীত হয়ে ৯ (১) নং অনুচ্ছেদ হিসেবে সংখ্যায়িত হবে এবং এর সাথে ৯(২) অনুচ্ছেদ হিসেবে ‘কমিশন কর্তৃক উক্ত আবেদন নিষ্পত্তির পূর্বে যে কোন সময়ে ন্যায় বিচারের স্বার্থে, কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে তাঁহার আবেদন একবার সংশোধন করিতে পারিবে।’ এ সংশোধনীর মর্মার্থ হলো, ইতিপূর্বে দেখা গেছে ভূমি কমিশনে উপজাতীয়রা যেসব আবেদন করেছে তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন এবং অযৌক্তিক। তাই সেসব বাতিল হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন আবেদন সংশোধনের সুযোগ দেওয়ায় ফলে দেখা যাবে আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে পড়েছে, তখনই তারা আবেদন সংশোধন করে বিষয়টি জিইয়ে রেখে জমিটি হস্তগত করার চেষ্টা চালাতে পারবেন।
সংশোধনীর ৮নং দফায় বলা হয়েছে- ধারা ১৩(২)-এর পরে নতুন উপধারা ১৩(৩) নিম্ন বর্ণিতভাবে সন্নিবেশিত হবে: ‘কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার প্রদানক্রমে স্থায়ী অধিবাসীদেরকে নিয়োগ করা যাইবে।’ ভূমিকমিশনের অধিকাংশ সদস্য উপজাতীয়, অন্যদিকে পার্বত্য বাঙালিদের পক্ষ থেকে কোনো সদস্য সেখানে নেই। তার উপর কমিশনের সচিবসহ সকল পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা, কর্মচারীও যদি উপজাতীয় হন তাহলে সেই কমিশন থেকে পার্বত্য বাঙালিরা সুবিচার আশা করতে পারে-এটা কি ভাবা যায়?

বাঙালিদের ভূমি এবং ভোটাধিকার হরণ: পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৪নং ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্যগণ জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে এই আইন ও বিধি অনুযায়ী নির্বাচিত হইবেন।’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ভোটার তালিকা প্রয়োজন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যাতে জটিলতা সৃষ্টি করা যায়, সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যই পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ৯নং ধারার ৪নং উপ-ধারায় কোনো ব্যক্তির ভোটার হওয়ার ব্যাপারে একটি বিতর্কিত এবং সংবিধান পরিপন্থী শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই উপধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি তিনি পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হন।’ যা পরে ১৯৯৮ সালে জেলা পরিষদ আইনসমূহ সংশোধন করে ১৭নং ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার অ-উপজাতীয়দের ক্ষেত্রে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়ে পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা বলিতে- যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যাহার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলায় সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণত বসবাস করেন তাহাকে বুঝাইবে।

অর্থাৎ পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ভোটার হতে হলে বৈধ জমির মালিক হতে হবে। কিন্তু বাঙালিরা যাতে বৈধ জায়গা সম্পত্তির মালিক হতে না পারে সে জন্যও সকল পদক্ষেপ নিয়ে রাখা হয়েছে। যেমন- খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিক্রয় বা অন্যান্যভাবে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদকে অবহিত করে বা জেলা পরিষদের অনুমতি নেয়াকে শর্ত করে দেয়ায় বাঙালিদের ভূমির মালিক হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। উপরন্তু ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনকে সংশোধন করে মূলত আঞ্চলিক পরিষদের হাতকেই শক্তিশালী করা হয়েছে।

আসলে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের উদ্দেশ্য সরকারে নিকট যাই থাকুক উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে এর উদ্দেশ্য পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের ভূমিহীন করা। কেননা, পার্বত্য বাঙালিদো বড় একটি অংশকে ভূমিহীন করতে পারলে সংবিধান পরিপন্থীভাবে (পার্বত্য জেলা পষিদ আইনের ক্ষমতা বলে) তাদের ভোটাধিকার হরণ করা যাবে। আর সেটা সম্ভব হলে বাঙালিরা পার্বত্যাঞ্চলে ভূমির অধিকার, ভোটাধিকার হারিয়ে এক সময় হতাশ হতে বাধ্য হবে। আর মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এসব মানুষ হয়তো পার্বত্যাঞ্চল ছেড়ে যেতে শুরু করবে। এ প্রক্রিয়ায় ক্রমান্বয়ে বাঙালির সংখ্যা কমতে থাকলে তারা পার্বত্যাঞ্চলে জাতিসংঘের উপস্থিতিতে পূর্বতিমূরের মতো স্বাধীনতার দাবিতে গণভোটের আয়োজন করবেন। সে ভোটের ফলাফল কোন দিকে যাবে তা-তো আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকছে। অতএব, পরিণতিটা সহজেই অনুমেয়।

ভূমি কমিশন আইন সংশোধন, আদিবাসী স্বীকৃতি আদায়, জেলা পরিষদের মাধ্যমে পুলিশের উপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের প্রচেষ্টাসহ পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিটি পদেক্ষেপই নিচ্ছে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। ভূমিকমিশন আইন সংশোধনীর প্রতিটি প্রস্তাবই তাদের সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যই আনা হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্টরা যদি এসব বুঝতে অপারগ হয়, তাহলে এর দায় শুধু তাদের ওপর বর্তাবে তা নয়, বরং এদেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককেই ভবিষ্যতের কাঠগড়ায় এর খেসারত দিতে হবে। অতএব, সময় থাকতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির নামে কোনো মহল যেন বাঙালিদের ভূমিহীন করার সুযোগ পেয়ে না যায় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাছাড়া পার্বত্য বাঙালিদের আস্থায় নেওয়ার জন্য কমিশনে তাদের প্রতিনিধি কীভাবে রাখা যায় সেটিও বিবেচনায় নেয়া দরকার। কমিশনের সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও উভয় সম্প্রদায় থেকে সমহারে লোক নিয়োগ দিলে পারস্পারিক বোঝাপড়া সহজ হতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ওপার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক

[email protected]

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা:

শান্তিচুক্তির ২২ বছর: পার্বত্য চট্টগ্রামে গুম খুন চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না কেন?

দুই যুগেও হয়নি পাকুয়াখালী গণহত্যার বিচার

পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন ও দীপংকর তালুকদারের বক্তব্য

এটা স্বাধীনতার অপমান

মাটির পাহাড়ের বিমান বন্দর হবে না!

পর্যটন পরিকল্পনার লক্ষ্য হোক সাজেক থেকে সেন্টমার্টিন

পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃশংস গণহত্যা পাকুয়াখালী ট্রাজেডি

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেই নিহিত আছে পার্বত্য ভূমি সমস্যার সমাধান

ভূমি কমিশন আইন: পার্বত্যাঞ্চল থেকে বাঙালি উচ্ছেদের হাতিয়ার

পার্বত্য সংকট ও রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ প্রসঙ্গ

পার্বত্য চট্টগ্রামে অপ্রতিরুদ্ধ খ্রিস্টান মিশনারীরা

পার্বত্যাঞ্চলে সাধারণ মানুষের উচ্চ শিক্ষার পথ রুদ্ধ করার পাঁয়তারা

পার্বত্য চুক্তিতে জাতিগত বৈষম্যসমূহ

পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গাইড লাইন

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী বাসিন্দা সনদ বিতর্ক অবসানের উপায়

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান, ভূমি কমিশন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন