পাহাড়ের যেখানে উন্নয়ন সেখানেই বাধা কেন

fec-image

পার্বত্যচুক্তির ২৩ বছর পূর্তির প্রাক্কালে হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সত্য বলতে কী, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ে প্রত্যাশিত শান্তির দেখা কখনো মিলেনি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে তান্ডব চালিয়েই যাচ্ছে। তাদের দৌরাত্ম্য, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুনোখুনী, গুম, অপহরণ লেগেই আছে। তবে, এবার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা হচ্ছে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে একটি ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণকে ঘিরে। স্থানীয় ভূপ্রকৃতি এবং বৈচিত্র্যময় জীবনধারার বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠির মানুষের বসবাসের কারণে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছে পাহাড়ের তিন জেলা। কিন্তু ভ্রমণপিয়াসু পর্যটকদের থাকার মতো আন্তর্জাতিক মানের কোনো হোটেল বা রিসোর্ট নেই এ অঞ্চলে। সে কারণেই বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এ হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা এবং প্রক্রিয়া চলছে দীর্ঘদিন থেকেই। কিন্তু গত ৮ নভেম্বর ২০২০ ম্রাে জনগোষ্ঠির একদল মানুষ হঠাৎ করেই তাদের ভূমি দখলে নিয়ে হোটেল নির্মাণের অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে এক শোডাউন করে। সিএইচটি কমিশন, জেএসএস, পিসিপিসহ কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকেও একই দাবি করা হয় এবং হোটেল নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করতে বলা হয়। বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, তাদের সাথে সুর মেলায় দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের কিছু সদস্য। তাদেরই ৬২ জনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতি দিয়েও এই হোটেল নির্মাণ বন্ধ রাখার দাবি জানানো হয়েছে ইতোমধ্যে। কেউ কেউ পত্রিকায় কলাম লিখেও ম্রোদের উচ্ছেদ করে হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ান একটি জাতীয় দৈনিকে গত ১৩ নভেম্বর প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই হোটেল নির্মাণের বিরোধিতা করে লিখেছেন, ‘বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে প্রায় ৮০০-১০০০ একর জমি দখল করে ম্যারিয়ট নামে একটি পাঁচ তারকা হোটেল ও অ্যামিউজমেন্ট পার্ক স্থাপন করা হবে। এই বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে ম্রাে পাড়াবাসীদের শত বছর ধরে সংরক্ষিত পাড়া, বন, শ্মশানভূমি, জুম পাহাড়, বনজ ও ফলদ বাগান। এখানে জনবসতি এলাকার মধ্যে কাপ্রুপাড়া, দোলাপাড়া ও এরাপাড়া সরাসরি উচ্ছেদের শিকার হবে। একইভাবে মার্কিনপাড়া, লংবাইতংপাড়া, মেনসিংপাড়া, রিয়ামানাইপাড়া ও মেনরিংপাড়া উচ্ছেদ হুমকির মুখে থাকবে।’ তার আগে ১১ নভেম্বর একই পত্রিকায় সংস্কৃতিকর্মী ও কলাম লেখক পরিচয়ে সঞ্জীব দ্রং লিখেছেন, ‘এই হোটেল ও পর্যটনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলে চারটি পাড়া সরাসরি উচ্ছেদ হবে। আর ৭০ থেকে ৮০টি পাড়ার ম্রোরা উচ্ছেদের হুমকির মুখে পড়বে।’ জনসংহতি সমিতি এবং তথাকথিত সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি যখন এই নিয়ে তোলপাড় করছেন, ঠিক তখনই বান্দরবানে ঘটে এক ভিন্ন ঘটনা। যে ম্রােদের জমি কেড়ে নিয়ে হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ, সেই ম্রো জনগোষ্ঠির কয়েকশ’ সদস্য এক মানববন্ধনের আয়োজন করে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তাদের হাতে থাকা ব্যানার এবং ফেস্টুনগুলোতে উল্লেখিত বক্তব্য। ‘পাহাড়ে হোক পর্যটন, ম্রােদের হোক উন্নয়ন; নিজেদের জীবিকা নিজে করি, প্রশ্ন কেন উচ্ছেদের; ম্রো-সেনাবাহিনীর সম্পর্কের অপপ্রচার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিরোধ করি’- এমন নানা শ্লোগানে বান্দরবানে মানববন্ধন করে ম্রাে সম্প্রদায়ের লোকেরা।

১৭ নভেম্বর ২০২০ বান্দরবান মুক্তমঞ্চের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে ম্রাে নেতারা বলেন, পাহাড়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত মহলটি বলে বেড়াচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেল হলে ৮শ’ থেকে ১ হাজার একর জায়গা দখল করা হবে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে ওই এলাকায় বসবাসের অযোগ্য মাত্র ২০ একর তৃতীয় শ্রেণির জায়গা জেলা পরিষদ থেকে লিজ নিয়ে হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে সেনাবাহিনী ম্রো ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার সুবিধার্থে স্কুল ও হোস্টেল তৈরি করছে, লেখা পড়ার জন্য শিক্ষা উপকরণ প্রদান করছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য ম্রাে যুবক-যুবতীদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। অসহায়, দুস্থ ম্রাে জনগণের জন্য ঘর-বাড়ি তৈরি করছে। প্রচুর পরিমাণে ম্রাে সদস্যকে আনসারবাহিনীতে চাকরি প্রদান করা হয়েছে। ম্রাে ছেলে-মেয়েদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রদান করছে। ম্রাে যুবকদেরকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে চাকরি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অসহায় গরিব ম্রাে সদস্যদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক গবাদি পশু, আর্থিক সহায়তা, কৃষি কাজে উপকরণ হিসেবে বীজ, সার ইত্যাদি প্রদান করছে। নানা কারণেই সেনাবাহিনীর সাথে ম্রাে সম্প্রদায়ের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। কুচক্রী মহল সেটা সহ্য করতে পারছে না বলেই ষড়যন্ত্র করছে, অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় ২২ নভেম্বর ২০২০ বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের এক সংবাদ সম্মেলন থেকে। পরিষদের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত মেনে চিম্বুক পাহাড়ের ২০ একর জমিতে হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন-মান ক্ষুণ্ণ না করে এখানে পর্যটন সেবার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। হোটেল নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত জায়গাটির আশেপাশে কোনো পাড়া নেই, অতীতেও কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে ৪৩০ নং স্মারকমূলে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন প্রেরণ করা হয়। ২০১৮ সালে স্থানীয় পর্যটন উন্নয়ন কার্যক্রম জেলা পরিষদে ন্যস্ত হলে পরিষদের নিজস্ব উদ্যোগে নাইতং পাহাড়ে হর্টিকালচারের পাশাপাশি পর্যটন শিল্প উন্নয়নের জন্য রাস্তা নির্মাণ ও ছোট ছোট উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ৬৯ পদাতিক ডিভিশন বান্দরবান সেনানিবাসের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে একটি ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণের ব্যাপারে উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করা হয়। অথচ, স্বার্থান্বেষী মহলটি মিথ্যাচার করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমা বলেন, পর্যটন কেন্দ্র উন্নয়ন নিয়ে কোনো নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না।

ম্রাে সম্প্রদায়ের মানববন্ধন এবং বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সংবাদ সম্মেলনের পর এ নিয়ে আর কারো মধ্যে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, ম্রােদের উচ্ছেদ করে হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা সত্য নয়। আর যারা এই নিয়ে মিথ্যাচার করছে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনো না কোনোভাবে চিম্বুক পাহাড়ে আন্তর্জাতিক মানের হোটেলটির নির্মাণ হতে না দেয়া। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই মুহূর্তের সব চেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনস্পট হচ্ছে বান্দরবানের নীল গিরি এবং রাঙ্গামাটির সাজেক। এই দুটি স্পটও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কঠোর এবং নিরলস পরিশ্রমের কারণেই আজ পর্যটকদের জন্য সহজলভ্য হয়েছে। অন্যদিকে রাস্তাসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠির জীবন-মান বদলে গেছে। পর্যটকদের কাছে তাদের উৎপাদিত ফলমূল, হ্যান্ডিক্রাফটস সহজেই বিক্রি করে তাদের আয় বাড়াতে পেরেছে। রাস্তা হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও তাদের কাছ থেকে গিয়ে সরাসরি পণ্য কিনে আনতে পারছে। ফলে স্থানীয় নৃ-গোষ্ঠির মানুষেরা ঘরে বসেই আয়-রোজগার করতে পারছে। অথচ, একসময় সাজেকের অধিবাসীদের পণ্য বিক্রি করতে হলে দেড় দুই দিনের পথ মাথায় বহন করে বাঘাইহাট এবং দীঘিনালাতে নিয়ে আসতে হতো। নীল গিরির আশেপাশের স্থানীয় জনগোষ্ঠিগুলোরও একই অবস্থা ছিল। সাজেকে পাঙ্খো, লুসাই, ত্রিপুরা এবং চাকমা জনগোষ্ঠির লোকেরাও রিসোর্ট নির্মাণ করে পর্যটনকেন্দ্রের প্রত্যক্ষ সুবিধা ভোগ করছে। যারা রিসোর্ট নির্মাণ করতে পারেনি, অন্যদের রিসোর্টে তাদের কর্মসংস্থান হয়েছে। অবাক করার বিষয় হলো, আজকে যারা চিম্বুক পাহাড়ে হোটেল নির্মাণের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা কিন্তু সাজেক এবং নীল গিরির বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছে।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ আলুটিলার রহস্যময় গুহা এবং রিসাং ঝরনাকে ঘিরে পরিকল্পিত অত্যাধুনিক পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েও একই গোষ্ঠির বাধার কারণে সে প্রকল্প বাস্তবায়নে সফল হতে পারছে না। রাঙ্গামাটির শুভলং পাহাড় এবং ঝরনা ঘিরেও অত্যাধুনিক বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু চিহ্নিত গোষ্ঠিটির বাধার কারণেই কোনো উদ্যোক্তা এগিয়ে আসতে চাইছে না। আসলে জনসংহতি সমিতি এবং তার অনুগতরা যে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু পর্যটন বিকাশেরই বিরোধী, বিষয়টি আসলে তা নয়। বরং তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ডেরই বিরোধিতা করে। সে কারণেই ২০১৩ সালে রাঙ্গামাটির বরকলে মিজোরাম সীমান্তের থেগামুখে একটি স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করার পরও তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। পার্বত্য চুক্তির শর্তের কারণে, স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করতে হলে আঞ্চলিক পরিষদের অনুমোদন লাগে। আর আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হচ্ছেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা। তিনি আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারি প্রস্তাবে কোনো সাড়া দেননি। এমনকি থেগামুখে স্থলবন্দর হলে তার সাথে যে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা প্রয়োজন সে ব্যাপারেও তাদের আপত্তি। একই কারণে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের সম্ভাব্য স্থলবন্দরটিও আলোর মুখ দেখতে পাবে কিনা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। পাহাড়ের অনেক এলাকায় রাস্তা, ব্রিজসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প তাদের বাধার কারণে আটকে আছে, এমনকি কোনো কোনো প্রকল্প পরিত্যক্ত পর্যন্ত হচ্ছে। যেসব প্রকল্প বা অবাকাঠামো নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বা হচ্ছে সেখান থেকে তারা আবার মোটা অংকের চাঁদা আদায় করছে। কোনো কারণে চাঁদা দিতে বিলম্ব হলে কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে। কখনো কখনো আবার শ্রমিকদের মারধর করে, অপহরণ করে, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করছে।

জনসংহতি সমিতি পাহাড়ের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিরোধিতা করতে করতে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তারা তাদের বিরোধিতার কারণে নিজ জাতি গোষ্ঠির ক্ষতি হলেও তা থেকে পিছপা হচ্ছে না। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠির শিক্ষা এবং চিকিৎসার সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান করতে গেলেও তারা প্রতিরোধ করছে। তাদের এই বিরোধিতার কারণেই ২০০১ সালে সরকার রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করার পরও আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে সুচারুরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এমনকি তাদের দুর্বার প্রতিরোধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশের পর এক যুগ ধরে সরকার এটি প্রতিষ্ঠায় কোনো কাজই করতে পারেনি। এরপর সরকার যখন রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় তখনও তারা একইভাবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠির মানুষের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা এবং এখানকার অধিবাসীদের চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজের প্রয়োজনীয়তা এককথায় অনস্বীকার্য। কিন্তু জনসংহতি সমিতি আসলে কার স্বার্থে যে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তা বোঝার সাধ্য নেই।

তাদের এই বিরোধিতা ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর তা বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য দিন ধার্য ছিল। প্রধানমন্ত্রীর এ অনুষ্ঠানে জনসংহতি সমিতি এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাধা দিতে পারে এই আশঙ্কা ছিল। বিষয়টি যেন শেষ পর্যন্ত সরকারের জন্য বিব্রতকর না হয় তার জন্য আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সাথে চট্টগ্রামে সন্তু লারমার এক বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের দিনে সন্তু লারমা যেন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করেন সে জন্য তাকে অনুরোধ করা হয়। এ বিষয়ে সন্তু লারমা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, রাঙামাটি ফিরে না গিয়ে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না। কার্যত সরকারের সে অনুরোধ তিনি রক্ষা করেননি। বরং, মেডিক্যাল কলেজ উদ্বোধনের দিন সন্তু লারমার ক্যাডাররা রাঙ্গামাটি শহরকে এককথায় রণক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় বিভিন্ন যানবাহন এবং অফিস-আদালতে তারা ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরের ঘটনা ঘটায়। তাদের এই তান্ডবে চারজন সংবাদকর্মীসহ ১৭ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। আহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরাও ছিলেন। তাদের মধ্যে মনির হোসেন নামে যুবলীগের এক কর্মী চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মারা যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়তে হয়েছে, ফাঁকা গুলি পর্যন্ত করতে হয়েছে। শুধু তাই নয় ১০ জানুয়ারির পর আরো চারদিন পর্যন্ত রাঙ্গামাটি শহরে ১৪৪ ধারা জারি রাখতে হয়েছিল প্রশাসনকে। এর মধ্যেও শহরের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বাঙালিদের ওপর একাধিকবার হামলা করেছে তারা। অথচ, কী আশ্চর্যের বিষয়, তখন রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন জনসংহতি সমিতির ঊষাতন তালুকদার। যে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করছিলেন, সেই কলেজেই আবার তাদের ছেলেমেয়েদের কোটায় ভর্তি করানোর জন্য সুপারিশ করে ডিও লেটার দিচ্ছিলেন তিনি।

পাহাড়ের যেখানেই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়, সেখানেই বাধা দেয়াই যেন জনসহংতি সমিতির দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের এত বাধাবিপত্তির পরও সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের ভাগ্য উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে পার্বত্য তিন জেলায় অন্তত দশ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। বিষয়টিকে উল্লেখ করতে গিয়েই গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারের সড়ক উন্নয়নবিষয়ক এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, ‘পাহাড়ে উন্নয়নের স্বর্ণদুয়ার খুলে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তির যে সুবাতাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় পার্বত্য এলাকা।’ ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ অক্টোবর ২০২০ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা লিখেছেন, ‘উন্নয়নের স্বর্ণদুয়ার খোলেনি পার্বত্য চট্টগ্রামে’। আসলে জনসংহতি সমিতির কাজই যেখানে পাহাড়ের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাধা প্রদান করা, সেই তারাই আবার বলছেন, পাহাড়ে উন্নয়ন হচ্ছে না! তাদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ট নীতির পেছনে কী রহস্য যে লুকিয়ে আছে সেটাই আগে অনুসন্ধান করতে হবে সরকারকে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ।

[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “পাহাড়ের যেখানে উন্নয়ন সেখানেই বাধা কেন”

  1. অযুক্তি লেখা দিয়ে মানুষকে ভুলভাল উপস্থাপন করছেন? ভাই ভাই তুই মুজিব নাহয় আর্মি তথাকথিত পাহাড়ের শোষক শ্রেনী দালাল অথবা উষ্কানিদাতা। ম্রো নেতা কে? তাকে কয়জন বা জেনে? আর যারা আসছিল তারা ত জানেই না কিসের জন্য আসছে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন