পাহাড়ে আম বিপ্লবের পেছনের গল্প

fec-image

তিন পার্বত্য জেলা তথা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে গত দুই দশকে আমের এক নিরব বিপ্লব ঘটেছে। জঙ্গলে ঢেকে থাকা পাহাড়ের গায়ে এখন সবুজ আমের বাগান। থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা আম দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। কিন্তু দুই যুগ আগেও পাহাড়ের এ অবস্থা ছিল না। চাইলেই সেখানে তখন সুমিষ্ট এসব আম খাওয়া যেত না। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। সমতলের মতো পাহাড়েও আমের বিপ্লব ঘটেছে। প্রতি বছরই পাহাড়ে আমের বাগান বাড়ছে। বাড়ছে ফলন। পাহাড়ের মানুষদের বাড়তি আয়ের পথ দেখাচ্ছে আম।

এক সময়ের জুম ভূমি অথবা ঘন জঙ্গল এখন সেজে উঠেছে আম বাগানে। আম্রপালিসহ বিভিন্ন জাতের আম থোকায় থোকায় ঝুলছে গাছে। পাহাড়ের চেহারাই বদলে দিয়েছে।খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের ছোট-বড় সব আম বাগানে সারি সারি আম গাছ নজর কাড়ছে সবার। বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম জাপানের মিয়াজাকি, আম্রপালি, বারী-৩, বারী-৪, হাড়িভাঙা, কিউজা, ব্রুনাইকিং, রাংখোয়াই, কাটিমন, কিংসাপাসহ প্রায় ২৪- ৩০ প্রকারের উন্নত জাতের আম চাষ হচ্ছে এখন পাহাড়ে।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর অধিকাংশই দখল করে নিয়েছে ভারতীয় আম্রপালি আম। পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আমগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো খুব মিষ্টি, সুস্বাদু, আঁশবিহীন, ছোট আঁটিযুক্ত। স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় এই আমের সুনাম এখন শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। দিন দিন এসব আমের চাহিদা কেবল বৃদ্ধিই পাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আম বিপ্লবের পেছনের গল্পটি এবার বলবো, দুই দশক আগেও পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ হতো না। ১৯৯৮-৯৯ সালে কালিকাপুর মডেল প্রকল্পের আওতায় পাহাড়ে আম্র্রপালি আমের আবাদ শুরু হয়। ২০০১ সালে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভূইয়ার উদ্যোগে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে আম চাষে উদ্বুদ্ধ করা হয়। সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ৪ হাজার পরিবারকে ৫ একর করে যায়গায় আম চাষের জন্য চাষিদের বিনামূল্যে চারা, সার ইত্যাদি দিয়ে আম চাষে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ওই পরিবারগুলোকে ২ বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা করে দেওয়া হতো, যাতে তারা আম গাছে আম ধরা পর্যন্ত গাছের সঠিক পরিচর্যা করতে পারে। এই চারাগুলোর বেশির ভাগই ছিল আম্রপালি আমের চারা। এর ফলে তখন থেকে পাহাড়ে আম্রপলি আম চাষে ব্যাপক প্রসার ঘটে।

এ প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে পার্বত্য বান্দরবন জেলায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি বমদের সর্বপ্রথম আমের বাগান করার জন্য সুবিধা দেওয়া হয়। আজকে তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি আম বাগান রয়েছে। বাণিজ্যিকভিত্তিক বড় বড় এগ্রো ফার্মের অধিকাংশ বাগানই এ জেলায় অবস্থিত।

গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নের সফল আম চাষি মো. আলী জানান, একসময় তিনি দিনমজুর ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় ২০০১ সালে তিনি নিজস্ব পাহাড়ি টিলা ভূমিতে আমের বাগান করে এখন তিনি আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল। গত বছর আম বিক্রি করে প্রায় ৬ লাখ টাকা লাভ করেন। এ বছর ফলন খুব ভালো হওয়ায় লাভও অনেক বেশি হবে বলে জানালেন তিনি। মো. আলীর মতো আম চাষের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ পার্বত্য এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক পালটে গেছে।

চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো উন্নতজাতের আম চাষের উপযোগী হওয়ায় আমচাষিরা শুরু থেকে লাভের মুখ দেখতে পায়।তাদের সফলতা দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হয়, ধীরে ধীরে গড়ে উঠে অসংখ্য আমের বাগান। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার আমের বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ৩০ হাজার লোক কর্মরত আছে। বিভিন্ন এগ্রো প্রতিষ্ঠান পার্বত্য অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষে এগিয়ে আসায় এটি বর্তমানে একটি লাভজনক, সম্ভাবনায় কৃষি এবং শিল্প উদ্যোগে পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রাম শহরসহ রাজধানী ঢাকার বাজারেও মিলছে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত এসব বিদেশি জাতের আম। দেশে আমের জেলা হিসেবে খ্যাত রাজশাহী জেলার চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই আমাদের পার্বত্য জেলাগুলো। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব দ্রুতই আম উৎপাদনে রাজশাহী বিভাগের কাছাকাছি চলে আসবে পার্বত্য জেলাগুলো।

বর্তমানে ছোট বড় মিলিয়ে অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং প্রান্তিক পর্যায়ের বহু উদ্যোক্তা-চাষি পাহাড়ে আমের আবাদ করছেন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সঠিক পরিচর্যা পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আম জাতীয় অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আম, পাহাড়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন