পাহাড়ের দিকে তাকালেই শান্তিচুক্তির সুফলগুলো দেখতে পাওয়া যাবে: বীর বাহাদুর

fec-image

শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি মন্ত্রণালয়ের ঢাকা অফিসে পার্বত্যনিউজের সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশকে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এ সময় পার্বত্যমন্ত্রী শান্তিচুক্তির বিভিন্ন দিক এবং পাহাড়ের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। পাশাপাশি পাহাড়ে চলমান ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে শান্তিচুক্তির সুফল হিসেবে বর্ণনা করে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কথাও তুলে ধরেন।

শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি মন্ত্রণালয়ের ঢাকা অফিসে পার্বত্যনিউজের সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশকে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এ সময় পার্বত্যমন্ত্রী শান্তিচুক্তির বিভিন্ন দিক এবং পাহাড়ের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। পাশাপাশি পাহাড়ে চলমান ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে শান্তিচুক্তির সুফল হিসেবে বর্ণনা করে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কথাও তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারটি পার্বত্যনিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

পার্বত্যনিউজ: একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালে অর্জিত হয়েছে শান্তিচুক্তি। কোন প্রেক্ষাপটে শান্তিচুক্তি হয়েছিল? 

বীর বাহাদুর উশৈসিং:  প্রথমে আমাকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে হবে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কয়েকবার পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন পার্বত্যাঞ্চলের পরিবেশ দেখে। তিনি চিন্তা করেন, ‘পার্বত্য এলাকাকে আমাদের এগিয়ে নিতে হবে। পাহাড়ের অধিবাসীদের সর্বক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে আমরা এনে যদি সম্পৃক্ত করতে পারি, এ অঞ্চল সমৃদ্ধ হবে। এখানকার ছেলেমেয়েরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে, জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে।’ একারণে পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে উন্নয়নের এক বিশাল পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর। আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে আমরা হারিয়েছি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর দেশের যে কী অবস্থা ছিল সেটাতো দেশবাসী ও বিশ্ব জানে। দেশে শাসন বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে সমস্যা চলছেই। তৎকালীন সরকার অনেক সময় পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সঠিক সমস্যাটা তারা সেভাবে চিহ্নিত করে এগোতে পারেননি। যেটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগ থেকেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের যেকোন সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখসহ যেকোনো অবস্থায় পাশে তিনি দাঁড়াতেন। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের একটা আশা ছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে এবং বিশ্বাস ছিল অভিভাবক হিসেবে। তিনি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগেই একটা কথা আমাদের বলেছিলেন যে, ‘মা হারানো, বাবা হারানো, আপনজন হারানো, ভিটে-বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকা কী যে কষ্ট তোমরা আমার চেয়ে বেশি বুঝবা না। আমরা যদি মানুষের সেবা করার সুযোগ পাই, তাহলে রাষ্ট্রের-দেশের অনেক রকম সমস্যা আছে, তেমনি পার্বত্য অঞ্চল একটি, আমরা এর সমাধান করবো।

আমি অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য যেভাবে চেষ্টা করব, পার্বত্য অঞ্চলকেও আমি সেভাবে গুরুত্ব দিব। আমরা শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সে এলাকার যে অস্থিতিশীল পরিবেশ সেটাকে সমাধান করার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব।’ তিনিই প্রথম বলেছেন, ‘এটিই হলো আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা। এটাকে আমাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে বা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।’

যাহোক, উপরওয়ালার ইচ্ছায় ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠন করলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো । তারপরই উনার কাজ শুরু হয়ে গেল। আমরা ক্ষমতার গ্রহণ করার পর পাহাড়ে যারা আন্দোলনরত ছিলেন, তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলো। আমরা ১০ থেকে ১২ বা ১৩টার মতো বৈঠক করেই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি। বৈঠকগুলোতে তাদের কথাকে আমরা মন দিয়ে শুনেছি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে, প্রধানমন্ত্রীকে নলেজে দিয়ে। সকল সমস্যা শোনার পরে সেগুলো চিহ্নিত করে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য, সম্প্রীতির জন্য, অস্থিতিশীল পরিবেশকে শান্ত করার জন্য আমরা যে আলাপগুলো করেছি, সে আলাপগুলোর মাধ্যমে যদি আমরা উভয়ের মাঝে সমঝোতার মধ্যে আসতে পারি তাহলে একটি পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আমাদের জাতীয় কমিটিতে ছিলেন, তখনকার চিফহুইপ জনাব আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এমপি। তিনি এখন শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান। তার নেতৃত্বে আমরা কাজ শুরু করলাম। পরবর্তীতে তাদের আস্থায় আনতে পারার কারণেই আমরা উভয়পক্ষের মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি হলো, যেটিকে শান্তি চুক্তি বলি, যেটিকে পার্বত্য চুক্তি বলি আমরা। আজকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সেই চুক্তি ২৫ বছর পূর্ণ করেছে।

পার্বত্যনিউজ: জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা প্রায়ই বলেন, শান্তিচুক্তির কিছু অলিখিত শর্ত ছিল। এরকম কোনো শর্ত কী আদৌ ছিলো? থেকে থাকলে, কী কী শর্ত ছিল?

বীর বাহাদুর উশৈসিং: আমি তো মোটামুটি সঙ্গেই ছিলাম, এ ধরনের কোনো কথা হয়েছে কি না আমার জানা নাই। কারণ, মাঝে মাঝে ছোট ছোট কমিটি আলাদাভাবে বসতেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, তখন আমরা হয়তো থাকতাম না। তবে এ ধরনের যদি আলাপ হতো, তাহলে আমরা তো কিছু না কিছু শুনতাম। এরকম কোনো অলিখিত কোনো আলাপ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। সুতরাং আমি এ বিষয়ে জোর দিয়ে কোনো কথা বলতে পারব না, ছিল বা ছিল না।

পার্বত্যনিউজ: শান্তিচুক্তির ২৫ বছরের অর্জনগুলো কী কী?

বীর বাহাদুর উশৈসিং: সেটি আপনিও ভালোভাবে জানেন। কারণ, আপনিও অভিজ্ঞ। পার্বত্য এলাকার প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার পদার্পণ আছে, আপনার গবেষণা আছে, আপনি অনেক লেখেন, সেখানে আপনি অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। পার্বত্য অঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের কী অবস্থা ছিল? আমাদের এই যে ২৬টি উপজেলা নিয়ে পার্বত্যাঞ্চল, সেখানকার প্রত্যেকটি এলাকায় কি রাস্তার যোগাযোগ ছিল? প্রত্যেকটা এলাকায় কি বিদ্যুৎ ছিল? প্রত্যেকটি এলাকায় কি স্কুল বা কলেজ ছিল? কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের কি কোনো উন্নয়ন ছিল? সব হয়েছে আল্লাহর রহমতে, সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। সুতরাং আমার মনে হয়, আমাদের এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে।

শিক্ষার দিকে তাকালে অনেক কিছু দেখবেন, চাকরির দিকে দেখলেও অনেক দেখবেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট দেখবেন। আমার বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র একটি উদাহরণ দিই, থানচির মতো এলাকায় কলেজ ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না, রাস্তা ছিল না, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না, মানুষ কোনো কৃষি কাজ করলে সেই ফসল বিক্রি করার জায়গা ছিল না। সে জায়গায় প্রধানমন্ত্রী নিজেই কথা বলেছেন, সেখানে একটি বেসরকারি হাইস্কুল ছিল, সেটি সরকারিকরণ হলো। স্কুল চলতো না, এখন স্কুল চলে, মেয়েদের স্কুল করা হয়েছে, কলেজ করা হয়েছে। সেখানে ৫০ থেকে ৮০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল করা হয়েছে। ফায়ার স্টেশন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে সেখানে। পাশাপাশি যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছেনি, সেসব এলাকায় সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে আলো পৌঁছে দিচ্ছি ঘরে ঘরে বিনা পয়সায়। একটা সময় যে এলাকা কলাছড়া ১০-২০ টাকাতেও বিক্রি হতো না, সে জায়গায় এখন ৫০০-৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা আসছে। শিক্ষা-দীক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে সেখানকার মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলো চুক্তির ফলে উন্নয়নের একটি ফসল।

আমরা আসলে সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে গেছি। অনেক সময় অনেকে বলে থাকেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে কিছু কিছু বাকি আছে, যেগুলো চলমান আছে। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন তো থেমে যায়নি। শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন তো বন্ধ হয়ে যায়নি। চলছে, চলবে, এটা সময়ের ব্যাপার। পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করে এটাকে এগিয়ে নিতে হবে।

সুতরাং, মনে করি, এই চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো পার্বত্য অঞ্চলের সকল অধিবাসী যাতে তাদের নিজ নিজ ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি পালনের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে; ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র আমাদের সবার, এই ভাবনা নিয়ে কাজ করে যাওয়ার জন্যই তো চুক্তি হলো। উচ্চতর শিক্ষার জন্য আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করা হলো। আমাদের মেডিকেল কলেজ করা হলো, আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হলো খাগড়াছড়িতে। প্রত্যেকটি উপজেলায় কলেজ হয়ে গেছে আমাদের। এগুলো তো চুক্তির সাফল্য।

কৃষি ক্ষেত্রে আমরা মিশ্র ফলের বাগানের প্রজেক্ট করছি। সেখানে কফি, কাজু বাদাম চাষের প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে, ইক্ষু চাষের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। নারীরা যাতে ঘরে বসে আয়-রোজগার করতে পারেন সেজন্য গাভী বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হস্তশিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বাঁশের চারা বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের আরো বিভিন্ন উদ্যোগ তো আছেই। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, দুর্গম এলাকার জন্য আবাসিক স্কুল করার জন্য। আমরা স্কুলগুলো আবাসিক করতে পারি, তাহলে দুর্গম এলাকার ছেলেমেয়েরা সেখানে এসে থাকতে পারবে। শিক্ষকদের পরিচর্যায় আরো ভালো লেখা-পড়া করতে পারবে, তাদের কষ্ট কম হবে। আমরা সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি।

ইতোমধ্যে আপনারা দেখেছেন, প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে ১০০টি ব্রিজ উদ্বোধন করলেন। তারমধ্যে শুধু খাগড়াছড়িতেই ৪২টা ব্রিজ উদ্বোধন করলেন। এরকম অজস্র উন্নয়ন কাজ হচ্ছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় ছাড়াও, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে সব মিলে এখনো প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছে পার্বত্য অঞ্চলে। তারমধ্যে সেনাবাহিনী রাস্তা-ঘাট করছে, এলজিইডি কাজ করছে, উন্নয়ন বোর্ড করছে, কৃষি বিভাগ করছে, শিক্ষা বিভাগ করছে, তিন জেলা পরিষদ আছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আছে, তারা বিভিন্ন রকম উন্নয়মূলক কাজ করছে। মন্ত্রণালয়তো এগুলো দেখভাল করছে।

পার্বত্যনিউজ: আপনার কি মনে হয় না যে দেশের সমতলের ৬১টি জেলার থেকে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি বেশি মনোযোগী বা ফোকাস রয়েছে? সরকারের আন্তরিকতার কারণে আরো বেশি বরাদ্দ যাচ্ছে পাহাড়ে? 

বীর বাহাদুর উশৈসিং: হ্যাঁ, আমি যখন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিই, তখন বা তার আগেও আমি দেখেছি। তখন উন্নয়ন বরাদ্দ ১-২শ কোটি টাকার মতো ছিলো। এখন তো হাজার কোটির ওপরে চলে গেছে। শুধু পার্বত্য মন্ত্রণালয়েই, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও তো দেয়া হচ্ছে। সব মন্ত্রণালয় মিলে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। সুতরাং, উন্নয়ন শুরু হলো মাত্র। আরো অনেক উন্নয়ন হবে। আমি মনে করি, পার্বত্য অঞ্চলে সম্প্রীতির জন্য, উন্নয়নের জন্য, শান্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তবে এই কাজগুলো করতে গিয়ে টুকটাক সমস্যা থাকতে পারে। সেগুলো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পরিবর্তন হতে পারে।

পার্বত্যনিউজ: শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি বলে জেএসএসের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়। সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়, এ ধরনের অভিযোগও করা হয়, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

বীর বাহাদুর উশৈসিং: উনারা উনাদের কথা বলবেন। উনারা উনাদের কথা বলতে পারেন। শান্তিচুক্তি বলতে ৭২ ধারার মধ্যে প্রায় ৬৫-৬৬টি ধারা আমরা বাস্তাবায়ন করেছি। ৬টি ধারা বাস্তায়ন করার কাজ চলমান রয়েছে। হয়তো কোনো কোনো ধারার কাজ এখনো চলমান রয়েছে। এ রকম হতে পারে। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি, এ কথা সত্য নয়। যদি বাস্তবায়ন না হতো তাহলে আঞ্চলিক পরিষদ কীভাবে হলো? পার্বত্য মন্ত্রাণালয় কীভাবে হলো? যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ জেলা পরিষদের মাধ্যমে কীভাবে হচ্ছে? আবার রাস্তাঘাট উন্নয়ন, প্রত্যাগত শান্তিবাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসন কীভাবে হলো?

পার্বত্যনিউজ: শান্তিচুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে হয়েছিলো। একপক্ষ সরকার। সরকারের জন্য ৭২টি ধারা, যা সরকারের জন্য পালনীয়। কিন্তু আরেকটি পক্ষ জেএসএস, তার জন্য ছিলো একটি ধারা সেটা হলে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা। কিন্তু আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি, জেএসএসের কাছে অস্ত্র আছে। তারা অস্ত্র ব্যবহার করছে। এখন পর্যন্ত তারা এই একটি ধারাই বাস্তবায়ন করেনি। এ ব্যাপারে তাদের ওপর আপনারা কোনো জোর দিচ্ছেন কিনা?

বীর বাহাদুর উশৈসিং: শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে যেদিন অস্ত্র সমর্পণ হলো সেই দিনই বলা হয়েছে, সমস্ত অস্ত্র জমা হয়ে গেছে। তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। সুতরাং এখন যেগুলো দেখা যায় সেগুলো নিশ্চয় বৈধ নয়, অবৈধ। যার কারণে পার্বত্য এলাকার মানুষের দাবি, অতি শীঘ্রই অবৈধ অস্ত্রগুলোকে উদ্ধার করা হোক। সে যেই হোক না কেন, এলাকার শান্তি-সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য এই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে। আমরাও সেটা বলেছি, সরকারও সেটা চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে কথা বলার সুযোগ আছে, সেখানে অস্ত্রের ব্যবহার কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং, যারাই অস্ত্রের ব্যবহার করুক না কেন, তারা অবৈধ অস্ত্রধারী। সেই অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে সরকার যেন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং অস্ত্রগুলো উদ্ধার করে এলাকার উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করা হয়, সরকারের কাছে এই আবেদন থাকলো।

পার্বত্যনিউজ: এই যে আপনি বললেন, উন্নয়নের ধারায় ফিরে আসা। আমরা দেখি, পাহাড়ে যে উন্নয়ন হয়েছে সেই উন্নয়নের ধারায় শামিল হতে অনেকেই অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনের ফিরে আসার চেষ্টা করছে বা মূল রাজনৈতিক ধারায় শামিল হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই কারণে অনেককে আবার হত্যা করা হয়েছে, নিযার্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতে যারা সম্পৃক্ত হতে চাচ্ছে, উন্নয়নের রাজনীতিতে যারা সম্পৃক্ত হতে চাচ্ছে, তাদেরকেও হত্যা করা হচ্ছে। তাদের জন্য এই সেফটির জায়গাটা আপনারা নিশ্চিত করতে পারছেন না কেন?

বীর বাহাদুর উশৈসিং: সরকার কোনো একটা ঘটনার আগে জানলে ভালো, না জানলে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে কিন্তু সরকার তাৎক্ষণিকভাবে সেই সন্ত্রাসীদের বা ঘটনার সামাল দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেয়। যার কারণে তিন পার্বত্য জেলার জনগণ কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন বা সন্ত্রাসীকে সাপোর্ট করে না। তারা এটা পছন্দ করে না বলেই আপনারা দেখেছেন, বারবার তিন জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। কারণ, পার্বত্য এলাকার মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়। অস্ত্রকে তারা পছন্দ করে না এবং অস্ত্রের ওপর তারা নির্ভরশীল নয় বা তারা কখনো অবৈধ অস্ত্রধারীদের সমর্থন করেনি। সে কারণেই হয়তো তারা বিদ্বেষ থেকে যারা আওয়ামী লীগ করে, যারা আমাদের দলের নেতা তাদের হত্যা করেছে। এর জন্য আমরা নিন্দা জানিয়েছি। সেটার আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আমি আশা করি, যারা এ ধরনের কাজ করেন তাদের মধ্যে বোধোদয় হবে, কেননা এটা তাদের শান্তি দেবে। আমি আহ্বান জানাবো, এগুলো পরিহার করে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা চুক্তি করেছি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এক হয়েছি, সকলে সমবেতভাবে হাতে হাত ধরে আমাদের এলাকাকে যদি ভালবাসি, সচেতন নাগরিক হিসেবে যদি আমার দায়িত্ব বোধ থাকে, আমরা সকলে মিলে কাজ করি, তাহলে এই ধরনের অস্ত্রবাজির প্রয়োজন হবে না। প্রধানমন্ত্রী এই এলাকার উন্নয়ন চান, আমরা প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা মতো কাজ করে যাচ্ছি। তাছাড়া শান্তিচুক্তি পুরোটা বাস্তবায়ন হয়নি মানে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন থেমে যায়নি, কাজ চলমান রয়েছে। আশা করি, উভয় পক্ষ মিলে এই কাজটি করতে পারবো।

পার্বত্যনিউজ: পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আরো কী করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

বীর বাহাদুর উশৈসিং: আমি মনে করি জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার। আমাদের জনসচেতনতা খুবই দরকার। জনগণকে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে, উন্নয়ন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। হেডম্যান, কারবারি, জনপ্রতিনিধি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, সাধারণ জনগণের সাথে আমরা কথা বলেছি, তারা যাতে এলাকায় উন্নয়ন করার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং সন্ত্রাসী-হামলাকারীদের কখনো আমরা সমর্থন করবো না। কেউ যেন কখনো তাদের স্থান না দেয়। সকলে মিলে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চলমান উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড যাতে চালিয়ে নেয়া যায়, তার জন্য কাজ করতে হবে। পাশাপাশি এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যেটুকু করা দরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেটা করে যাচ্ছেন। পাহাড়ের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দায়িত্ব পালন করার জন্য তাদের প্রতি আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই ।

পার্বত্যনিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।

বীর বাহাদুর উশৈসিং: আপনাকেও ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন