পাহাড়ে কি জমিদারী প্রথা চিরস্থায়ী করতে চায় কমিশন?

fec-image

জুলাইবিল্পব পরবর্তী গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে সাত সদস্য বিশিষ্ট এই কমিশন গঠন করা হয়। অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ নেতৃত্বাধীন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের প্রাথমিক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করেছে। যা গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটির পুরোটা পড়ে দেখার সুযোগ এখনো হয়নি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা হিসেবে প্রতিবেদনের পঞ্চম তথা ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার’ অধ্যায়টি গুরুত্ব দিয়ে পড়েছি। ৪৬ পৃষ্ঠার প্রাথমিক সুপারিশ প্রতিবেদনটির ১৪ ও ১৫ পৃষ্ঠায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার’ শিরোনামে আলাদাভাবে ১৫টি সুপারিশ করেছে কমিশন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা এবং একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কমিশনের পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত সুপারিশগুলোর মূল্যায়ন করার প্রয়োজন মনে করছি।

কমিশনের সুপারিশ: ১. পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি “বিশেষ অঞ্চল” হিসেবে ১৯০০ সনের পর থেকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ভৌগোলিক ভিন্নতা বিশেষতঃ পাহাড়-নদী এবং এখানে বাঙালীসহ মোট ১৩টি ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর বসবাস। যাদের ভিন্ন ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রথা-রীতি-পদ্ধতি ও সামাজিক আচার-আচরণ রয়েছে।

আমার মূল্যায়ন: পার্বত্য সমস্যার শিকড় ‘বিশেষ অঞ্চল’ এই পদবাচ্যের মধ্যেই নিহিত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বিশেষ অঞ্চল’ বা ‘এক্সক্লুডেট এরিয়া’ বলে ব্রিটিশরা বিশশতকের গোড়ার দিকে এই অঞ্চলকে সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে তিন সার্কেল চিফ তথা তিনজন জমিদারের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে কর বা ট্যাক্স আদায়ের যে কৌশল অবলম্বন করেছিল তা আজও বলবত আছে। আর এটা সম্ভব হচ্ছে কেবল ওই ‘বিশেষ অঞ্চল’ এর দোহাই দিয়ে গোটা উপমহাদেশে ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত জমিদারী প্রথা টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে। এই জমিদারী প্রথার কারণেই পাহাড়ের অবাঙালি জনগোষ্ঠিগুলো কখনোই পরিপূর্ণ নাগরিক হয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। শুধুমাত্র করদ প্রজা হিসেবেই থেকে গেছে। এর থেকে উত্তরণের একটাই পথ, তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বিশেষ অঞ্চল’ বলে বিচ্ছিন্ন করে রাখা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এবং পাহাড়-সমতল সকল স্থানের সকল নাগরিককে একটি মাত্র পরিচয় ‘বাংলাদেশি’ এবং তাদের একই অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনতে হবে।

কমিশনের সুপারিশ: ২. এই অঞ্চলে প্রথাগত হেডম্যান কারবারী সার্কেল প্রধান, বাজার ফান্ড, সংবিধিবদ্ধ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ (বিশেষ আইনে গঠিত) এবং একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য তিন জেলা নিয়ে একটি ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ রয়েছে। এ সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধুমাত্র “বাজার ফান্ড” প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত করে বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠান অক্ষুন্ন রাখা যেতে পারে।

আমার মূল্যায়ন: হেডম্যান-কারবারী-সার্কেল প্রধান এসব সেই জমিদারী প্রথার প্রতীক, যা গোটা উপমহাদেশে ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত। তাছাড়া ১৯০০ সালের যে আইনের মাধ্যমে এসব প্রথা সৃষ্ট, সেই আইন স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে কখনোই আত্মীকরণ করা হয়নি। এই প্রথা থেকে জমিদার তথা অভিজাত ও প্রজা শ্রেণিভেদ ছাড়া পার্বত্যবাসীর পাওয়ারও তেমন কিছু নেই। তাই এসব পরিত্যক্ত ও ঘৃণিত প্রথাকে দীর্ঘায়িত করার মাধ্যমে জনগণকে অনন্তকালব্যাপী প্রজা বানিয়ে রাখার কোনো মানে নেই। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা সারাদেশে যেমন থাকবে, এখানেও তেমনি থাকার ব্যাপারে কোনো সমস্যা বা আপত্তি নেই। জেলা পরিষদ থাকতে পারে, তবে এটাকে অবশ্যই জাতিগত বৈষম্যমুক্ত আইনের মাধ্যমে আনতে হবে। পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনকে জাতিগত বৈষম্যমুক্ত করার ব্যাপারে গত ১০ জানুয়ারি ২০২৫ স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন বরাবর যে সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম তাতে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ সুপারিশ দেয়া আছে। আঞ্চলিক পরিষদের ব্যাপারে হাইকোর্টের একটি রায় আছে, যেখানে একটিকে বাতিল বলে গণ্য করা হয়েছে। আমরাও মনে করি, আদালতের রায়টি সঠিক এবং সেটিই বাস্তবায়ন করা উচিত। তবে যেহেতু হাইকোর্টের সেই রায়টি আপিল বিভাগের রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় আছে, তাই সেটির দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ ব্যাপারে রাষ্ট্র সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করি। বাজার ফান্ড নিয়ে কমিশনের সুপারিশ যথার্থ বলেই মনে করি।

কমিশনের সুপারিশ: ৩. ‘বাজার ফান্ড’ প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করে বাজার রাজস্ব আহরণের জন্য উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) ও উপজেলা পরিষদ সভাপতির সভাপতিত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে মুক্তভাবে প্রতিযোগিতামূলক নিলামের মাধ্যমে এসব রাজস্ব একটি কেন্দ্রীয় তহবিলে স্থানান্তর করে তা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা সার্কেল-চিফ ও জাতীয় সরকার এর মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী ‘আনুপাতিক হারে’ বণ্টন করা যেতে পারে।

আমার মূল্যায়ন: বাজার ফান্ড নিয়ে কমিশনের সুপারিশ যথার্থ বলেই মনে করি।

কমিশনের সুপারিশ: ৪. পার্বত্য অঞ্চলের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং-পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তরিত হতে পারে। ‘স্থানীয় সরকার বিভাগ’ প্রতিবছর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জাতীয় বাজেটের পার্বত্য অংশ ঐ মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করে দিতে পারে।

আমার মূল্যায়ন: পার্বত্য অঞ্চলের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তর কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। কারণ, সারাদেশের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভাগুলো একই আইনে গঠিত। এখন এই তিন জেলার এই স্থানীয় সরকারগুলোকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কোনো মানে নেই। এটা একদিকে যেমন আইগত জটিলতা তৈরি করবে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরো বেশি বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে ঠেলে দেয়া হবে। শান্তির জন্য আমাদের এই বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবণতা থেকে বের হয়ে সারাদেশের সাথে এক হওয়ার পথ ও প্রক্রিয়ার দিকে এগুতে হবে।

কমিশনের সুপারিশ: ৫. ইউনিয়ন পরিষদসমূহের সাথে হেডম্যান করবারীদের একটি প্রশাসনিক সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে।

আমার মূল্যায়ন: ইউনিয়ন ও হেডম্যান-কারবারীদের মৌজার সীমানা বা আয়তনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া, ইউনিয়ন পরিষদসমূহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হয়। অন্যদিকে হেডম্যান-কারবারীরা কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না। জনগণ চাইলে নির্দিষ্ট সময় বা মেয়াদ পরে তাদের জনপ্রতিনিধিকে পুননির্বাচিত বা বদল করতে পারে। কিন্তু হেডম্যান-কারবারী জনমত বা জনগণের রায়ে নির্বাচিত হন না, বরং তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমিদারী প্রথার প্রতীক হিসেবে বংশপরমপরায় দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। এমনকি কোনো হেডম্যান-কারবারী অযোগ্য বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠলেও জনগণ তাদেরকে সহজে বদলাতে পারেন না। এমন অনির্বাচিত জমিদারী প্রথার প্রতীক হেডম্যান-কারবারীদের নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলে সুফলের চেয়ে কুফলই অধিক হওয়ার কথা। তাছাড়া, আইনি জটিলতার ব্যাপার তো আছেই।

কমিশনের সুপারিশ: ৬. ইউনিয়ন পরিষদের বার্ষিক পরিকল্পনা ও বাজেট অধিবেশনে হেডম্যানদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

আমার মূল্যায়ন: এর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

কমিশনের সুপারিশ: ৭. ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি স্থায়ী কমিটিতে একজন করে হেডম্যানকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

আমার মূল্যায়ন: এর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এর মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে অনির্বাচিত হেডম্যান-কারবারীদের কর্তত্ব নিয়ে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। বরং নির্বাচিতদের সঙ্গে অনির্বাচিতদের যুক্ত করার মাধ্যমে নানা জটিলতাই তৈরি করবে।

কমিশনের সুপারিশ: ৮. উপজেলা পরিষদে ও পৌরসভায় হেডম্যান-কারবারীদের নিজ নিজ পরিষদ অধিভুক্ত এলাকা থেকে একজন নারী ও একজন পুরুষকে সহযোগী সদস্য হিসাবে যুক্ত হতে পারে।

আমার মূল্যায়ন: এর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বরং নির্বাচিতদের সঙ্গে অনির্বাচিতদের যুক্ত করার মাধ্যমে নানা জটিলতাই তৈরি করবে। যেহেতু উপজেলা এবং পৌরসভার সাথে হেডম্যান-কারবারীদের মৌজার সীমানার কোনো সম্পর্ক নেই তাই এক্ষেত্রে নানা দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে।

কমিশনের সুপারিশ: ৯. জেলা পরিষদে স্ব-স্ব জেলার সার্কেল চিফগণ নিয়মিত সদস্য হিসাবে গণ্য হবেন।

আমার মূল্যায়ন: এর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বরং নির্বাচিতদের সঙ্গে অনির্বাচিতদের যুক্ত করার মাধ্যমে নানা জটিলতাই তৈরি করবে।

কমিশনের সুপারিশ: ১০. জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ২০২৫ এর মধ্যে পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করা যেতে পারে। এ আইনের সংশোধনী পৃথকভাবে সংযুক্ত করা হলো। কারণ ১৯৮৯ এর পর পার্বত্য জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে এ পরিষদটি রাজনৈতিক বৈধতা হারাতে বসেছে।

আমার মূল্যায়ন: দ্রুত পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন অবশ্যই কাম্য। তবে এই ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের যে সংশোধনী পৃথকভাবে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, তা এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি বলেই জেনেছি। তাই, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের পূর্ণাঙ্গ সংশোধনী প্রস্তাব না দেখে এ ব্যাপারে বিস্তারিত মতামত দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এক্ষেত্রে গত ১০ জানুয়ারি ২০২৫ আমি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনকে জাতিগত বৈষম্যমুক্ত করতে যে সংশোধনী প্রস্তাব কমিশন বরাবর প্রেরণ করেছিলাম, সেটির মধ্যেই প্রকৃত সমাধান নিহিত আছে বলে মনে করি।

কমিশনের সুপারিশ: ১১. আঞ্চলিক পরিষদ আইনের সংশোধন এবং নির্বাচন বিষয়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আপতত যেভাবে আছে তা চলতে পারে।

আমার মূল্যায়ন: আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং আঞ্চলিক পরিষদকে বাতিল করে হাইকোর্টের রায় আছে। সেই রায়টি আপিল বিভাগের রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় আছে। সেটির দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে আদালতের নির্দেশনা দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

কমিশনের সুপারিশ: ১২. পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০২৬ সালের মধ্যে পৃথক জনবল, তিন স্তরে ভুমি জরীপ, ইউনিয়ন ও পৌরসভা ভিত্তিক নাগরিক তথ্য-ভান্ডার তৈরি করা প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে।

আমার মূল্যায়ন: এটি একটি উত্তম সুপারিশ বলেই মনে করি। কারণ, ভূমি ও জনবল জরিপ সম্পন্ন করা গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যার অনেকটাই কেটে যাবে বলে আশা করি। তবে এই ক্ষেত্রে অবশ্যই জনবল নিয়োগ ও অন্যান্য সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অবশ্যেই জনসংখ্যানুপাতে বাঙালি এবং অবাঙালির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

কমিশনের সুপারিশ: ১৩. যেসকল ক্ষেত্রে পাহড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতীসত্বার অধিবাসীগণের জন্য ব্যবসা, নির্মাণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের উপর কর-মূসক মওকুফ করা আছে, তা প্রত্যাহার করে সমতলের মত কর-মূসক আরোপ করলে সুফল পাওয়া যাবে। এই মওকুফের কারণে দরিদ্র পাহাড়ী-বাঙালী কারও কোনো উপকার হচ্ছে না। একটি মধ্যস্বত্বভোগীর আত্মসাত প্রক্রিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে।

আমার মূল্যায়ন: এই সুপারিশের ব্যাপারে কমিশনের সাথে আমিও সম্পূর্ণ একমত। এমন একটি সুপারিশের জন্য কমিশনকে সাধুবাদ জানাই।

কমিশনের সুপারিশ: ১৪. কর, মূসক মওকুফ হলেও বে-আইনি চাঁদাবাজী পার্বত্য ট্টগ্রামের একটি নির্মম বাস্তবতা। এ চাঁদাবাজির সাথে প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসমূহ ও নানা গোষ্ঠী এক ধরনের বন্দোবস্ত তৈরি করেছে। এ বন্দোবস্ত সাধারণভাবে দৃশ্যমান হলেও এখানে যাদের ব্যবস্থা নেয়ার কথা তারা চোখ বন্ধ করে রাখে। এ দুঃসহ অবস্থা ও ব্যবস্থা অবসানের জন্য ব্যাপক নাগরিক সংলাপ করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। একই সাথে প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রেয়োজন।

আমার মূল্যায়ন: এই সুপারিশের ব্যাপারে কমিশনের সাথে আমিও সম্পূর্ণ একমত। এমন একটি সুপারিশের জন্য কমিশনকে সাধুবাদ জানাই।

কমিশনের সুপারিশ: ১৫. ব্যাপক কর্মসংস্থান, জননিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং সীমান্তের বাইরের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হলে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা টেকসই হবার নয়। তাই ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল জাতি গোষ্ঠির শাসন ও উন্নয়নে অংশীদারীত্ব নিশ্চিত করাই হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল লক্ষ্য ও কাজ।

আমার মূল্যায়ন: এই সুপারিশের ব্যাপারে কমিশনের সাথে আমিও সম্পূর্ণ একমত। এমন একটি সুপারিশের জন্য কমিশনকে সাধুবাদ জানাই।

এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠির বিচার-সালিশসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদনের বিভিন্ন অধ্যায়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সেসব বিষয় সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা যাবে। যাহোক, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার সম্পর্কে যে সুনির্দিষ্ট ১৫টি সুপারিশ করেছে এর মধ্যে সুপারিশ নং ১, ২, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং উপমহাদেশে ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত জমিদারী প্রথাকে চিরস্থায়ী করার বীজ বপন করা আছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে নির্বাচিত ও অনির্বাচিত মিলে যেমন একদিকে আইনি জটিলতা তৈরি করবে, তেমনি অন্যদিকে এসব সুপারিশ সারাদেশ থেকে বোধ ও চেতনাগতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ক্রমেই আরো বেশি দূরে নিয়ে যাবে এবং সেখানকার জনমানসের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদকে আরো গভীরে নিয়ে যাবে।

আমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের অংশ মনে করি এবং সেখানে অশান্তি ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির শিকড় উপড়ে ফেলে শান্তির পথে হাঁটতে চাই, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ভাবনাতেও আনা উচিত হবে না। বরং শান্তির পথে উত্তরণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ যাতে সারাদেশের বাসিন্দাদের মতোই একই দেশের নাগরিক এবং তাদেরও রয়েছে একই আইনি নিরাপত্তা ও সমান অধিকার সেই নিশ্চিয়তা তাদের দিতে হবে। তাহলেই একদিন না একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নাগরিক নিজেদের আলাদা না মনে করে এই দেশের নাগরিক ভাবতে শুরু করবেন এবং সকলের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে এই দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধিতে নিজেদের মেধা, শ্রম ও মননশীলতাকে পরিপূর্ণভাবে নিয়োজিত করবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশেষ হওয়া, আলাদা হওয়া বা বিচ্ছিন্নতাবাদের মধ্যে শান্তি নেই, শান্তি আছে একিভূত হওয়ার মধ্যে, শান্তি আছে সকলে সমান অধিকার, সম আইনি নিরাপত্তা ও ন্যায়-ন্যায্যতার ভিত্তিতে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার মধ্যে।

লেখক: সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।

[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন