পাহাড়ের সংগ্রামী দুই দরিদ্র মেধাবীর গল্প

fec-image

৪ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে মো. আশরাফুল ইসলাম। মা ছিলো একমাত্র আশার আলো। তবে মায়ের আয়ে পড়াশোনার খরচ চলছিল না তার। টিউশনই একমাত্র ভরসা ছিল আশরাফুলের। এভাবে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই জোগাড় করে সদ্য প্রকাশিত উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় গুইমারা সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে আশরাফুল।

আশরাফুলের বাড়ি মাটিরাঙ্গা উপজেলার খেদাছড়া এলাকায়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি পেয়েছে। খেদাছড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি তোও পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলো।

সংগ্রামী এই কিশোরের মা পেয়ারা বেগম বলেন, ছেলে অনেক কষ্ট করে এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে। এতে খুশি হয়েছি ঠিকই, তবে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। সামনে পড়ার খরচ কীভাবে মিটবে, তা ভেবে পাচ্ছি না। তার বয়স যখন ৪ বছর তখন তার বাবা মারা যান। তিন ছেলে মেয়েকে আমি এই পর্যায়ে আনতে অনেক কষ্ট করেছি। তবে তার কাকা, মামা, খালারা সহযেগিতা না করলে হয়তো কিছুই করতে পারতাম না।

আশরাফুল বলেন, আমার এই সফলতার পেছনে রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠিন সংগ্রামের করুণ ইতিহাস। পিতাহীন পরিবারে আমরা তিন ভাই বোন। বড় ভাই বর্তমানে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত। ছোট বোন দশম শ্রেণিতে পড়ছে। বাবা যখন মারা যায় তখন বড় ভাইয়ের বয়স ৬, আমার ৪, বোনের বয়স ১ বছর ছিলো। মা ছিলেন সাহসী। তিনি আমাদের আগলে রেখে যুদ্ধ শুরু করেছেন। কাকা, মামা আর আন্টির সহযোগিতায় কোন রকম দিন পার করেছি৷মা নিজের সবটা দিয়ে সবসময় পড়াশোনা আর ভালো কাজ করতে শিখিয়েছেন৷বহু কষ্টে এসএসসিতেও খেদাছড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ- ৫ পেয়েছি। এতে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায়৷কলেজে পড়ার সময় দেড় বছর টিউশনি করি।

এদিকে পাহাড়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দারিদ্র পরিবারে জন্ম স্মৃতি ত্রিপুরার। তিন ভাই-বোন আর মা-বাবা নিয়ে সংসার ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে, সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। পড়ালেখা করানোর ইচ্ছা থাকলেও খরচ দিতে পারছিল না পরিবার। দারিদ্র্যের কারণে প্রাইভেট-কোচিং করতে পারেনি এরপরও সদ্য প্রকাশিত উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। পড়াশোনা করে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখছে এখন। স্বপ্ন দেখাচ্ছে পরিবারকেও। দারিদ্র্যতাকে ডিঙিয়ে সেই স্বপ্ন জয়ই প্রধান চ্যালেঞ্জ ওর।

পরিবারের দারিদ্র্যতার কারণে এই ফল অর্জন করতে গুইমারা উপজেলার বাইল্যাছড়ি গ্রামের স্মৃতিকে নানান ত্যাগ আর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। স্মৃতি ত্রিপুরা হতে চায় বিসিএস ক্যাডার। কিন্তু দরিদ্র্যতা তাতে বাধার দেয়াল হয়ে দাড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন স্মৃতি ও তার পরিবার।

স্মৃতি ত্রিপুরার বাড়ি গুইমারা উপজেলার বাইল্যাছড়ি ১ নম্বর রাবার বাগান গ্রামে। তার পিতা রবিন্দ্র ত্রিপুরা একজন অতিসয় বৃদ্ধ দিনমজুর। মা স্বপ্না ত্রিপুরা গৃহিণী। কলেজ থেকে দূরবর্তী গ্রামে বসবাস হওয়ায় যাতায়াতেও কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে তাকে।

তার মা স্বপ্না ত্রিপুরা জানান, তার স্বামী একজন দিনমজুর। তিন ছেলে-মেয়ে তার। বড় ছেলে বিবাহিত, মেঝো মেয়ে লেখা পড়া করে। স্মৃতি ত্রিপুরা ছোট। ছোট বেলা থেকে সে মেধাবী ছিলো। দারিদ্র্যতার কারণে পরিবার তাকে সহযোগিতা করতে পারেনি। তবে এবার তিনি হাঁস-মুরগি ও গরু পালন করে কোন রকম মেয়েকে সহযোগিতা করেছেন। এত কষ্টের মাঝেও সে এইচএসসিতে গুইমারা সরকারি কলেজ থেকে এবার বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন স্বপ্না ত্রিপুরার। পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে। তবে অর্থের অভাবে সেই স্বপ্ন কেমন হয় জানেন না। স্থানীয় ইউপি সদস্য একটা ভিজিডি কার্ড দিয়েছিলো। এ দিয়ে কোন রকম সহযোগিতা হয়েছিলো তার।

চেহারা বিষণ্নতায় ভরে থাকা স্মৃতি জানান, এইচএসসিতে সফল হয়েছি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করে ভর্তি হবো। আর কী করেইবা খরচ যুগিয়ে পড়াশোনা করবো। একজন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সাধ আছে কিন্তু সাধ্যতো আমি বা আমার পরিবারের নেই? মনে হয় এ স্বপ্ন পূরণ হবে না। পড়াশোনার সুযোগ পেলে বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশের জন্য কাজ করব। তবে অভাবের কারণে সে আশা পূরণ হওয়া নিয়েও তাঁর শঙ্কা রয়েছে।

স্মৃতি ত্রিপুরা আরো বলেন, তার এই সফল ফলাফলের পিছনে পিতা-মাতা ও কলেজ অধ্যক্ষ নাজিমউদ্দীনের অবদান রয়েছে সবচেয়ে বেশী। কলেজ অধ্যক্ষ তাকে বিনা বেতনে লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাদের প্রতি সে কৃতজ্ঞতা। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণে সকলের দোয়া কামনা করেছেন।

গুইমারা কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, গুইমারা সরকারি কলেজ থেকে এবার দুইজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে উর্ত্তীণ হয়েছে। যদিও আমাদের প্রত্যাশা আরো বেশি ছিলো। তারা হলো বিজ্ঞান বিভাগের মো. আশরাফুল ইসলাম এবং মানবিক বিভাগের স্মৃতি ত্রিপুরা। আশরাফুল ও স্মৃতি বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পড়াশোনা করেছে। দুইজন বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ গ্রহণ করে মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। আমরা তাদের আরো সাফল্য কামনা করি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন