পাহাড়ের চরম দুর্দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও প্রথাগত নেতারা কোথায়?

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রের অধীন থাকলেও নীতি নির্ধারণে রয়েছে সুনির্দিষ্ট একটি মহল। যাদের অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্র ও সরকারের পাহাড় নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা থেকেও কার্যত অক্ষম। এই সুনির্দিষ্ট মহলটি পাহাড়ের আপামর জনগোষ্ঠীর কর্ণধারের দাবিদার। পার্বত্য চট্টগ্রামের সরকারি, আধা-সরকারি, বে-সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়নে তাদের একছত্র প্রভাব বিদ্যমান। পাহাড়ী জনগণের নামে, জনগণের অধিকার রক্ষার নামে, জনগণের বৈশিষ্ট রক্ষার নামে নিজেদের জনদরদী প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করতে এই মহল সিদ্ধহস্ত।

এরা নিজেদের উপজাতীয় আঞ্চলিক নেতা, প্রথাগত নেতৃত্ব, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা প্রভৃতি নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। জনগণের অধিকার রক্ষা, দাবী আদায় ও উন্নয়নের নামে এ গোষ্ঠীটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য দেয়া বরাদ্দের সিংহভাগ নিজেদের করায়ত্ত্ব করে থাকে। এছাড়াও আঞ্চলিক সিস্টেমেটিক চাঁদাবাজির মাধ্যমে আয় করা বার্ষিক ৪শত কোটি টাকার বিশাল অর্থও জনগণের অধিকার রক্ষার নামেই জোর জুলুম ও নির্যাতন করে আদায় করা হয়।

বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাব থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামও মুক্ত নয়। পাহাড়ের দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং দিন আনে দিন খায় পর্যায়ের জীবনযাপন করা মানুষগুলো বর্তমান লক ডাউন পরিস্থিতিতে যারপরনাই কষ্টে দিনাতিপান করছে। এরমধ্যে বান্দরবানের লামা, রাঙামাটির সাজেক ও খাগড়াছড়ির দিঘীনালায় উপজাতীয় শিশুদের মধ্যে হাম রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এতে লামায় ১জন, সাজেকে ৮জন ও দিঘীনালায় ১জনসহ মোট ১০ শিশুর মৃত্যু ও দেড় শতাধিক শিশু আক্রান্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অটুট রাখার কঠিন দায়িত্ব পালন করেও, করোনা মোকাবেলার জাতীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় সর্বেোচ্চ আত্ম নিয়োগ করেছে। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উপদ্রুত দুর্গম এলাকায় পৌঁছে চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি মুমূর্ষ শিশুদের উদ্ধার করে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিএমএইচে ভর্তি করে চিকিৎসা দিয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের এই দুর্দিনে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো ও প্রচলিত নেতৃত্বের টিকিটিও দেখতে পাচ্ছে না পাহাড়ের মানুষ। তাই প্রশ্ন উঠেছে, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে পার্বত্য জনপদ যেখানে বিপর্যস্ত সেখানে কথিত সেই পার্বত্য কর্ণধারেরা কোথায়?

বিশ্বব্যাপী বর্তমানে নতুন ‘আতঙ্ক’র নাম করোনা ভাইরাস। মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়া নতুন এ ভাইরাসে এরইমধ্যে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভাইরাসটির শনাক্তস্থলে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। শুধু তাই নয়, চীনের সীমানা পেরিয়ে এটি ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ছোবল হেনেছে কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস। গত ২৬ মার্চ হতে সমগ্র বাংলাদেশকে লকডাউন করেছে বাংলাদেশ সরকার।

লকডাউনের কারনে সমগ্র দেশের মানুষ ঘরে বন্দি। এই পরিস্থিতিতে সমস্যায় নিমজ্জিত হয়েছে দৈনিক খেটে খাওয়া মানুষেরা। দিন-মজুর, ড্রাইভার, কৃষকসহ দেশের নানা পেশার মানুষদের জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে করোনা ভাইরাস।

এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অন্য সকল অঞ্চল হতে অনুন্নত। এখানকার মানুষেরা অধিকাংশই শ্রমজীবী। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা এই অঞ্চলে বেশি। দেশের সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা খেটে খাওয়া মানুষদের চাল, ডাল, আলুসহ বিভিন্ন পণ্য দিয়ে মানবিক দৃষ্টিতে পাশে দাড়িয়েছেন। সেনাবাহিনীও সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি, গৃহবন্দী মানুষের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম চালাচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই কর্ণধারেরা!

প্রতি বছর পাহাড়ের খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শত শত কোটি টাকা চাঁদাবাজী করছে জেএসএস, ইউপিডিএফ। বর্তমান পরিস্থিতিতে উক্ত সংগঠন সেই মানুষগুলোর পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখে চলেছে।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজীর অভয়ারণ্য। এখানে চাঁদা না দিয়ে জীবনধারণ অসম্ভব। এমন কোনো কাজ নেই, এমন কোনো পেশা নেই যেখানে সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দিতে হয়। সরকারী করের মতো নির্ধারিত রেটে চাঁদা না দিয়ে এখানে জীবনযাপন কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। জেএসএস (মূল), জেএসএস(সংস্কার) ও ইউপিডিএফ এবং ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামক পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজীর কাছে সরকারও অসহায়। চাঁদা না দিলে গুম,ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি অবধারিত। বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজী হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে।

এই টাকা নামকাওয়াস্তে সংগঠনের জন্য ব্যয় হলেও অধিকাংশই ব্যয়িত হয় সংগঠনগুলোর সিনিয়র নেতাদের ভোগ ও বিলাসব্যাসনে। এ নিয়ে সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ পরিলক্ষিত হলেও অস্ত্রের মুখে কেউ উচ্চবাচ্য করতে পারে না। অতীতে যারাই এ চেষ্টা করেছে তাদের জীবনেই নেমে এসেছে ভয়াবহ পরিণতি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের কথিত শীর্ষ নেতা সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সৃষ্টিলগ্ন থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় চেয়ারম্যান। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সৃষ্ট এই পরিষদ দীর্ঘ প্রায় দুই যুগে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর জন্য কি কাজ করেছে? প্রতিবছর সরকার থেকে বিপুল অঙ্কের বরাদ্দ পেলেও দীর্ঘ সময় ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ পরিষদ দূর্যোগকালীন সময়ে ১ কেজি চাল কাউকে দিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। বন্যা, ভূমিধস, রোগ, শোক বা যেকোনো পর্যায়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনোদিন তাদের দেখা যায়নি।

পার্বত্যবাসী তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নাম দিয়েছে সন্তু লারমার “শান্তি বাহিনী পুনর্বাসন পরিষদ” নামে। পার্বত্যবাসীর জন্য নয়, জেএসএস সন্ত্রাসীদের দেখভালের জন্যই যেন এই পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছে। শান্তিবাহিনীর কোনো সদস্য অস্ত্রবাজী, চাঁদাবাজী বা খুনের দায়ে ধরা পড়লে সন্তু লারমাকে প্রতিমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে পুলিশকে ফোন দেয়া ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি কোনোদিন।

একইভাবে ইউপিডিএফ নেতা প্রসীত বিকাশ খীসার কথাও বলা যায়। সরকারী কোনো পদ বা অফিসিয়াল কোনো সুবিধা তার নামে বরাদ্দ না থাকলেও পাহাড়ের দ্বিতীয় শীর্ষ ক্ষমতাধর নেতা তিনি। অবশ্য তার এই ক্ষমতার উৎস অবৈধ অস্ত্র। চাঁদাবাজীতেও তিনি শান্তিবাহিনীর সমকক্ষ। কিন্তু পাহাড়ের মানুষের কোনো বিপদে তাকে বা তার সংগঠনকে পাওয়া যায়নি কোনোদিন। বিপদের নাম করে চাঁদা তুললেও সেই অর্থ প্রসীত খীসা কখনো জনগণের জন্য ব্যয় করেননি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো আছে প্রথাগত নেতৃত্ব। অফিসিয়ালি যাদের নাম সার্কেল চিফ। কিন্তু নিজেদের তারা রাজা হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করেন। সরকারী, বেসরকারী ও সামাজিকভাবে এবং ফসলের খাজনা থেকে তারা বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেন। এই অর্থ দিয়ে তারা ব্যক্তিগত ভোগ বিলাসে মত্ত্ব থাকলেও নিজেদের ‘প্রজাদের’ দুঃখে কখনই তাদের পাশে যেতে দেখা যায় না।

এদের নেতা আবার দেশের শীর্ষতম রাজাকার ত্রিদিব রায়ের পুত্র ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। পাহাড়ী জনগণের অধিকার রক্ষার নামে বছরের একটা উল্লেখযোগ্য সময় সস্ত্রীক ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতে দেখা গেলে জনগনের দুর্ভোগে কোনোদিন তাকে পাশে দেখা যায়নি।

পাহাড়ে যেকোন সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে চাকমা রাজ পরিবারকে সরব দেখা গেলেও পাহাড়ের দূর্যোগকালীন সময়ে এই পরিবার নীরব। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন, পাহাড়ে সার্কেল প্রথা রেখে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর কি লাভ? পার্বত্য জনগোষ্ঠী তিন সার্কেলকে দান দক্ষিণা প্রদান ছাড়া ক্রান্তিকালে ফুটো পয়সার উপকার পেয়েছে এমন নজির বিরল। পার্বত্যবাসী প্রত্যক্ষ করছে সার্কেল প্রধানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং পার্বত্যবাসীর টাকায় রাজাদের কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, চীন ভ্রমণ। সার্কেল প্রথা পার্বত্য জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমানে অভিশাপ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরণের জমিদারী ও সামন্ত প্রথা টিকিয়ে রাখতে তারা বদ্ধ পরিকর। তাদের জমিদারী টিকিয়ে রাখার জন্য তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথাগত রীতির নামে সামষ্টিক ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে চায়। এর মাধ্যমে তারা পাহাড়ী মানুষকে ভূমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত করে সকল ভূমি নিজেদের মালিকানায় নিতে চায়।

সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য জনপদ আজ কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে। এই সময়ে রাষ্ট্রের সরকারের পাশাপাশি যদি কথিত পার্বত্য আঞ্চলিক নেতারা/কর্ণধারেরা পার্বত্যবাসীর পাশে দাঁড়াতো তবে হয়তো পার্বত্যবাসী আরেকটু বেশি সহায়তা পেতো। কিন্তু, তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তাই এটা বলা স্বাভাবিক যে, তারা পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নেতা নন, তারা বৈদেশিক চক্রান্তকারীদের নিয়োগী। পার্বত্যবাসীর কল্যাণ তারা কখনোই কামনা করেন না। পার্বত্য জনপদ নিয়ে বাণিজ্য করাই হলো তাদের প্রধান পেশা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িকতা, বিভেদ, ঘৃণার রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়া ও বিদেশী নীল নকশা বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উষ্কানী সৃষ্টির নূন্যতম সুযোগ তারা হাতছাড়া না করলেও পাহাড়ী জনগণের বিপদে, প্রকৃত অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের কোনোদিন তাদের পাশে পাওয়া যায় না। তাই আজ সময় এসেছে, এইসব তথাকথিত পাহাড়ী আঞ্চলিক ও প্রথাগত নেতাদের মুখোশ উন্মোচন করা এবং একই সাথে তাদের অধিকার রক্ষার নামে পাহাড়ী জনগণকে শোষণের মোহজাল মুক্ত হয়ে পাহাড়ী জনগণকে সত্য ও বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া।

♦ লেখক: আবু উবায়দা- ব্লগার, রাঙামাটি
♦                আরিফ এম হোসেন- ব্লগার, খাগড়াছড়ি।

♦ মুক্তমতে প্রকাশিত সকল লেখার বক্তব্য, বিষয়বস্তু, তথ্য ও পর্যালোচনা একান্তই লেখকের নিজস্ব। পার্বত্যনিউজের সম্পাদকীয় নীতি এ বিভাগে প্রযোজ্য নয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন